২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বোমা হামলার টার্গেটে ইলহান ওমর!

ইলহান ওমর - ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের মুসলিম সদস্য ইলহান ওমর লস অ্যাঞ্জেলসে একটি সম্মেলনের সময় বোমা হামলার লক্ষ্যবস্তুতে ছিলেন। গত মাসে কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স একটি হোটেলে এ সম্মেলনের আয়োজন করে। দ্য ব্লাস্ট নামের একটি নিউজ সাইট এ খবর দিয়েছে।

সম্মেলনের কয়েক দিন আগে হোটেলটিতে এ হামলার হুমকি দেয়া হয়। গত বুধবার দ্য ব্লাস্টের খবরে বলা হয় এক মহিলা ভয়েসমেইলে হোটেলটিকে বলে, ‘আপনাকে যদি বলা হয় আপনার হোটেলটিতে বোমা হামলার ঘটনা ঘটবে তখন আপনি কী করবেন? এ অবস্থায় ইলহান ওমরের মতো ব্যক্তিকে হোটেলে প্রবেশের অনুমতি দেয়া কি ঠিক হবে। তিনি আপনার হোটেল ও আমেরিকান সমাজের জন্য একটি বিপদ। আপনি যদি নিজের নিরাপত্তাকে মূল্য দেন তবে তাকে হোটেলে প্রবেশ করতে দিবেন না। ইভেন্টটি বাতিল করুন।’

তবে হুমকি সত্ত্বেও মিনেসোটার আইনপ্রণেতারা ইভেন্টের বিষয়ে কথা বলতে হোটেলে গিয়েছিলেন। যখন বিক্ষোভকারীরা বাইরে বিক্ষোভ করছিলেন। ইলহান ওমর ইসরাইলকে সমালোচনা করায় সেটিকে কিছু লোক এন্টিসেমিটিক বলে মনে করে। 

ইলহান ওমর ইসরাইলকে উদ্দেশ করে গত মাসের প্রথম দিকে এক সভায় বলেছিলেন, আমেরিকানদের মধ্যে বিদেশীদের আনুগত্য করার প্রবণতা রয়েছে। এর আগে তিনি টুইটারে দেয়া এক বার্তায় দাবি করেন, ইসরাইলের প্রতি মার্কিন আইন প্রণেতাদের অব্যাহত সমর্থনের মূল চালিকাশক্তি হলো ইহুদিবাদী লবিদের দান করা মোটা অঙ্কের অর্থ। তিনি বুঝিয়েছেন, ইহুদি লবি আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (এআইপিসি) কাছ থেকে বিপুল অর্থ পাওয়ার কারণেই মার্কিন আইন প্রণেতারা অব্যাহতভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করে। প্রসঙ্গত এআইপিসি নামক সংগঠনটি যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের স্বার্থ দেখভাল করে।

এই মন্তব্যগুলো ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কিছু কংগ্রেসম্যান এ মন্তব্যকে সেমিটিক-বিরোধী হিসেবে তুলে ধরেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইহুদি-বিদ্বেষের নিন্দা জানিয়ে একটি রেজ্যুলেশন পাস করে প্রতিনিধি পরিষদ। পরে অবশ্য ইলহান ওমর তার মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তিনি বলেন, ‘আমি ইসরাইলের সাথে আমেরিকার সম্পর্ককে ভুলভাবে চিহ্নিত করছি না।’

তিনি টুইট করেন, ‘কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে আমার প্রথম দু’টি কাজ ছিল অ্যান্টি সেমিটিজম বিরোধী যুদ্ধের বিশেষ দূতের মর্যাদা বাড়াতে আনা একটি বিলের সহউপস্থাপক হওয়া এবং আমি নির্বাচিত হওয়ার পর আমার প্রথম মন্তব্য কলাম ছিল বিদ্বেষমূলক অপরাধ বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে।

আরো পড়ুন : চ্যালেঞ্জের প্রতীক ইলহান ওমর
মোস্তাফিজুর রহমান, ১৪ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

পুরো নাম ইলহান আবদুল্লাহি ওমর। ইলহান ওমর নামেই যার পরিচিতি। মার্কিন কংগ্রেসে প্রথম দুই মহিলা মুসলিম প্রতিনিধির একজন তিনি। মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের আইন সভার প্রতিনিধি। আইন সভায় মাইনরিটি দলের ডেপুটি চিপ হুইপ। সোমালি কমিউনিটির সদস্য। বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনায় এই কমিউনিটির কথা এসেছে। তুলে ধরা হয়েছে তাদের জীবনধারা। এই কমিউনিটির এক তরুণী আমেরিকার হাউজে প্রথম মুসলিম কংগ্রেস উইম্যান, এটা এক বড় ঐতিহাসিক ঘটনা।

মিনেসোটার এক জনসভায় দেয়া বক্তৃতায় ট্রাম্প বলেছিলেন, মিনেসোটাবাসী জানেই না যে, তাদের অঙ্গরাজ্যে এত উদ্বাস্তু এসে জড়ো হয়েছে, যার মধ্য থেকে এখন বের হচ্ছে সন্ত্রাসীরা। ট্রাম্পের মুসলিম অভিবাসীবিরোধী এই বক্তব্য তার সমর্থক বর্ণবাদী রক্ষণশীলদের নিশ্চয়ই খুশি করেছিল। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, বহু প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সোমালি কমিউনিটিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এখন একটা বদল হতে যাচ্ছে। এখন তাদের কণ্ঠ তাদেরই প্রতিনিধির মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে ক্যাপিটাল হিলে। কারণ শরণার্থীকন্যা ইলহান ওমর এখন ক্যাপিটাল হিলের সদস্য।

ইলহানের জন্ম ১৯৮২ সালে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সোমালিয়া থেকে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেন কেনিয়ায়। সেখান থেকে ১৯৯৫ সালে আসেন আমেরিকায়। নর্থ ডেকোটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে রাজনীতিতে এসে সাফল্য পান। স্টেট অ্যাসেম্বলিতে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সোমালি কমিউনিটির মুখপাত্র। এবারের কংগ্রেস নির্বাচনে মিনেসোটা ডিসট্রিক্ট-৫ থেকে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী নির্বাচিত হন। আর বিজয়ী হন নভেম্বরে।

ইলহান ওমর ২০১১ সালে বিয়ে করেন। স্বামীর নাম আহমেদ। এ দম্পতির তিন সন্তান। ইলহান ওমর শুধু অভিবাসী কমিউনিটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেননি, তার সাফল্যে আমেরিকান সমাজের সুন্দর দিকটিও পরিস্ফুট হয়েছে। বহু জাতি, গোত্র, বর্ণ, ধর্ম মিলে যে আমেরিকান সমাজে কেউ কাউকে দাবিয়ে রাখতে পারে না; একদিন না একদিন আপন মহিমায় তা ভাস্বর হয়ে উঠবেই।

গত বছরের শেষের দিকে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে প্রথম মুসলিম নারী কংগ্রেস সদস্য হিসেবে কোরআন শরিফের ওপর হাত রেখে শপথ নিয়ে ইতিহাস গড়েন ইলহান ওমর। বিপুলসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ ও অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দু’জন মুসলিম নারী শপথ নেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রতিনিধি পরিষদ বৈচিত্র্যময় রূপ নেয়। কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হয়েছে নানা সমালোচনা ও ষড়যন্ত্র। ‘ইহুদি-বিদ্বেষের’ অস্ত্রে ঘায়েল হতে চলেছেন ইলহান ওমর। তবে চ্যালেঞ্জ নিয়েই তিনি গিয়েছেন ক্যাপিটাল হিলে। যাওয়ার পরে একের পর এক চ্যালেঞ্জও এসেছে তার সামনে। বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে তার নামে, তার বিরুদ্ধে।

ইসরাইলবিরোধী মন্তব্য করে এখন মার্কিন রাজনীতিতে বিপাকে পড়েন তিনি। বিশ্লেষকেরা বলছেন- বক্তব্য না, বরং ব্যক্তি ইলহান ওমরই সমালোচকদের প্রধান টার্গেট। তারা ইহুদি-বিদ্বেষের অভিযোগকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এমন একজন কংগ্রেস সদস্যের পতন ঘটানোর চেষ্টা করছেন, যিনি প্রতিনিধি পরিষদে ইসলামী বিধান অনুসারে হিজাব পরে মানুষের নজর কেড়েছেন। যিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে, বিশেষ করে ইসরাইল ইস্যুতে স্পর্শকাতর সব তথ্য অকপটে প্রকাশ করেন।

তার বিরুদ্ধে ৯/১১ কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে বিদ্বেষমূলক পোস্টারও ছাপানো হয়েছে। যা পাওয়া যায় খোদ ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার আইনকক্ষের রিপাবলিকান স্টলে। ইলহানের অভিযোগ, মুসলিমবিদ্বেষী এ ধরনের প্রচার তাকে সন্ত্রাসবাদী প্রতিপন্ন করার উদ্দেশে করা হচ্ছে এবং সে কারণেই হুমকি পাচ্ছেন তিনি। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার রিপাবলিকানরা অবশ্য জানিয়েছেন, তারা এ ধরনের বিদ্বেষমূলক কথাবার্তাকে সমর্থন করেন না। ওই পোস্টারের এক্সিবিটরকেও বলা হয়েছে সেটি সরিয়ে নিতে।

পোস্টারটিতে নিউ ইয়র্কের জ্বলন্ত টুইন টাওয়ারের ছবি দেয়া ছিল। সাথে ওমরের ছবি। নিচে লেখা, ‘কখনো ভুলব নাÑ তোমরা বলেছিলে। আমিই প্রমাণÑ তোমরা ভুলে গিয়েছ।’ ওমর বলেন, ‘এটা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কেন আমি একটি দেশীয় সন্ত্রাসবাদী সংস্থার খতম তালিকার শিরোনামে রয়েছি। কেন আমার স্থানীয় গ্যাস স্টেশনে ইলহান ওমরকে শেষ করো লেখা থাকে।’

সাম্প্রতিক সমালোচনা ও নিন্দার মাধ্যমে ইলহান ওমরের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শুরুটা হয় একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে ইলহানের দেয়া বক্তব্যকে ঘিরে। সেখানে ইলহান বলেন, আমেরিকানদের মধ্যে বিদেশী আনুগত্য করার প্রবণতা রয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী ইহুদি লবির প্রতি ইঙ্গিত করেন। এর আগেও ইলহান ইহুদিদের নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করেন। গত মাসে তিনি টুইটারে দেয়া এক বার্তায় দাবি করেন, ইসরাইলের প্রতি মার্কিন আইন প্রণেতাদের অব্যাহত সমর্থনের মূল চালিকাশক্তি হলো ইহুদিবাদী লবিদের দান করা বিপুল অঙ্কের অর্থ। তিনি বুঝিয়েছেন, ইহুদি লবি আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (এআইপিসি) কাছ থেকে বিপুল অর্থ পাওয়ার কারণেই মার্কিন আইন প্রণেতারা অব্যাহতভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করে। এআইপিসি নামক সংগঠনটি যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের স্বার্থ দেখভাল করে।

ইলহান ওমরের এই বক্তব্যে তোলপাড় শুরু হয় মার্কিন রাজনীতিতে। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ইলহানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইহুদি-বিদ্বেষের নিন্দা জানিয়ে একটি রেজ্যুলেশন পাস করে প্রতিনিধি পরিষদ। তখন ইলহান ওমর ক্ষমা চাইলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়।

সম্প্রতি ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত প্রতিনিধি পরিষদে ইহুদি-বিদ্বেষের সমালোচনা করে আরেকটি রেজ্যুলেশন তোলা হয়। কার্যত ইলহান ওমরকে তিরস্কার করা এই রেজ্যুলেশনের উদ্দেশ্য। কিন্তু কিছু ডেমোক্র্যাট নেতা ওই রেজ্যুলেশনে ইহুদি-বিদ্বেষের পাশাপাশি মুসলিমবিরোধী আক্রমণেরও সমালোচনা করার দাবি তোলেন। ডেমোক্র্যাট সদস্যদের বিরোধিতার কারণে উত্থাপিত ওই রেজ্যুলেশনের ওপর ভোটাভুটি পিছিয়ে যায়। প্রতিনিধি পরিষদ এখন রেজ্যুলেশনে এমন শব্দ অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবছে, যাতে শুধু ইহুদি-বিদ্বেষ না বুঝিয়ে সাধারণভাবে ধর্মান্ধতা বা গোঁড়ামি বুঝায়। 

তথাকথিত ইহুদিবিদ্বেষী বক্তব্যের কারণে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকান ইলহান ওমরের ওপর দিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার ঝড় বইছে। বলতে গেলে, ইলহান এখন মুসলিমবিদ্বেষী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন।

ইলহান ওমরের জন্য বদলানো হয়েছে ১৮১ বছরের মার্কিন নিয়ম। মাথায় ‘হিজাব’ পরেই তাই শপথ নেন তিনি। গত নভেম্বরে ইলহানের সাহসী টুইট ছিল, ‘আর কেউ নন, আমি নিজের ইচ্ছেতেই হিজাব পরি। এটি আমার চয়েস...।’ ব্যক্তিইচ্ছাকে মর্যাদা দিতেই মাথা না ঢাকার ১৮১ বছরের পুরনো নিয়ম বদলায় মার্কিন কংগ্রেস।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট যে, ইহুদিবিদ্বেষকে এখন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাহলে ইলহান ওমর কি ইহুদিবিদ্বেষের অস্ত্রেই ঘায়েল হবেন; না কি পারবেন তার চ্যালেঞ্জের জয় ছিনিয়ে আনতে? এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতই বলে দেবে।


আরো সংবাদ



premium cement