২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তুরস্ক কোনো গণহত্যাকরীকে ছাড় দিবে না: এরদোগান

তুরস্ক কোনো গণহত্যাকরীকে ছাড় দিবে না: এরদোগান - সংগৃহীত

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বলেছেন, আর্মেনিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক তখনই সচল হবে যখন দেশটির কারাবাখা অঞ্চল নিয়ে দু-দেশের মধ্যকার সমস্যার সমাধান হবে। আঙ্কারা প্রতিবেশীদের জন্য ততক্ষণ অবধি সীমান্ত খুলে দিবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত আর্মেনিয়া আজেরি অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব ত্যাগ না করে।

আজারবাইজানের বাকু শহরকে ইসলামিক সেনাদের দ্বারা মু্ক্ত করার ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেয়া এক ভাষণে এরদোগান এসব কথা বলেন।

এরদোগান এসময় ১৯৯২ সালে ঘটে যাওয়া খোজলেই গণহত্যার কথা স্মরণ করেন। ১৯৯২ সালের সংঘটিত ওই গণহত্যায় ১০০ জনেরও অধিক আজারবাইজানী নাগরিক নিহত হয়েছিল।

এরদোগান বলেন, যারা আজারবাইজানের ২০ শতাংশ ভূমি দখল করে রেখেছে এবং ১ মিলিয়নেরও অধিক আজারবাইজানী নাগরিককে তাদের ভূমিতে প্রবেশ করতে বাঁধা দিচ্ছে তাদের এটা আশা করা উচিত নয় যে, তুরস্ক তাদের জন্য তার সীমান্ত খুলে দিবে।

আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে কয়েক দশক ধরে কারাবাখা অঞ্চল নিয়ে বিরোধ বিদ্যমান। ১৯৯১ সালে কারাবাখা অঞ্চল আর্মেনিয়ার সেনাদের দ্বারা আজারবাইজান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অঞ্চলটিতে শান্তি প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে।

১৯৯২ সালে আর্মেনিয়ার সৈন্যরা কারাবাখা অঞ্চলের খোজালেই নামক শহর দখল করে নেয়। আজারবাইজানের এক হিসেব অনুযায়ী সেসময় অন্তত ৬১৩ জন আজারবাইজানী নাগরিককে হত্যা করা হয় যাদের মধ্যে ১১৬ জন নারী ছিল। এমনকি ১৫০ আজারবাইজানীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল যাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, এরদোগান বলেছেন, আমরা একসাথে বাকু শহরের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি। আমরা তাদের স্মরণ করছি যারা শহরটিকে মুক্ত করার জন্য তাদের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিল। আমরা বাকু শহরের জন্য জীবন উৎসর্গকারী ১,১৩২ জন স্বাধীনতাকামীর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। ইসলামিক সেনাদের দ্বারা বাকু শহর মুক্ত হওয়ার আজকের এই দিনের মত তুরস্ক এবং আজারবাইজান একই সূত্রে গাঁথা হয়ে থাকবে। এই দুই দেশ মূলত এই অর্থ বহন করবে যার মানে দাঁড়ায় ‘দুই রাষ্ট্র কিন্তু এক জাতি’।

আমি একনায়ক নই, এটা আমার রক্তে নেই : এরদোগান
২৪ জুন ২০১৮

রজব তাইয়েব এরদোগান আধুনিক তুরস্কের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা। সমর্থকরা তাকে দেশের রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখে থাকেন।‘সুলতান’ হিসেবে খ্যাত এরদোগানকে ইতোপূর্বে গাজী পার্কে কয়েক মাসের বিক্ষোভ সহ্য করতে হয়েছে। দা ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউটের তুরস্ক বিষয়ক গবেষক সোনার ক্যাগাপ্তে বলেন, এরদোগানের অর্থনৈতিক রেকর্ড এবং কর্তৃত্ববাদী মজলুম হিসেবে তার ইমেজই তাকে প্রেসিডেন্ট পদে জয় এনে দেবে। তবে গত বছর তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একনায়ক নই, এটা আমার রক্তে নেই।’

 ধর্মপরায়ণ তবে ক্যারিশমেটিক এরদোগান নির্বাচিত হয়ে ১৫ বছরের ক্ষমতাকে আরো সম্প্রসারিত করতে চান। বিজয়ী হলে তিনি হবেন দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের পর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষমতাধর শাসক। এক দেড় দশকে তুরস্কের নজিরবিহীন প্রবৃদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাপী নন্দিত তিনি। তুরস্কের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এবং ধর্মপরায়ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে তার সৃদঢ় সমর্থন রয়েছে, যারা তার শাসনে উন্নতি লাভ করেছেন। তুরস্কে বিগত কয়েক দশকের ঘনঘন সামরিক অভ্যুত্থান এবং দুর্বল জোট সরকারের পর স্থিতিশীল সরকার উপহার দেয়ার জন্য এরদোগানের প্রশংসা করা হয়।

তিনি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর লাগাম টেনে ধরেছেন। নতুন ব্রিজ, বিমানবন্দর অন্যান্য বৃহৎ প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি এক সময়ের তলাবিহীন তুরস্ককে শক্তিশালী বাজারে পরিণত করেছেন। তার শাসনামলে সাধারণ তুর্কিদের আয় তিনগুণ বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরেছেন তিনি।

এক সময়ে আধা পেশাদার হিসেবে ফুটবল খেলোয়াড় এবং ব্যবসায় শিক্ষায় স্নাতক ডিগ্রিধারী এরদোগান ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি দেড় কোটি লোকের এ শহরটির ট্রাফিক জাম এবং বায়ু দূষণ রোধে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

যখন তার ইসলামঘেঁষা দলকে নিষিদ্ধ করা হয় তখন বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এ সময় একটি ইসলামী কবিতা পাঠ করেন। কবিতাটি ছিল এরকম- ‘মসজিদ আমাদের ব্যারাক, গম্বুজ আমাদের হেলমেট, মিনার আমাদের বেয়নেট এবং ঈমানদাররা আমাদের সৈনিক।’ এই কবিতার মধ্যে ধর্মীয় উসকানির গন্ধ পায় সেক্যুলার শাসকরা। তবে এরদোগান বারবারই এ কবিতা আবৃত্তি করেন।

২০০১ সালে এরদোগান এবং তার সহযোগী এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল ইসলামঘেঁষা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) গঠন করেন। পরের বছরের নির্বাচনে দলটি ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। এরপর আরো দুটি সংসদ নির্বাচনেও জয় পায় একেপি।

দেশবাসী বিশাল বিশাল নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তিনি বিরামহীন অংশ নেন। অসুস্থতাও তাকে থামাতে পারে না। নির্বাচনী প্রচারণার মাঝেই হয়তো স্থানীয় কোনো ফুটবল খেলায় মেতে ওঠেন তিনি।

তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য করতে দেশে ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মুসলিম রাষ্ট্র তুরস্ককে সদস্যপদ দিতে গড়িমসি করায় ক্ষুব্ধ এরদোগান বলেন, ইইউর সদস্যপদের জন্য তুরস্ক অনাদিকাল অপেক্ষা করবে না।

সাম্প্রতিক সময়ে এরদোগান তুরস্কে সেক্যুলারদের প্রবর্তিত হিজাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেছেন। মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছেন তিনি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছেলেমেয়েদের সহ-অবস্থান নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এরদোগান বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না যে ইসলামিক সংস্কৃতি এবং গণতন্ত্র একত্রে চলতে পারে না।’ তুর্কি নির্বাচনে তরুণ ভোটাররাই প্রধান ফ্যাক্টর।

তুরস্কের ইজিয়ান উপকূলের ইজমির বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্যাফেতে হিজাব পরিহিত একদল ছাত্র-ছাত্রী খোশগল্প করছিলেন এবং চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে শিক্ষকের লেকচার নোটগুলি দেখে নিচ্ছিলেন। ১৫ বছর আগে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান ক্ষমতায় আসার আগে এই দৃশ্যটি অকল্পনীয় ছিল। তুরস্কের পুরোনো ধর্মনিরপেক্ষ নিয়ম অনুযায়ী ক্যাম্পাসে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

তুরস্কের অনেক শহরের মতো ইজমিরও এরদোগানের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দ্বারা দৃশ্যত রূপান্তরিত হয়েছে। শহরের রাস্তাগুলোতে ইউরোপীয়-নির্মিত বিলাসবহুল ‘সেডান’ গাড়ির পাশাপাশি রাস্তাগুলোর পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে বহুতল অফিস ভবন।

রবিবারের নির্বাচনে পুনরায় বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা হিসাবে এরদোগান এসব অর্জনকে কৃতিত্ব হিসেবে প্রচার করছেন। কিন্তু একটি ডেমোক্রেটিক প্রাচীরের মধ্যে চলতে ঝুঁকিতে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। এক কারণে আসন্ন ভোট এরদোগানের জন্য অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারে আর তা হচ্ছে দেশটির ক্রমবর্ধমান তরুণ ভোটাররা।

ইস্তাম্বুল-ভিত্তিক রাজনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘মার্ট ইলদিজ’-এর মতে, তুরস্কের ২৫ বছরের নিচে যুবক-যুবতীদের চারভাগের একভাগ কেবল এরদোগানকে সমর্থন করবে। প্রতিবছর দেশটিতে ১৮ বছর বয়সের ১০ লাখেরও বেশি ভোটার জাতীয় ভোটার তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন। যদিও, অন্যান্য দেশের মতো ভোট নিয়ে তুরস্কের বয়স্কদের তুলনায় তরুণদের আগ্রহ কিছুটা কম।

এরদোগানের প্রতিদ্বন্দ্বিরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তরুণ ভোটাদেরকে চিহ্নিত করেছেন। প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি তরুণ ভোটারদের কাছে টানতে তাদের উদ্দেশ্যে একটি অ্যানিমেটেড ভিডিও প্রকাশ করেছেন। এতে তরুণদের ভোটদানের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে এবং পার্টির প্রধান কেমাল কিলিকদারোগ্লু বুধবার রাতে একটি টিভি সাক্ষাত্কারে এই আবেদনের পুনরাবৃত্তি করেন।

তুরস্কের যুবকদের ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি আকৃষ্ট করার এরদোগান একটি ‘ধার্মিক প্রজন্ম’ গড়ে তোলার কথা বলেছেন। হিজাবকে তিনি এই প্রকল্পের কেন্দ্রীয় প্রতীকে পরিণত করেছেন। কিন্তু ইলদিজ বলছেন যে কম বয়সী এবং সবচেয়ে শিক্ষিত ভোটাররা ‘ধর্মীয় পরিচয়ের নীতি ভেঙ্গে ফেলছেন’।

ইস্তাম্বুলের পার্শ্ববর্তী কাসিমপাশায় জন্ম নেয়া এরদোগানের বাবা ছিলেন একজন কোস্টগার্ড কর্মকর্তা। কিশোর বয়সে রাস্তায় রুটি এবং লেবু বিক্রি করতেন এরদোগান। তরুণ বয়সে ইসলামিক ইয়ুথ সংগঠনে যোগদান করেন তিনি। এ সংগঠনটি তুরস্কের কট্টর সেক্যুলার নীতির বিরোধিতা করে। তুরস্কের ক্ষমতাধর জেনারেলরা মসজিদ ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিশাল ব্যবধান তৈরি করে।


আরো সংবাদ



premium cement