২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিমানবাহী রণতরী বানানোর প্রতিযোগিতা

বিমানবাহী রণতরী বানানোর প্রতিযোগিতা - ছবি : সংগৃহীত

রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় এয়ারক্রাফট কেরিয়ার (বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ) বানানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় আকারের ১০টি এয়ারক্রাফট কেরিয়ারকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের যেমন ১০টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে, তেমনি দেশটির রয়েছে জাহাজগুলোতে বিমানসহ অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত করার জন্য ব্যয় করার যথেষ্ট সামর্থ্য। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া উদীয়মান অর্থনীতির দেশ চীনের রয়েছে উদ্বৃত্ত বৈদেশিক মুদ্রা। মজবুত অর্থনীতির কারণে দেশটি সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করায় এর অর্থনীতিতে নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। চীন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বানানোর পাশাপাশি আরো ৫৫টি যুদ্ধজাহাজ বানানেরা ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ছাড়া ব্রিটেন, রাশিয়া অথবা ভারতের রয়েছে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার উদগ্র বাসনা। এ দেশ তিনটির অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র অথবা চীনের উদ্বৃত্ত চরিত্রের নয়। এছাড়া সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়া মানেই হলো যুদ্ধের দামামা। যুদ্ধ লাগলে কয়েকটি দেশ সীমিত আকারে লাভবান হলেও অবশিষ্ট বিশ্ব সঙ্কটে পড়তে বাধ্য। কারণ বিশ্বায়নের এ যুগে এক দেশের অর্থনীতি অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসায়-বাণিজ্যের কারণে। সে কারণে সামনের দিনে যুদ্ধ বাধলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়বে।

নতুন করে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বানাচ্ছে রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন ও ভারত। রাশিয়া তৈরি করছে এক লাখ টন ওজনের এয়ারক্রাফট। যুক্তরাষ্ট্রের বড় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যত সংখ্যক বিমান বহন করতে সক্ষম এটাও ঠিক সেরকমই বিমান বহন করতে সক্ষম। বর্তমানে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুগের একমাত্র বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ এডমিরাল খুজনেটসভ রয়েছে সুপার পাওয়ার রাশিয়ার। এক যুগ পর সিরিয়ার উদ্দেশ্যে এ জাহাজটি যাত্রা করলে তা অপারেশনে রাখার জন্য যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথেই এ যুদ্ধ জাহাজ খুইয়েছে দুইটি বিমান। রাশিয়ার বর্তমান এবং একমাত্র যুদ্ধ জাহাজটি মাত্র ৩০টি বিমান বহন করতে সক্ষম। অন্য দিকে, মার্কিন বিমানবাহী জাহাজগুলো ৯০টি বিমান বহন করতে সক্ষম। আমেরিকান বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলো থেকে একই সাথে তিনটি বিমান এক মিনিটের মধ্যে উড়ে যেতে পারে। অন্য দিকে, রাশিয়ান খুজনেটসভ জাহাজ থেকে বিমান উড়ে যেতে কয়েক মিনিট লাগে। এছাড়া খুজনেটসভের আরো অনেক বিষয় আছে যেগুলো এখন আর কাজ করে না। এসব কারণে রাশিয়া চাচ্ছে আধুনিক যুদ্ধ জাহাজ। বিমানবাহী জাহাজে লাগবে আরো ৯০টি আধুনিক বিমান।

চীন খুব শিগগিরই তার নিজের তৈরি একমাত্র বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ পানিতে নামাতে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান এ দেশটির একটি মাত্র বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘লিয়াওনিং’ সমুদ্রে অপারেশনে রয়েছে। এটা ইউক্রেন থেকে বানানো। এই জাহাজটি দিয়েই চীন দক্ষিণ চীন সাগরে আমেরিকানদের সাথে শক্তি প্রদর্শন করছে। নতুন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারটি ৭০ হাজার টন ওজনের ৩১৫ মিটার দীর্ঘ ও ৭৫ মিটার প্রস্থের। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের নৌশক্তি মার্কিনিদের চেয়ে মাত্র চার শতাংশ। নাম নির্ধারিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা নিজ দেশে তৈরি এ জাহাজটি তিনটি গাইডেড মিসাইল ড্রেসট্রয়ার, তিনটি ফ্রিগেট, একটি সরবরাহকারী জাহাজ, একই সাথে থাকবে চীনের নির্মিত জে-১৫ অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান বহর এবং বেশ কিছু জাহাজের উপযোগি হেলিকপ্টার। 

এ দু’টি দেশের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে বিশ্বের বৃহৎ নৌশক্তি। এত বৃহৎ নৌশক্তি বিশ্বের আর কারো নেই। ইতোমধ্যে ১০টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার পানিতে তাদের শক্তি প্রদর্শন করছে। সাবেক ওবামা প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যে মার্কিনি নৌশক্তির ৬০ শতাংশ মোতায়েন করবে এশিয়ার প্যাসিফিক অঞ্চলে। অন্য দিকে, নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প অঙ্গীকার করেছিলেনÑ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি সদস্য সংখ্যাও বাড়াবেন। একই সাথে তখন ঘোষণা করেছিলেন তিনি ক্ষমতায় গেলে ৮০টি অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের সাথে দূরের লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করার জন্য গাইডেড মিসাইল ক্রুজার যুক্ত থাকে, বিমান আক্রমণ ঠেকানোর জন্য প্রত্যেকটা জাহাজের সাথে আরো থাকে ছয় থেকে আটটা ডেস্ট্রয়ার অথবা ফ্রিগেটের বহর। শত্রু সাবমেরিন অথবা শত্রু জাহাজ ধ্বংস করার জন্য থাকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাবমেরিন, গোলাবারুদ সরবরাহকারী শিপের সাথে থাকে ৬৫ থেকে ৭০টি যুদ্ধ বিমানের বহর। 

বর্তমানে ব্রিটেনের কোনো এয়ারক্রাফ ক্যারিয়ার নেই। পুরনো একটি ক্যারিয়ার ভারতের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। এক সময়ের সাম্রাজ্যবাদী দেশ ব্রিটেন পৃথিবীর অর্ধেক শাসন করলেও কালের বিবর্তনে অনেকটা ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে দেশটির সমৃদ্ধ অর্থনীতি। তবু শাসক বলে কথা। বিশ্বে আবারো শুরু হয়েছে শক্তি প্রদর্শনের খেলা। এ খেলারই অংশ হিসেবে দেশটি নির্মাণ করছে দুইটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। নির্মাণাধীন কুইন এলিজাবেথ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারটি হবে ৬৭ হাজার টন ওজন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন। ২০১৪ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ২৮০ মিটার দীর্ঘ। ২০২১ সালে এ জাহাজটি যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হবে। দ্বিতীয় এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার প্রিন্স অব ওয়েলস আরো দুই বছর পর প্রস্তুত হবে যুদ্ধের জন্য। এ জাহাজটি এভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন এতে ৩৬টি এফ৩৫ বি স্টিলথ বিমান উঠানামা করতে পারে। একই সাথে থাকবে চারটি মারলিন হেলিকপ্টার, চিনুক ও অ্যাপাচি গানশিপ। সাথে থাকবে ফ্রিগেট, ডেস্ট্রয়ার এবং একটি সাবমেরিন। 

সুপারপাওয়ার হওয়ার অভিলাষ রয়েছে আমাদের পাশের দেশ ভারতের। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নির্মাণের ক্ষমতা নিজের না থাকলেও বাইরের দেশের সহযোগিতা নিয়ে তৈরি করছে। ইতোমধ্যে ২০১৩ সালে রাশিয়ার সাহায্যে নির্মিত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বিক্রমাদিত্য তার পানি সীমা পাহারা দিচ্ছে। এটা ৪৪ হাজার ৫৭০ টন ওজনের নিতে পারবে। এছাড়া ৪০ হাজার টন ওজনের আইএনএস বিক্রান্ত ২০২৩ সালে নির্মাণ শেষ হবে। বিক্রান্তই ভারতের প্রথম এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যা নিজেরা তৈরি করছে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সহায়তায়। এতে হেলিকপ্টারসহ ৩০টি যুদ্ধবিমান উঠানামা করতে পারবে। নির্মাণাধীন আইএনএস বিশাল হবে পারমাণবিক জ্বালানিনির্ভর। এতে ৫৫টি বিমান উঠানামা করতে পারবে।

ভারত একটি অতি দরিদ্র দেশ। এখনো এ দেশের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ খোলা আকাশে মল ত্যাগ করে। এখনো জনসংখ্যার বিশাল অংশ না খেয়ে রাতে ঘুমায়। সেই ভারতই সুপার পাওয়ার হওয়ার বাসনা নিয়ে সামরিক বাজেট বাড়িয়ে যাচ্ছে। পারমাণবিক বোমার অধিকারী হওয়ার পর এখন সমুদ্রে প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যয়বহুল এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি করছে। এতে করে পাশের দেশগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।


আরো সংবাদ



premium cement