১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`
ভ্রমণ

বিছানাকান্দি

ছবি : লেখক -

ঘড়ির কাঁটাতে সকাল ১০টা ছুঁই ছুঁই। সেই কোন সময় থেকে রেডি হয়ে বসে আছি। গন্তব্য বিছানাকান্দি। আকাশের মন খারাপ। খুব তাই মুষলধারে বর্ষণ হয়েই চলছে। শেষ পর্যন্ত আমরা বের হলাম সবার কাক্ষিত গন্তব্য বিছানাকান্দির দিকে। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে আছে পরিবারের সবাই। নাশতার পর্ব সারতে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম ইস্কনের ভোজনালয়ে। বসার কোথাও জায়গা নেই এত বৃষ্টির ভেতরেও। অপেক্ষার প্রহর শেষ করে আমরা বসার জায়গা পেলাম। কী আছে জানতে চাইলে বললেন, আছে রুটি, পরোটা, পাকোড়া, অন্ন, ডাল আর সবজি। যা চাবেন তাই পাবেন। অনেক দিন পর বইয়ের ভাষার অন্ন শব্দটার স্বাভাবিক প্রচলন কানে যেন একটু ধাক্কা খেয়ে গেল। কেউ সাদা রুটি, কেউ আবার পরোটা, সাথে লাবড়া, সয়াবিন তরকারি, মিষ্টি, হালুয়া নিলেন। সব আইটেম গরম গরম পরিবেশন করা হলো। অসাধারণ স্বাদ। এত ক্ষণে বোঝার বাকি রইল না, এত মানুষের ভিড় কেন এখানে। আমরা গন্তব্য পথে যাত্রা শুরু করলাম। মহাসড়ক পেরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম। আকাশের মন ভালো না। গোমড়া হয়ে আছে। এর মধ্যেই আমরা এগিয়ে চলছি চৌহাট্টা, আম্বরখানা, চৌকিদীঘি পেরিয়ে। সিলেট শহরের বিমানবন্দর রোড ধরে বিছানাকান্দির পথ। দু’পাশের সবুজ চা-বাগান পেছনে ফেলে যাচ্ছি আমাদের গন্তব্যে। এ পথ ধরে গেলে মনে হবে, পুরো পৃথিবীটাই যেন সবুজের রাজ্য। আর আঁকাবাঁকা পাহাড়ি উঁচুনিচু পথটাকে কেউ বড় অজগর বলেও ভুল করতে পারেন। এদিকে আবার মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। এয়ারপোর্ট রোড ছাড়িয়ে আসার পর ভাঙাচোড়া রাস্তার মধ্যে এসে পড়লাম। কিছদূর পর পর ভাঙা রাস্তা। মেরামতের কাজ চলছে প্রায় সব জায়গায়। রাস্তার জন্য সবার অবস্থা কাহিল। ঘণ্টা দু’য়েকে পৌঁছে গেলাম হাদারপাড় বাজারে। সেখানে গিয়ে গাড়ি আর এগোতেই চায় না। অগত্য হেঁটে রওয়ানা দিলাম। আমাদের যেতে হবে ট্রলারঘাটে, সেখান থেকে নৌকা করে যেতে হবে। নদীর ঘাট কোথায় বলেতেই সবাই বলেন সামনে, কিন্তু সামনে তো আর শেষ হয় না। এদিকে আকাশের ভেঙে পড়ার অবস্থা। দূর থেকে দেখা পেলাম সাত পাহাড়ের চূড়া। অসাধারণ প্রকৃতি দূর আকাশে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের ছড়াছড়ি। শেষ পর্যন্ত আমরা ট্রলারঘাটে পৌঁছলাম। দরদাম করে উঠে পড়লাম ট্রলারে। আমাদের যাত্রা শুরু হলো বিছানাকান্দির পানে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় আকাশ আর মেঘের সাথে পাহাড় মিশে আছে। যতই কাছে যাই, পাহাড়গুলোর ততই আকাশ থেকে যেন দূরে যেতে থাকে। আমরা চলছি ঢেউয়ের তালে তালে। যখন দুটো ট্রলার একে অন্যকে অতিক্রম করে, তখন যেন ঢেউ আছড়ে পরে। আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম কাক্ষিত গন্তব্যে।
চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অজস্র পাথর। দেখে যেন মনে হয়, পুরো এলাকাটাই পাথরের বিছানা। পিয়াইন নদীর অগণিত পাথরের মাঝে আপনাকে হাঁটতে হবে সাবধানে পা ফেলে। একটু অসাবধানতার ফলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পানির গভীরতা কম হলেও পাথরের মাঝে আপনার ভ্রমণকে করবে আরো রোমাঞ্চিত। একটু পরপর বিজিবি সদস্যদের সতর্কবাণী আপনাকে এনে দেবে আরো থ্রিলার। ওপরে নীল আকাশ ঠিকরে পড়েছে নদীর পানি দেখাচ্ছে নীলাভ। ডানে-বাঁয়ে-সামনে মেঘালয়ের উঁচু পাহাড়। পাহাড়ে হেলান দিয়ে সাদা মেঘ। মাঝে ঝরনার ধারা। দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত শুধু পাথর আর পাহাড়। এ দৃশ্য দেখে নিজেকে সামলানো বড় কঠিন!
বিছানাকান্দির জলধারায় স্নাত হয়ে আমরা গেলাম পাশের বাজারে। সেখানে সব ভারতীয় পণ্য, অনেক কম দামে কিনতে পারবেন নানা রকমের চকোলেট, সাবান, শ্যাম্পু, ছোটদের খেলনা, কসমেটিক, আচার আরো অনেক কিছু। আমরা ঘুরে বেড়ালাম ছোট্ট বাজারে। সবাই বাজার থেকে কিছু-না-কিছু কিনলেন। চকোলেট, বিস্কুট, আচার, সাবান, কসমেটিক সদাই করে সবাই ক্লান্ত। আমরা বাজারের পাশে গড়ে ওঠা খাবারের দোকানে গেলাম। এক ভদ্রমহিলা এলেন, কী লাগবে আপনাদের- দেশী মুরগির গোশত, রুই মাছ, বোয়াল মাছ, ছোট মাছ, চিংড়ি মাছ, বেগুন ভাজা, ভেরাইটিজ, কী লাগবে। সবাই চিন্তায় পড়ে গেল, কে কোন আইটেম খাবেন বলে। সবাই আহারপর্ব শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন। এবার বিদায় নেয়ার পালা। সবাই চাইছিলেন আরো কিছু সময় থাকার জন্য। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। আমরা ফিরে চললাম ঘাটের দিকে। পেছন থেকে সীমান্তের দিগন্তছোঁয়া মেঘালয় পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সময় পেলে ঘুরে আসতে পারেন এই পর্যটন স্পট থেকে। এখানকার নয়নাভিরাম প্রকৃতি আপনাকে নিরাশ করবে না।
যাবেন কিভাবে

সিলেট শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নে বিছানাকান্দি গ্রাম। সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জ মহাসড়ক ধরে সালুটিকর বাজারের ডান দিকে গাড়ি নিয়ে গোয়াইনঘাট লিংক রোডে হয়ে দেড় ঘণ্টা গেলেই আপনি পৌঁছে যাবেন বিছানাকান্দি। এ ক্ষেত্রে শহরের আম্বরখানা থেকে সিএনজি নিলে সহজে এবং কম খরচে বিছানাকান্দি যাওয়া যায়। হাদারপাড় বাজার পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া ১০০ টাকা। সেখানে পৌঁছতে লাগবে কমবেশি দেড় ঘণ্টা। বাজারের পাশেই খেয়াঘাট। ঘাট থেকে নৌকা রিজার্ভ করে যাওয়া যায় বিছানাকান্দি। দর কষাকষি করে এক হাজার টাকার মধ্যে নৌকা রিজার্ভ করা যায়। যদিও পর্যটকদের কাছে অতিরিক্ত ভাড়া হাঁকানোর নজির এখানকার মাঝিদের আছে। তাই আগে থেকে ভাড়া ঠিক করে নেয়া ভলো। নৌকায় যেতে যেতে দেখতে পাবেন দু’পাশে সবুজ গ্রামের প্রতিচ্ছবি। সাথে দূরে মেঘালয়ের পাহাড়গুলো দেখে অতি নীরস লোকটিও যদি একটু রসিকতা করে, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেটিই যেন স্বাভাবিক। নৌকা যতই আগাবে সামনের দিকে, আপনি ততই অবাক হতে বাধ্য। নদীর ধার ঘেঁষে মাঝে মধ্যে উঁচু করে স্তূপ আকারে জমিয়ে রাখা হয়েছে সাদা-কালো ও বাদামি পাথরের চাঁই। মনে হবে, সবুজ পাহাড়ের কোলে আরেক সাদা পাহাড়।


আরো সংবাদ



premium cement