১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নাটের গুরুর কাণ্ড

-


অনার্সে পড়াকালীন জাহিদ নামের আমাদের এক ক্লাসমেট ছিল। দুষ্টামি, হাসি, তামাশায় সবসময় ক্লাসটাকে মাতিয়ে রাখত। এমনকি ক্লাসে টিচার থাকাকালীনও দুষ্টামির কমতি থাকত না। মাঝে মধ্যে যে ধরা খেত না তা নয়। অনেক সময় এসব দুষ্টামির কারণে স্যার-ম্যামদের অনেক বকাও খেয়েছে সে। তবুও থামেনি। দুষ্টামি যেন তার রক্তে মিশে আছে। কী ক্লাস, কী পরীক্ষার হল সবই যেন তার জন্য হাসি-তামাশার জায়গা। অন্য কেউ বিরক্ত হোক বা না হোক আমি প্রায়ই বিরক্ত হতাম তার প্রতি। সে বিষয়টা বুঝলেও কখনো সিরিয়াসলি নেয়নি এটাকে।
ছাত্র যে সে খারাপ ছিল তাও নয়। বরাবরই ফার্স্ট ক্লাস পেত। একবার হলো কী! আমাদের ইয়ার ফাইনালের জন্য ফরম ফিল আপের নোটিশ এলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অথচ তখন পর্যন্ত আমাদের টেস্ট পরীক্ষা হয়নি। কিন্তু পূর্বের বছরগুলোতে টেস্ট পরীক্ষার পর ফলাফল ঘোষণা করা হলে যারা পাশ করত তাদেরই ফরম ফিল আপ হতো। বাকি যারা ফেল করত তাদের সাবজেক্ট প্রতি দুই শ’ টাকা জরিমানা দিয়ে ফরম ফিল আপ করতে হত। কিন্তু সেবারই কোনো এক বিশেষ কারণে এরূপ ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। আটটা বিষয়ের মধ্যে দুটা পরীক্ষা দিতেই ফরম ফিল আপের নোটিশ এলো। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফরম ফিল আপও শেষ হয়ে গেল। তখন সবাই চিন্তামুক্ত। কেননা সেবার টেস্ট পরীক্ষার পাস-ফেলের ঝামেলাটা পোহাতে হবে না কাউকেই।
ফরম ফিল আপ শেষ হওয়ার পরও আমাদের পাঁচটা পরীক্ষা বাকি ছিল। তার মধ্যে প্রথম পরীক্ষার দিনেই ছাত্র শতকরা পঞ্চাশজন কমে গেল। তার পরের পরীক্ষার দিনে কমে গেল আরো পঞ্চাশজন। তারপর তৃতীয় দিনে ঘটল আরো এক চমকপ্রদ ও ঐতিহাসিক ঘটনা। সেদিন পরীক্ষার হলে দেড় শ’ ছাত্রের মধ্যে এলো মাত্র পনেরোজন।
এর কারণ ছিল দুটি। প্রথম কারণ টেস্ট পরীক্ষায় পাস-ফেলের প্যারা ছিল না। দ্বিতীয়ত সেদিন ছিল তুমুল বৃষ্টি। প্রতিকূল আবহাওয়া থাকার কারণে শুধুমাত্র নিয়মিত ক্লাস করে এরূপ ক’জন ছাত্র ছাড়া বাকি সবাই ছিল অনুপস্থিত। যদিও ডিপার্টমেন্ট কর্তৃপক্ষ বারবারই জোর দিয়ে বলেছে যে, ফরম ফিল আপ হয়েছে তাই বলে আমাদের টেস্ট পরীক্ষা দিতে হবে না এমনটি যেন আমরা না ভাবি। সবগুলো পরীক্ষাই যেন দিই। কিন্তু সেদিনের পরীক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখে সব টিচারগণই হতাশ হয়েছিলেন। তারপরও পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ভেতরে পরীক্ষা চলছে। কিন্তু কারোরই মনোযোগ নেই পরীক্ষার প্রতি। সবাই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বিশেষ করে জাহিদের হাসি-তামাশা যেন সেদিন বড্ডই লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছিল। খাতা, প্রশ্ন দেয়ার কিছুক্ষণ পর ম্যাম হঠাৎ দুই মিনিটের জন্য একটু বাইরে গেলেন। আর জাহিদ দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলো, সবাই যেন একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে খাতা জমা দিয়ে দেয়। কেননা আজ পরীক্ষার্থী কম, আবহাওয়াও প্রতিকূল।
সবার মধ্যে যেন একটা গুঞ্জন বয়ে গেল। ম্যাম চলে এলো। একজন, দুজন করে খাতা জমা দেয়া শুরু করল। যখন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা আটজনে এসে ঠেকল তখন জাহিদ বেঞ্চ থেকে উঠে সবার খাতা একত্র করতে লাগল। অবশ্য আমার মতো যারা সবসময় ফুল অ্যানসার করার পক্ষপাতী তারা খাতা দিতে চাইল না। আমিও না। তবুও জাহিদ টেনে সবার খাতা নিয়ে জমা করে দিলো। অর্থাৎ চার ঘণ্টার পরীক্ষা মাত্র এক ঘণ্টাতেই খতম।
সবাই মনে করেছিল যেহেতু ফরম ফিল আপ হয়ে গেছে সেহেতু টেনশনের কোনো কারণ নেই। পরীক্ষা দিলেই কী আর না দিলেই কী? কিন্তু সবার ধারণা পাল্টে গেল তখনই যখন ফাইনাল পরীক্ষার এডমিট কার্ড এলো। তখন ডিপার্টমেন্ট থেকে ঘোষণা এলো যারা পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল এবং যারা খামখেয়ালি করে পরীক্ষা না দিয়ে খাতা জমা দিয়ে গেছে তদুপরি যারা ফেল করেছে তাদের সবাইকে সাবজেক্ট প্রতি দুই শ’ টাকা জরিমানা দিয়ে এডমিট কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। তখন যারা অনুপস্থিত ছিল বা ফেল করেছে তাদের তো ব্যাপার ভিন্ন কিন্তু জাহিদের কারণে ঐদিন যারা পরীক্ষা দিতে পারেনি তাদের সবার নজর পড়ল জাহিদের প্রতি। সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে বলতে লাগল আমাদের সবার জরিমানা জাহিদ দেবে। কেননা সে সেদিন আমাদের পরীক্ষা দিতে দেয়নি। যদিও দোষ জাহিদের একার ছিল না। কেননা সেদিন তার সাথে সবাই সায় দিয়েছিল। কেউ তার নামে অভিযোগ করেনি। কিন্তু আজ যেন সব দোষ জাহিদের।
অবস্থা বেগতিক দেখে জাহিদ গা ঢাকা দিলো। কেননা সবার জরিমানার টাকা এখন তার ঘাড়ে এসে পড়তে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আর নাটের গুরু জাহিদকে পাওয়া গেল না। সবাই যার যার জরিমানার টাকা পরিশোধ করে এডমিট কার্ড সংগ্রহ করে ফাইনালে অংশগ্রহণ করল। এ নিয়ে সবার মনে কিঞ্চিৎ কষ্ট থাকলেও নাটের গুরু জাহিদ যেন পৈশাচিক এক আনন্দ পেয়েছিল।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement