২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফেরিওয়ালীর সংসার

-

আজ সদরে হাটবাজার সাপ্তাহের মালকাটতে হবে পড়ন্ত বিকেলে রওনা দিলো ফারিয়া। অন্ধকার ঘনিয়ে না আসতেই বাসায় ফিরতে হবে। রাত গভীর হলে ডাকাতের ভয় রয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে আরকান সড়ক পার হয়ে কয়েক মাইল হাঁটতে হয়। দু’পাশে নিঝুম বনজঙ্গল মধ্যখানে সারা রাস্তা বেয়ে যেতে হয় বাসায়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাকানন হলো পাহাড়ি অঞ্চলের গ্রামগুলো। কী নাই তাতে! নানান ফুলে ফলে ভরা হরেক রকমের গাছগাছালির বনাঞ্চলে সবুজ সমারোহ গ্রাম। গ্রামের মানুষগুলো সহজ-সরল। তাদের প্রধান জীবিকা হলো কৃষিকাজ। বিভিন্ন সবজির ফলন ফলায় বারো মাস। সেইরকম গ্রাম চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ পাহাড়ি অঞ্চল ঘেঁষে ছোট্ট এক গ্রামে বাস করত ফারিয়ার পরিবার। মা-বাবা দুই ভাই এক বোন মিলে ফারিয়ার সিম্পল মধ্যবিত্ত একটা পরিবার।
দূরান্ত সঞ্চলিত মেয়ে ফারিয়া তার ছোটবেলা কেটেছে বেশ আহ্লাদে।
ভোরে ফারিয়ার ঘুম ভাঙতো পাখির কলতানে। আধো আধো ঘুম চোখে উঠে মুখ হাত ধুয়ে চলে যেত মক্তবে। ৮টা বাজে মক্তব ছুটি হয়। তখন মহল্লার বাকি দশটা সহপাঠীর সাথে হৈহুল্লোড়ে বাসায় ফেরে ফারিয়া। ফারিয়া সেই ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকতেই তার ভালো লাগে। ফারিয়ার বাবা একজন কৃষক। তাদের খামার ঘর রয়েছে। সেখানে আছে গরুর গোয়াল। প্রায় অর্ধশতাধিক গরু ছিল তাদের। গরু চরাতেন ফারিয়ার বড় ভাই রমজান আলী। তিনি এত গরু সামাল দিতে পারতেন না বলে ফারিয়াকে সাথে নিয়ে যেতেন। ফারিয়াও খুশি সকালে মক্তব থেকে এসে খাবার খেয়ে বড় ভাই রমজান আলীর সাথে গরুর পাল নিয়ে ছুটত বনে। এই ভাবেই কাটে ফারিয়ার কিশোরী জীবন।
ফারিয়া এখন বেশ বড় হয়েছে। মা তাকে আর বাইরে যেতে দেন না। ঘরের ভেতর কাজেই রাখতেন। ফারিয়া লেখাপড়া বেশি করতে পারেনি। তবে পাশের গ্রামে ছিল এক এনজিও স্কুল। সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করে ছিল। বেশ মেধাবী ছিল ফারিয়া, মাসে ৩০০ টাকা বৃত্তি পেত স্কুল থেকে। পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে পড়া হয়ে উঠেনি আর। ফারিয়ার বাবা ছিলেন হাঁপানি রোগে আক্রান্ত। তিনি হঠাৎ একদিন ভোর রাতে শ্বাসরোধ হয়ে পড়েন, সাথে প্রেসার বেড়ে যায়। সকালে ফারিয়ার মা উঠে দেখেন, তিনি গোংড়াচ্ছেন। তিনি চিৎকার করলে সবাই উঠে আসে। সাথে সাথে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক বেলা ১১টার দিকে মৃত ঘোষাণা করেন। এর কিছুদিন যেতেই বাবার শোক কেটে না উঠতেই ফারিয়ার মা মারা যান। মা-বাবা হারা ফারিয়ার জীবনটা যেন হয়ে উঠে বিষণœতার ঘোর তিমির। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে ফারিয়া ছিল সবার ছোট। বড় ভাই রমজান আলী বিয়ে করেছেন। তিনি এখন পরিবারের গার্জিয়ান। তিনি যা বলেন তা করতে হয় পরিবারে।
পরিবারের মা-বাবাহীন ফারিয়াকে নিয়ে দুই ভাই চিন্তিত। তাড়াতাড়ি বোনকে বিয়ে দিতে হবে। তারা পাত্র খুঁজতে লাগল। পাশের বাড়ির খালাম্মা মায়ের খুব ক্লোজ ছিলেন। তিনি একটা পাত্রের খবর নিয়ে আসেন। ভাইয়েরা দূরবর্তী খালার মুখে ছেলের প্রশংসা শুনেই বোনকে তুলে দিতে রাজি হয়ে গেলেন।
একমাত্র বোন বলে ধুমধাম করে বিয়ে দিলেন। ফারিয়ার হাজবেন্ড বেকার ছেলে কোনো কাজকর্ম করতেন না! বিয়ের সাত দিন পর থেকেই ফারিয়া আর হাজবেন্ডের মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া হতো সংসারে। স্বামী রাত করে বাসায় ফিরতেন, কোনো বাজার করতেন না। এই নিয়ে শাশুড়ি খুব চেঁচামেচি করতেন। বলতেন, বসে বসে খাবে বউজামাই। বাপের জমিদারি আছে নাকি? বাজার করতে না পারলে বউ নিয়ে আলাদা খা।
এসব শুনে ফারিয়ার খুব কষ্ট হতো। স্বামীকে বাজার খরচের কথা বললেই স্বামী রেগে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন শুরু করেন। বলেন, তোর বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আয় টাকা, তার পর বাজার করমু।
এই ভাবে চলতে থাকে ফারিয়ার ওপর নির্যাতন। তার সাথে আবার যৌতুক চায়। এ দিকে ভাইকে এই কথা বললে ভাই ক্ষিপ্ত হয়। বোনকে সামর্থ্য অনুযায়ী যা কথা ছিল তার মধ্যেই বিয়ে দিয়েছিল। তবুও কেন যৌতুকের কারণে বোন নির্যাতিত হবে? এই নিয়ে সালিশ ডেকে মীমাংসা করে দেয়া হয়। তার পরেও মাঝে মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত। ফারিয়া এখন একটা কন্যাসন্তানের জননী। মেয়ে এখন হাঁটতে পারে। আর একটা বেবি পাঁচ মাস গর্ভে। এরই মধ্যে শুরু হয় পুরনো কাহিনী। যৌতুক চাই। এটা নিয়ে বহু সালিশ হয়, কোনো সমাধান হয় না। ভাইয়েরাও তেমন কেয়ার করে না। ফারিয়া নিজ থেকে স্বামীকে তালাক দিয়ে চলে আসে। এসে উঠে বাল্যকালের এক বান্ধবীর বাসায় কক্সবাজার সদরে। সেখানে বান্ধবীর বাসায় থেকে কিছুদিন অন্যের বাসায় বাসায় কাজ করে চলেন। পরের বাসায় আর কয়দিন বা থাকা যায়? তারও তো স্বামী আছে। সেই কিছু বলছে না সামনা সামনি, আড়ালে হয়তো বলছে। এই ভেবে সদরের বস্তি বাড়িতে ছোট্ট একটা বাসা নেয় ফারিয়া। সেখানে থেকে পাশের এক মহিলা ফেরিওয়ালীর সাথে দেখা হয়। তার পরামর্শে আয়ের কোনো পথ না পেয়ে ফেরিওয়ালীর কাজে নেমে পড়ে ফারিয়া। ছোট মেয়ে তখন পেটে, সাত মাস পেটে বাচ্চা নিয়ে মাথায় হরেক রকমের কসমেটিক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ফারিয়া। ফারিয়া এখন ফেরিওয়ালী। বেশ ভালোই চলছে। এভাবে জীবনযাপন ফারিয়ার। এখন দুই মেয়ে এই নিয়ে ফেরিওয়ালীর সংসার।
সবাই এখন ফারিয়াকে ফেরিওয়ালী বলে চেনে।


আরো সংবাদ



premium cement