২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভার্সিটির ছোট ভাই

-

টমাস, নিজের দেয়া নাম। বাবা-মা নাম রেখেছিল টিটো মোহাম্মদ সগীর। তিন শব্দের আদ্যাক্ষর মিলিয়ে ‘টিমোস’ হয়। সেটাকে একটু মডিফাই করে টমাস করে নিয়েছে। ভার্সিটিতে সে টমাস ভাই নামে পরিচিত। নাম শুনে প্রথমে সবাই একটু অবাকই হয় বটে। প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশী তো? পরে যখন নামের গল্পটা জানানো হয়, তখন আর বিস্ময় থাকে না কারো। হিসেবটা জলের মতো মিলে যায়। কিন্তু টমাসের ক্যারেক্টার বা চরিত্র বলতে যা বোঝায় তার সমীকরণ আর মেলে না।
টমাস যখন এ ভার্সিটিতে প্রথম আসে বিভিন্ন সময় র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়েছে। বলতে গেলে গোটা ফার্স্ট ইয়ার তার র‌্যাগিংয়ের ওপর কেটেছে। অবশ্য কিছু র‌্যাগিংয়ের শিকার সে নিজের দোষেই হয়েছে। কারণ, তার বাচনভঙ্গি মোটেও নিয়ন্ত্রিত ছিল না। যখন যা মুখে আসত তাই বলে বসত। ছোট-বড় কোনো ভেদাভেদ ছিল না। ভার্সিটির সিনিয়র ভাইদের যতটুকু সম্মান করে কথা বলা উচিত, সেই সম্মানবোধটুকু তার মধ্য থেকে বের হতো না, বরং তার লক্ষ্য থাকত সব সময় সব স্থানে জয়ী হওয়া, যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক হোক। কেউ এক কথা শোনালে পাল্টা সে তিন কথা বলে বসত। কিন্তু ভার্সিটির বড় ভাইদের সামনে তো আর এসব চলে না। ব্যস, শুরু হতো র‌্যাগিং। একবার এক সিনিয়র ভাইয়ের সাথে এমন বেয়াদবি করার কারণে ওই সিনিয়র ভাই তাৎক্ষণিক কিছু না বলে রাতে টমাসকে তার রুমে ডাকলেন। রুমে ডেকে সিডি প্লেয়ারে গান ছেড়ে দিয়ে বললেন, এবার নাচ। যতক্ষণ গান চলবে ততক্ষণ নাচতে হবে। নাচ থামালেই শাস্তি। রুমের বাকি সদস্যরাও সব সিনিয়র। তারাও হুমকি দিয়ে বলল, নাচ ব্যাটা। টমাস বাবু এবার নিরুপায় হয়ে নাচ শুরু করল। নাচের মধ্যে কেউ তার টি-শার্ট ধরে টানছে, কেউ লুঙ্গি। এক বড় ভাই আবার মোবাইলে ভিডিও করছে। এভাবে ঘণ্টাখানেক পর টমাসকে ছেড়ে দেয়া হয়। টমাস তো ক্ষেপে লাল হয়ে নিজের রুমে আসে। কিছু করার নেই তার। কারণ সে ফার্স্ট ইয়ার। সবাই তার সিনিয়র। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ফুলে-ফেঁপে হিংস্র বাঘের মতো হুঙ্কার করে সে, যে হুঙ্কার আর বাইরে আসার সুযোগ নেই।
অন্য এক দিনের ঘটনা হলোÑ টমাস মাস্টার্সের এক বড় ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে যা-তা বলে অনেক গালাগাল দিয়ে কথা বলল। সেই বড় ভাইয়ের রুমমেট আবার তা শুনে ফেলে। সে গিয়ে বড় ভাইকে সব বলে দেয়। এবার তার রুমে ডাক পড়ে টমাসের। টমাস তো প্রথমে অস্বীকার করে। ডাকা হলো যাদের সামনে গালি গিয়ে কথা বলেছে তাদের। টমাসের সামনেই তারা বলে দিলো সত্য কথা। টমাস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাস্টার্সের বড় ভাই বললÑ আয় কাছে আয়, তোরে আজ একটু অন্য রকম শাস্তি দেই। তোকে তো অনেকেই র‌্যাগিং করেছে। তোর তো লজ্জা নেই। বড় ভাই এবার একটা মোটা বই বের করলেন। মোটা মোটা দু’টি খাতা বের করে টমাসের সামনে রাখলেন। বললেনÑ এই বইতে প্রশ্ন আর উত্তর দাগানো আছে। গোটা বইতে যতগুলো প্রশ্ন আর উত্তর দাগানো আছে সবগুলো এই দুই খাতায় তুলতে থাক। আমি পড়ার সময় যদি ভুল পাই তবে তোর ডাবল শাস্তি। টমাস সেদিন ভোর পাঁচটা পর্যন্ত এ কাজ শেষ করে ছুটি পেয়েছিল। গোটা ফার্স্ট ইয়ারে টমাস এমন ছোট-বড় শতাধিক রাগিংয়ের শিকার হয়েছে।
টমাস যখন সেকেন্ড ইয়ারে। ক্যাম্পাসে বেশ পরিচিতি বেড়েছে। যাদের দ্বারা সে র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়েছিল তারাসহ আরো অনেক বড় ভাইদের সাথে সখ্য গড়ে উঠেছে। অনেক ছাত্রনেতাদের সাথে দহরম-মহরম হয়েছে বেশ। সে বছর ফার্স্ট ইয়ারের অ্যাডমিশন শেষে যখন কাস শুরু হয়ে গিয়েছিল। ফার্স্ট ইয়ারদের দেখে টমাসের বুকে জেগে ওঠে র‌্যাগিংয়ের পুরনো ক্ষত। এই ক্ষত কমাতে সে নিউ কামার অর্থাৎ ফার্স্ট ইয়ারদের টার্গেট করে। শতাধিক র‌্যাগিংয়ের শিকার হওয়া টমাস এবার নিজে র‌্যাগিং করা শুরু করে। তবে ধরনটা একটু আলাদা। ফার্স্ট ইয়ারের কোনো ছেলে আর মেয়েকে কোথাও একসাথে বসে গল্প করতে দেখলেই টমাস হাতে একটি সিগারেট নিয়ে তাদের কাছে যেত। প্রথমে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করত ম্যাচ আছে? ম্যাচ? ছেলেটি তো হতবাক! ভার্সিটিতে সে ম্যাচ দিয়ে কী করবে! আর এভাবে ক্যাম্পাসে কেউ ম্যাচ চায়? ছেলেটি যখন উত্তর দিতÑ না তো ভাই, ম্যাচ নেই। অমনি শুরু হয়ে যেত চড়-থাপ্পড়। ম্যাচ নেই মানে? ভার্সিটিতে আসো, একটা ম্যাচ নিয়ে আসবা না। মানে অহেতুক ভার্সিটির ছোট ভাইদের র‌্যাগিং করার জন্যই টমাসের এই সাজানো নাটক। এরপর মেয়েটিকে উদ্দেশ করে শুনিয়ে দিত কিছু বাজে কথা। সেকেন্ড ইয়ারে খুব একটা কাস করা হয়নি তার। ক্যাম্পাসে ঘুরত আর র‌্যাগিং করে বেড়াত।
একদিনের ঘটনা এমনÑ ফার্স্ট ইয়ারদের জন্য নির্ধারিত বাসে ছেলে-মেয়েরা নিজেদের কলেজ ব্যাগ রেখে আসন দখল করে নিচে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। বাস ছাড়ার সময় হয়নি তখনো। টমাস সে বাসে উঠে একজনের ব্যাগ সরিয়ে বসে পড়ল। এবার যার ব্যাগ ছিল সে এসে বললÑ ভাই সিটটা তো আমার। ব্যাগ রেখে দিয়েছি দেখেননি। টমাস এবার ক্ষেপে যায়। ব্যাগ দিয়ে বাসে জায়গা দখল করার কোনো নিয়ম আছে নাকি? কে করেছে এই নিয়ম? এভাবে এক কথা দুই কথায় লেগে যায় ছোট ভাইদের সাথে। টমাস এবার রেগে গিয়ে যারা যারা ব্যাগ দিয়ে বাসে জায়গা রেখেছিল সবার ব্যাগ জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। শুরু হয় ভীষণ হট্টগোল। টমাস ফোন দিয়ে বন্ধুদের ডাকে। একপর্যায়ে ছোট ভাইদের রোষানলে পড়ে টসাম পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবু থামেনি টমাস। তার র‌্যাগিং চলতেই থাকে। তত দিনে ভার্সিটির অনেক ছোট ভাইকে সে নানা অজুহাতে চড়-থাপ্পড় মেরেছে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, কোথাও কারো সাথে কথাকাটাকাটি বা মতের অমিল হলে টমাসের বক্তব্য ছিলÑ ‘ভার্সিটির ছোট ভাই হলে দেখিয়ে দিতাম।’
এই টমাস পড়াশোনা শেষ করে চাকরির চেষ্টা না করে ঢাকায় একটা কোচিংয়ে পড়ানো শুরু করে। কিন্তু ভার্সিটির সেই অভ্যেসগুলো এখনো ছাড়তে পারেনি। কোচিংয়েও সহকর্মীদের সাথে মতের অমিল হলেই বলেÑ আপনি আমার ভার্সিটির ছোট ভাই হলে বুঝিয়ে দিতাম। একদিন এক রিকশাচালকের সাথে ভাড়া নিয়ে কথাকাটাকাটি শুরু হলো। সেখানেও একপর্যায়ে টমাস বলে বসলÑ তুই যদি আমার ভার্সিটির ছোট ভাই হতি তবে দেখিয়ে দিতাম। ‘ভার্সিটির ছোট ভাই’ রীতিমতো তার ডায়ালগে পরিণত হয়েছে।
এবার ঘটল আসল ঘটনা। টমাস চাকরি করবে না বলে আগেই পরিবারকে জানিয়ে দিয়েছিল। ইতোমধ্যে ঢাকার কোচিংয়ে পড়িয়ে তিন বছর পার করে দিয়েছে সে। পরিবারের সবাই তাই সিদ্ধান্ত নিলো টমাসকে বিয়ে দেয়ার জন্য। বিয়েশাদির কথা শুনলেই সে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। পরিবারের সবাই মিলে তাই টমাসের অগোচরেই মেয়ে দেখে পছন্দ করে রেখেছে। ঈদের ছুটিতে যখন সে বাড়ি গেল, পরিবার, আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে চেপে ধরল টমাসকে বিয়ে করাবেই। টমাসের বাবা এসে বললÑ মেয়ে আমরা দেখে রেখেছি। চাকরি-বাকরি যখন করবি না, ব্যবসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিস। চাকরির বয়সও তো আর বেশি নেই। তাই ভালো পরিবারের একটা মেয়ের খোঁজ পেয়েছি। সবাই মিলে তোর বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোর মতামতের কিছু নেই। আমরা যা বলব তাই হবে। বাবার কথা শুনে টমাসের তো মাথা গরম। উত্তেজিত হয়ে সে বলতে শুরু করেÑ আমার মতামত ছাড়াই তোমরা আমার বিয়ে দিচ্ছো! আমি তো বলেছি নারীদের প্রতি আমার কোনো বিশ^াস নেই। বিয়েশাদি করব না। টমাসের বাবা এবার রেগে কষে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন টমাসের গালে আর বলতে লাগলেনÑ তোর মাও তো একজন নারী। তাকে বিশ^াস করিস না তুই? টমাস নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেÑ তুমি যদি আমার ভার্সিটির ছোট ভাই হতে তবে বুঝিয়ে... এ পর্যন্ত বলে জিভ কাটে টমাস। মনে মনে বলেÑ হায়! হায়! কাকে কী বলছি। উপস্থিত আত্মীয়স্বজন সবাই অট্টহাসি দিয়ে বলতে লাগলÑ টমাস, শেষ পর্যন্ত বাবাকেও ভার্সিটির ছোট ভাই বানাতে চাইছো!


আরো সংবাদ



premium cement