২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চিকন আলীর চিকনা বুুুদ্ধি

-

গল্পটার নাম হতে পারত, ‘অ্যাই ব্যাটা আনিচ্ছা! তুই চা আনিচ্ছা!’ ঢের সম্ভাবনাও ছিল। প্রতিযোগিতায়ও টিকে থাকার যথেষ্ট মালমসলা ছিল। কিন্তু শেষঅব্দি তা আর হয়ে ওঠেনি। প্রতিযোগিতায় তুমুল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ও স্নায়ু টানটান উত্তেজনা শেষে ওপরের শিরোনামটাই কাফি হয়েছে। বাদ পড়েছে, ‘অ্যাই ব্যাটা আনিচ্ছা! তুই চা আনিচ্ছা!’ এদিকে বহাল তবিয়তে টিকে গেছে, ‘চিকন আলীর চিকনা বুদ্ধি!’ হাহাহাহা...
বাহ! বৈচিত্র্যময় মারাক্তক একখান শিরোনাম-ই বটে! চিকন আলীর নির্ঘাৎ অস্কার (আপাতত ঙঝঈঅজ কোমল পানীয় হলেও চলবে) পাওয়ার যোগ্য। যাহোক প্যাঁচাল বাদ দিয়ে মূলগল্পের ভেতরে সরাসরি এগোনো যাক-
সাতসকালে চিকন আলী ঘর থেকে বের হতে না হতেই পেছন থেকে বউয়ের হাঁকডাক ও চেঁচামেচি শুরু হয়। ঝগড়া রাতেও একদফা হয়ে গেছে। চরম বিরক্তি নিয়ে চিকন আলী পেছনে ফিরে তাকায়।
‘অ্যাই, সবসময় তুমি পেছন দিক থেকে কুফা লাগাও ক্যান? তোমার সমস্যাটা কী?’
‘খবরদার বলছি! একদম চোখ রাঙিয়ে কথা বলবে না। তুমি নিজেই একটা মস্তবড় কুফা! বড়সড় একটা সমস্যা!’
‘কী বলছো তুমি!’
‘ঠিকই বলছি,তুমি একটা ইতর! চরম বদমাশও!!’
ব্যস্ত মুহূর্তে তুমুল ঝগড়া বেধে যায় চিকন আলী ও মেহেরজান বিবির মধ্যে। অবশ্য সকাল-রাতে দু’প্রস্থ ঝগড়া-বিবাদ না হলে তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। এেেত্র মেহেরজান বিবি দু’কাদি ওপরে। পান থেকে চুন খসলেই স্বামীর সাথে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। নতুন করে কোনো অজুহাত তৈরি করা লাগে না। তার শনির গ্রহটা সবসময় বিপদসীমার কাছাকাছি থাকে।
‘মনে রেখ, রাতে ফেরার সময় চিকন চাল আনতে হবে, মেয়ে জামাই আসবে। সে খবর তোমার আছে?’
চিকন চাল! ভ্রƒ কুচকে ওঠে চিকন আলীর। বউটা তাকে খোচা দিলো নাতো? প্রচণ্ড রাগে ঘৃণায় গজরগজর করতে করতে চিকন আলী বেরিয়ে পড়ে।
আজকাল খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। কথাটা মোটেও অমূলক কিছু নয়। একদম খাঁটি সত্যি কথা। খরচের লাগাম টেনে ধরাটাই এই যুগে ফ্যাক্ট। ব্যবসাপাতি যাই হোক খরচ বাজে খরচের মাত্রাটা রিক্টার স্কেলে দিনদিন বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন সকালে ঘরের দরজা খোলার পর থেকে আবার রাতে দরজা বন্ধ করা অব্দি খরচের বহর ডেমু ট্রেনের মতো চলছে তো চলছেই। ননস্টপ চলতেই থাকে। অনেকটা রেললাইনের পাশে থাকা ঘাস খাওয়া গরুর মতো। রেলগাড়ি যায় আর আসে, গরু ঘাস খাচ্ছেতো খাচ্ছেই। কী এলো কী গেলো সেদিকে ভ্রƒপে করার জো নেই। দিনশেষে প্লাস-মাইনাস পর্ব সারিয়ে দেখা যায়, লাভের ঝুলিতে বড় বড় দু’টো আণ্ডা! অর্থাৎ শূন্য! সশ্রম পরিশ্রম পরিণত হয় পণ্ডশ্রমে!! দিনভর বেগার ঘেটে সবশেষে আমছালা দু’টোই যায়। এই সত্যটা চিকন আলী খুব দেরিতে হলেও বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। মানুষ অবশ্য ঠেকে শেখে। চিকন আলীরও হয়েছে তাই। যদিও চিকন আলী বেশ সগর্ভে মানুষকে বলে বেড়ায়, ‘এই চিকন আলীকে ঠকানো অত্তো সহজ ব্যাপার নয়, মাগার আমি চিকন আলী কইলাম, আমার বুদ্ধিশুদ্ধিও চিকনা!’
স্থানীয় বাজারের খুপড়ির মতো দু’রুমের ছোট্ট একটা দোকানঘর চিকন আলীর। ওষুধের ফার্মেসি। ডিএমএস ডিগ্রিধারী দূরের একজন পৌঢ়া বয়স্ক ডাক্তার বসে চেম্বারের এক রুমে। অন্য রুমে ফার্মেসি। সপ্তাহে তিন দিন বসেন ডাক্তার মশাই। শনি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার। বেচাবিক্রি বেশ ভালোই জমে। কিন্তু নানারকম পরিচিতজন ও আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে বাজে খরচটা একটু বেড়েই যায়। রোগীদের একটু হালকা চা-টা আপ্যায়ন অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক সময় করতে হয়। তার ওপর রয়েছে বাকিতে বিক্রি! এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। সেরের ওপর সোয়া সের!! মফস্বলের দোকানপাটে এই এক নিত্য সমস্যা। সবাই মুখচেনা বা পরিচিতজন। কাকে রেখে কাকে বাদ দেয়া যায়? কেউ চাচা, কেউ বলে আপন প্রাণ বাঁচা। কেউ খালু, কেউবা মালু। কেউ খালা, কেউ আবার বেয়াইনের বোন মালা! বেজায় সমস্যা। উত্তরণের পথ নেই। পালাবি কোথায়? কম্বলের লোম বাছতে গেলে শেষ পর্যন্ত কম্বলই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। শহরকূলে আবার এই জটিলতা বিলকুল নেই। সবাই নগদে কেনে। গিভ অ্যান্ড টেক সিস্টেম। গ্রাম্য একটা কথা চালু রয়েছে, ‘বাকিতে মাল দেয়া আর চোরে নেয়া একই কথা!’ বুঝুন ঠ্যালা!! চিকন আলী ভেবেই কূল সারা। সারাণ ভেবে ভেবে হয়রান। ঘরে আজ জামাই তো কাল বেয়াই-বেয়াইন! ফেবিকলের মতো খরচের বহর লেগেই থাকে। তাই বলে দোকানেও! বাজে খরচের লাগামটা কিভাবে শক্তহাতে ধরা যায়, কোন পন্থায় কিভাবে কমানো যায় অযাচিত খরচের লম্বা বহরটা-এই নিয়ে সে প্রতিনিয়তি ভাবছে। এমন একটা জুতসই পন্থা খুঁজে বের করা দরকার যেন, সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে! এরি মধ্যে চিকন আলীর দূর সম্পর্কিত ভাগ্নে আনিছের কথা মনে পড়ে যায়। মুহূর্তেই চেহারায় কিছুটা খুশির রেখাচিত্র ফুটে ওঠে। মনে মনে বলে, ইয়েস, ইউরেকা! ইউরেকা!! আনিছ বেশ শক্তপোক্ত চৌকস ও চালাক চতুর ভদ্র একটা ছেলে। চিকন আলী অনেক ভেবেচিন্তে আনিছকে দোকানে নিয়োগ দিবে বলে মনস্থির করে। তা ছাড়া ফার্মেসিতে এমনিতেই একটা ছেলের প্রয়োজন দীর্ঘদিন থেকে ছিল। কিন্তু হুটহাট যে কাউকে ধরে এনেতো কোনো প্রকার বাছবিছার ছাড়া দোকানে বসিয়ে দেয়া যায় না। সততা ও বিশ্বস্ততার একটা ব্যাপারস্যাপার রয়েছে। আজকালকার যুগে সুযোগ পেলে বেড়াও তে খায়, পুতুলও হা করে বসে থাকে জিনিসপাতি গেলার জন্য। মানুষ এখন মনিষ্যি নেই। মনুষ্যত্ববোধ এখন কাগজেকলমে, নিরেট বাস্তবতার চোরাগলিতে এসব আতশকাচ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকটা ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেইয়ের মতো।
অবশেষে চিকন আলীর মুখে অস্বস্তির বাতাবরণ কেটে গিয়ে স্বস্তির হাসি ফুটেছে। ফার্মেসিতে আনিছকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তার চিকনা বুদ্ধিতে সুফলতাও আসতে শুরু করেছে। আমাদের সমাজে নাম বিকৃতি করে ডাকার একটা প্রবণতা প্রথম থেকেই রয়েছে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এই প্রবণতাটা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় লণীয়। নাম বিকৃতি করার দু’টো অর্থ থাকতে পারে। এক. কেউ আদর করে ভালোবেসে নাম বিকৃতি করে। দুই. কেউবা হিংসাত্মক মনোভাব নিয়ে কিংবা পর্যাপ্ত শিার অভাবে আরেকজনের নাম বিকৃতি করে বেড়ায়। দেখা যায়, অনেক বাবা-মাও সন্তানকে আদর করে নাম বিকৃতি করে ডাকে। যাহোক, আনিছ নামটা বরাবরি খুব সুন্দর অর্থবহ একটা নাম হলেও আনিছকে বেশির ভাগ সময়ে ‘আনিচ্ছা’ বলেই লোকসমাজে ডাকাডাকি করা হয়। এটা পরিবার থেকে শুরু করে সর্বত্রই চলে আসছে। ওদিকে চিকন আলী আনিছের এই বিকৃত নামের সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে বেশ ভালোভাবে। আনিছও বাধ্য ছেলের মতো কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নানারকম ফুটফরমায়েশও খেটে যেতে লাগলো। ছেলেটা বেশ চালু মাল, বুঝাই যাচ্ছে। চিকন আলী চিকনা বুদ্ধি মোতাবেক আনিছকে সবকিছু ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। চিকন আলী বলেছে, ‘দ্যাখ বাবা আনিছ, ব্যবসার খাতিরে বহু লোকজন ফার্মেসিতে আসা-যাওয়া করবে এটাই স্বাভাবিক। এদের বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে পরিচিতজন কিংবা নিকট আত্মীয়স্বজন। সঙ্গত কারণে, আদর আপ্যায়নের একটা ব্যাপারস্যাপার রয়েছে। কিন্তু আমি প্রত্যেকের পেছনে এভাবে দেদারসে খরচপাতিও করতে পারি না। নইলে আমার ব্যবসা দু’দিনে লাটে উঠবে। তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি চলে যেতে হবে। ব্যবসাকে ব্যবসার মতোই চালাতে হয়। তবুও আমি ব্যবসার স্বার্থে প্রত্যেকের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্কটাই বজায় রাখব। মুখে মুখে সবাইকে চা-টা, আদর আপ্যায়ন সবি করাব। এমনকি তোকে বলবোওÑ‘অ্যাই আনিছ, চা আনিস।’ কখনো কখনো লোকভেদে এককাপের জায়গায় দু’কাপ-চারকাপও হতে পারে। কিন্তু আমি এটুকুই বলেই ান্ত দিবো। মাগার তুই তোর কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকবি। খবরদার! একটুও নড়চড় করবি না। তুই উল্টোটা বুঝবি, অর্থাৎ ‘অ্যাই আনিচ্ছা, চা আনিচ্ছা!!’ ব্যস আপ্যায়নও হলো, খরচও বাঁচলো!! আমি অবশ্য মাঝে মধ্যে দোকানে ভিড় বুঝে তোকে পুনঃতাগাদাও দিব। যেন তোকে বাইরে যেতে না হয়। তুই নিশ্চিতভাবে বুঝে নিবি তোকে সত্যি সত্যি চা আনতে বলিনি। বিশেষত পরিচিত আত্মীয়স্বজনকে মুখে মুখে চা-টা ছাড়াও আরো কত কী খাওয়াব। কিন্তু এসবি হবে মুখে মুখে। মাগার তুই তোর কাজের দিকেই মনোযোগী হবি। এতে অবশ্য আমার দিক থেকে রোগীদের আদরযতœ ও আপ্যায়ন করার প্রচেষ্টাটাও সফল হবে, একই সাথে মাসে মাসে আমার বাজে খরচের টাকাটাও বেঁচে যাবে! স্মরণ রাখিস, এটাই হলো তোর মামা চিকন আলীর চিকনা বুদ্ধি!!

 


আরো সংবাদ



premium cement
অনির্দিষ্টকালের জন্য অনলাইন ক্লাসে যাচ্ছে জবি, বন্ধ থাকবে পরীক্ষা কুড়িগ্রামে রেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ ক্রিকেট খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে দেওয়ানগঞ্জের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শিহাব কিশোরগঞ্জে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ সাতক্ষীরা বৈদ্যুতিক খুটিতে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেলআরোহী নিহত বার্সেলোনাতেই থাকছেন জাভি চতুর্থ দফা ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি : এবারের তাপদাহ শেষেই বৃষ্টিপাতের আশা ফরিদপুরে বৃষ্টির জন্য নামাজে হাজারো মুসুল্লির কান্না পোরশার নোচনাহারে আগুনে ৩টি দোকান পুড়ে গেছে খুলনা বিভাগ ও ৬ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ ‘১ টাকার কাজ ১০০ টাকায়, ৯৯ যায় মুজিব কোটে’

সকল