২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সুরমা ও ধনু নদীর বাঁকে বাঁকে মানুষ মারার ফাঁদ

সুরমা নদীতে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা ঘের  -

সুনামগঞ্জের সুরমা ও ধনু নদীর বাঁকে বাঁকে মাছ শিকারের জন্য গাছের ডাল-বাঁশ পুঁতে বছরের পর বছর মাছ ধরার ঘের তৈরি করে প্রায় ৫০ কিলোমিটার নদী দখল করে নিয়েছে নদী তীরের কিছু প্রভাবশালী। মাছ ধরার নামে এই পদ্ধতিগুলো মানুষ মারার ফাঁদে পরিণত হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। বাশের তৈরি ঘেরগুলোর কারণে সুরমা-ধনু নদী দিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে লঞ্চ, কার্গো, যাত্রবাহী নৌযান প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। গত কয়েক বছরে অসংখ্য লঞ্চ ও নৌদুর্ঘটনার মধ্যে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে জেলার জামালগঞ্জ অংশের আলীপুর নদীর বাঁকে বাঁশের এই ঘেরের কারণে পাথরবাহী ভলগেট নৌকার সাথে ধাক্কা লেগে যাত্রীবাহী ট্রলার ডুবে ৪৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। এ ছাড়াও প্রতি বছরই ঘেরের কারণে ছোটখাটো নৌদুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সুরমা-ধনু নদীর দুই পাড়ে এভাবে ‘বাঁশ-কাঁটা’ স্থাপনের কারণে শত শত শত জেলে উন্মুক্ত নদীতে মাছ ধরতে না পারায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কোনো কোনো স্থানে নদীতে বেশি বাঁশ পুঁতে রাখার কারণে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে পলি জমে নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। চৈত্র-বৈশাখ মাসে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এলাকার ফসল রক্ষা বাঁধগুলো উপচে হাওরাঞ্চলের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার কারণগুলোর একটি হচ্ছে এটি। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ-ভৈরব নদীপথে কার্গো, লঞ্চ, বাল্ক হেড, যাত্রীবাহী ট্রলার চলাচলেও মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। হাওরে বেশ কয়েক দিন ঘুরে এই নদীপথে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার লালপুর, লক্ষ্মীপুর, রামপুর, জামলাবাজ, গজারিয়া, কামধরপুর, আলীপুর, আমানীপুর ও বিষ্ণুপুর এবং ধর্মপাশা উপজেলার গোলকপুর, বাবুপুর, চাদরা, শয়তানখালী ও সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনার মিলনস্থলে খালিয়াজুরী উপজেলার নাউটানা, জগন্নাথপুর, আসাদপুর, রাজীবপুর, লিপ্সাবাজার, শিবির, শালদিঘা, হারাকান্দি, পাথরা ও মোহনগঞ্জ উপজেলার গাগলাজুর বাজার, মান্দারবাড়ী, গাগলাজুর নতুন বাজার সীমানা এলাকার প্রায় ৫০ কিলোমিটার নদীপথের এমন চিত্র দেখা দেখা গেছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যথাযথ তদারকি না থাকায় এই নদীপথে অবৈধ দখলদারিত্ব দিন দিন প্রতিযোগিতামূলক বেড়েই চলেছে। এলাকাবাসী জানায়, মাছ শিকারের জন্য উন্মুক্ত নদীটি দখল করে ‘মাছ ধরার ঘের’ তৈরি করতে নদীতীরবর্তী এলাকার প্রভাবশালী মহল বর্ষার শুরু থেকেই লাখ লাখ টাকার গাছের ডাল ও বাঁশ-কাঁটা সংগ্রহ করে রাখে। বর্ষার পানি কমার সাথে সাথে ওই সব ডাল নদীতে ফেলে বেশির ভাগ নদীজুড়ে বাঁশের খুঁটি পুঁতে ঘেরাও করে দখলে রাখে নদীর কিছু সীমানা। জামালগঞ্জের ফেনারবাঁক ইউনিয়নের অনিল বর্মণ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ও সাংবাদিক ভাই, লেইখ্যা কী লাভ’ কাম অইবনি। আমরা জালুয়ারার (জেলে) কথা লেইখ্যা কিতা অইব! গাং তো (নদী) ধনী লোকরার দহলেই আছে।’ হরি দাস বর্মণ বলেন, ‘আমরার পূর্বপুরুষের পেশা ছাইড়া অন্যের বাড়িতে কামলা দিয়া কোনো রহমে সংসার চালাইতাছি।’ যারার টেকা-পয়সা আর লাটি শক্তি আছে হেরাই অহন জালুয়ারার (জেলে) নাম ধইরা গাং (নদী), বড় বড় বিল (জলমহাল) দখল কইরা রাখছে। একই মন্তব্য করেন আমানীপুর গ্রামের জেলে জয় মোহন বর্মণ, সমের বর্মণ, রানা বর্মণসহ অনেকেই।

গজারিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষক অলী বলেন, ‘১৫-২০ বছর আগেও এই সুরমা ও ধনু নদী দিয়া বড় বড় লঞ্চ, স্টিমার, কার্গো, যাত্রীবাহী নৌযান চলত। খননের অভাবে এমনিতেই নদী ভরাট হইয়া গেছে। আর এহন, মাছ ধরার লাগি প্রভাবশালীরা গাছের ডাল ফালাইয়া বাঁশ-কাঁটা দিয়া নদীডারে আরো ধ্বংস কইরা দিতাছে। মালবোঝাই বড় নৌকাও ঠিকমতো চলতে পারতেছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘ সুরমা ও ধনু নদী ভালা কইরা খনন ও অবৈধ দখলমুক্ত করতে পারলে, হাওরের বাঁধ রক্ষাসহ মাছ নিয়া কোনো চিন্তা করা লাগবো না।’ এই নৌপথে চলাচলকারী ‘এমভি লাল সাহেব’ লঞ্চের এক কর্মচারী বলেন, ‘নদীটি খননের অভাবে এমনিতেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আবার এলাকার প্রভাবশালীরা নদীর দুই পাড়ে বাঁকে-বাঁকে বিশাল জায়গাজুড়ে কাঁটা দিয়ে নদীটিকে আরো সরু করে ফেলেছে। এতে এই নৌপথে লঞ্চ-কার্গো চালাতে আমরা বাধার মুখে পড়ি। রাতের বেলা অনেক সময় দিক নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয়।’ অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করাসহ নদীটি দ্রুত খনন করার দাবি জানান তিনি। ‘এমভি ড্রিম অব মশিউর’ কার্গোর মালিক মাহাবুবুল আলম বলেন, নদী থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদসহ নদীটি দ্রুত খনন করা না হলে দু-তিন বছরের মধ্যেই এ নৌপথে মালবাহী কার্গোসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সুনামগঞ্জের ছাতক থেকে ভৈরব পর্যন্ত নদী তদারকির দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএর পাইলট ইন্সপেক্টর মো: শহীদ মিয়া বলেন, নদী থেকে অবৈধ ‘বাঁশ-কাঁটা’ সরিয়ে নেয়ার জন্য একাধিকবার নোটিশ করার পরও তারা তা সরিয়ে নেয়নি। তবে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে এ ব্যাপারে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিআইডব্লিউটিএর আশুগঞ্জ-ভৈরব বাজার নদীবন্দরের উপপরিচালক মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই নদী থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে শিগগিরই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে।

জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আল-ইমরান নয়া দিগন্তকে বলেন, এগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, ভারতের মেঘালয় থেকে উৎপন্ন হওয়া সুনামগঞ্জের যাদুকাটা ও ধোমালিয়া নদী সমতল ভূমিতে নেমে এসে সুরমা নদীর পশ্চিমমুখী শাখার সাথে মিলিত হয়ে ধনু নাম নিয়ে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়েছে দক্ষিণ দিকে। সুনামগঞ্জে সুরমা ও জামালগঞ্জ সদর থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরীর বিভিন্ন এলাকা হয়ে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে মেঘনায় মিলিত হওয়া এই অংশটি কোথাও বৌলাই কোথাও ধনু নামে পরিচিত। নদীতে শুকনো মওসুমে কোনো কোনো অংশে বড় নৌকা চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়।


আরো সংবাদ



premium cement