২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঈদে ঘুরে আসুন প্রকৃতির কন্যা মৌলভীবাজারে

-

পবিত্র ঈদুল আযহার ছুটেতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি প্রকৃতির কন্যা মৌলভীবাজার জেলার অবস্তানরত আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট গুলো ঘুরে আসুন। আপনাকে বরণ করতে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে এক অপার লীলাভূমি টিলাঘেরা সবুজ চা বাগান, কুলাউড়ার মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল, কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, ত্রিপুরা সীমান্তবর্র্তী ধলই চা বাগানে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, ছায়া নিবিড় পরিবেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি মাধবপুর লেক, সীমান্তবর্তী ঝর্নাধারা হামহাম জলপ্রপাত, হ্রদ ও গলফ মাঠ, শিল্পকলা সমৃদ্ধ মণিপুরীসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভিন্ন জাতিসত্তার জীবন ধারা ও সংস্কৃতিসহ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই জনপদ যে কোন পর্যটকের মন ও দৃষ্টি কড়ে নেবে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঃ
দেশের ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে অপার লীলা ভূমি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মাঝে সবচেয়ে দর্শণীয়, নান্দনিক ও আকর্ষণীয়। পশুপাখি, বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাস স্থল। এ উদ্যানে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবুজ বৃক্ষরাজি। বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় জীব উলুকসহ কয়েকটি জন্তু ও বিলুপ্ত প্রায় কয়েকটি মূল্যবান গাছ গাছালির শেষ নিরাপদ আবাসস্থল হল লাউয়াছড়া। এই উদ্যান ভ্রমন পিপাষুদের জন্য এখন একটি আকর্ষনীয় স্থান। ১৯৯৬ সালে ১২৫০ হেক্টর এলাকা নিয়ে লাউয়াছড়াকে ঘোষণা করা হয় জাতীয় উদ্যান হিসেবে। ঢাকা থেকে প্রায় সোয়া ২শ’ কিঃমিঃ উত্তর পূর্বে লাউয়াছড়ার অবস্থান। ঢাকা থেকে সরাসরি ট্রেন অথবা বাসযোগে শ্রীমঙ্গল নেমে খুব সহজেই আসতে পারেন। সময় লাগবে আনুমানিক ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘন্টা। এছাড়া জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির প্রাণ বৈচিত্রের ভেতর ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরিসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির অর্কিড, ২০ প্রজাতির স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী এবং ১৭ প্রজাতির পোকামাকড় রয়েছে। আগর বাগান, বিরল প্রজাতির গাছ, নানা প্রজাতির পাখির ডাক, ছড়া, বনফুল, অর্কিড, চশমাবানর, বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় দূর্লভ উলুক এগুলো এই বনের বিশেষ আকর্ষন। এ বনের বিচিত্র পশু-পাখি ও পোকা মাকড়ের অদ্ভুত ঝিঝি শব্দ, বানরের ভেংচি, ভালুকের গাছে গাছে ছুটাছুটির দৃশ্য দেখতে ভাল লাগে। লাউয়াছড়া সম্পর্কে জানতে ও বনের অভিজ্ঞতা অর্জনে গাইড ছাড়াও উদ্যানে রয়েছে পর্যটকদের জন্য তথ্য কেন্দ্র, ইর্কো কটেজ, ইন্সপেকশন বাংলো, গোলঘর, ফেন্সিবীজ প্রভৃতি। নিসর্গের পরিবর্তে বর্তমানে আইপ্যাক (সমম্বিত রক্ষিত সহ-ব্যবস্থাপনা) কাজ করছে।
মাধবকুন্ড জলপ্রপাতঃ
প্রায় ২শ’ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের অবস্থান মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায়। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত এই স্থানটিতে বর্তমানে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের রেস্ট হাউজ ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে বেড়েছে পর্যটন সম্ভাবনা। এছাড়া সরকারি উদ্যোগে পুরো এলাকাটিকে ঘিরে তৈরি করা হচ্ছে ‘মাধবকুন্ড ইকোপার্ক’। শ্যামল সবুজ বনরাজি বেষ্টিত মাধবকুন্ড ইকোপার্ক, নয়নাভিরাম দৃশ্য, নান্দনিক পিকনিক স্পট, সুবিশাল পর্বতগীরি, পাহাড়ী ঝরনার প্রবাহিত জলরাশির কল কল শব্দÑসব মিলিয়ে মাধবকুন্ড বেড়াতে গেলে পাওয়া যায় বাড়তি মাত্রা।
প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটন ভিড় জমান এই ঝরনা ধারার সৌন্দর্য উপভোগে। মাধবকুন্ড থেকে ২০ মিনিটের দুরত্বে রয়েছে আরো একটি ঝর্ণা। এর নাম পরীকুন্ড। মাধবকুন্ড যাওয়ার উত্তম সময় হচ্ছে বর্ষাকাল, এই সময় ঝর্ণা পানিতে পুর্ণ থাকে। শীতকালেও এর সৌন্দর্য্যের কমতি হয় না। মাধবছড়াকে ঘিরেই খাসিয়াদের জীবনযাত্রা আবর্তিত হয়। ফলে আদিবাসী জীবনযাত্রা আর সংস্কৃতিও উপভোগ করা যাবে এখানে।
মাধবকুন্ড জলপ্রপাতে এলে চোখে পড়বে উচু নিচু পাহাড়ি টিলায় দিগন্ত জোড়া চা বাগান। টিলার ভাঁজে ভাঁজে খাসিয়াদের পানপুঞ্জি ও জুম চাষ। পাহাড়ীদের সনাতনী বাড়ি ঘর জীবনযাত্রা দৃশ্য সত্যিই অপুর্ব। মাধবকুন্ড অতীত থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান হিসাবে পরিচিত। প্রতি বছরের চৈত্র মাসে ভগবান মাধবেশ্বরের আশির্বাদ নিতে হাজার হাজার মানুষ এখানে আসে। এ সময় মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে পুণ্যার্জন ও বারুনী স্নান করে পাপ মুক্তির কামনা করেন তারা। মাধবকুন্ডে মাধবের মন্দির ছাড়াও রয়েছে শিব মন্দির। বিশালাকার শিবলিঙ্গ পুজা করাও হয়ে থাকে। চৈত্র মাসের ওই সময়ে বিশাল মেলা বসে।


বাইক্কা বিলঃ
বাইক্কা বিল, ঢাকা থেকে ২০০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে মৌলভীবাজার জেলার প্রখ্যাত চা-সমৃদ্ধ শহর শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরে পূর্বদিকের প্রায় ১০০ হেক্টর আয়তনের একটি জলাভূমির নাম। ১ জুলাই ২০০৩ তারিখে বাংলাদেশের ভূমি মন্ত্রণালয় এই বিলটিকে মৎস্য সম্পদের একটি অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। আইড়, কই, মেনি, ফলি, পাবদাসহ আরো অনেক প্রজাতির মাছ এখানে বংশবৃদ্ধি করে পুরো হাওর ছড়িয়ে পড়ে। এই বিল মাছের জন্যেই শুধু নয়, পাখি এবং অন্যান্য অনেক প্রাণীর জন্যও একটি চমৎকার নিরাপদ আবাসস্থল। এটি একটি নয়নাভিরাম জলাভূমি যেখানে হাজারো শাপলা আর পদ্ম ফুল ফোটে। এছাড়া এই বিলের বুনো বাসিন্দা আর শীতে আগত পরিযায়ী পাখিদের ভালোভাবে দেখার জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।
বিলের কিনারে ফোটে হাজারো পানা, শাপলা আর পদ্মফুল। বিলের পানিতে সকাল-সন্ধ্যা চলে রঙ্গীন ফড়িংয়ের বিরতিহীন উড়াউড়ি। বৃষ্টিহীন উষ্ণদিনে বিলের ফুলের পাশে আসে আরো একদল পতঙ্গপ্রজাতি। প্রকৃতি প্রেমীর চোখে পাখিই এই অভয়াশ্রমের সেরা প্রাণী। শীত মৌসুমে এখানে আসে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। এই বিলের উল্লেখযোগ্য পাখি- পানকৌড়ি, কানিবক, ধলাবক, গোবক, ধুপনিবক, রাঙ্গাবক, দলপিপি, নেউপিপি, পান মুরগি, বেগুনি কালেম, কালোমাথা কাস্তেচরা, শঙ্খ চিল, পালাসী কুড়া ঈগল। শীতের অতিথি হয়ে এই বিলে আসে অনেক জাতের সৈকত পাখি। এদের মধ্যে- গেওয়ালা বাটান, মেটেমাথা চিটি আর কালাপঙ্খ ঠেঙ্গী, ধলা বালিহাঁস, পাতি সরালী, রাজসরালী, মরচেরং, ভূতিহাঁস, গিরিয়াহাঁস, ল্যাঙ্গাহাঁস, গুটি ঈগল ।
বাইক্কা বিলে প্রতি বছর শীত মৌসুমে প্রচুর পরিযায়ী পাখির সমাগম ঘটে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের এক গবেষণায় বাইক্কা বিলে ২০৩টি প্রকার পাখি শনাক্ত করা হয়েছে যার মধ্যে পরিযায়ী পাখি ১৫৩টি এবং স্থায়ী বসবাসকারী পাখি ৫০টি। বাইক্কা বিলকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করায় পাখির সংখ্যা আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার অনেক বেড়েছে। দেশীয় ও পরিযায়ী পাখির চলাচল, গতিবিধি, পর্যবক্ষেণ ও পাখির জীবনাচরণের বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ এবং দীর্ঘমেয়াদি গবেষেণার জন্য পাখিদের পায়ে রিং পরানো হয়েছে।

মাধবপুর লেকঃ
কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরে নয়নাবিরাম মনোরম দৃশ্য মাধবপুর লেক ভ্রমন পিপাষু মানুষের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। এখানকার পাহাড়ি উঁচু নিচু টিলার মাঝে দৈর্ঘে প্রায় ৩ কিঃমিঃ পানির হৃদ ও তার শাখা প্রশাখা, চারপাশে পাহাড়ি টিলার উপর সবুজ চা বাগানের সমারোহ, জাতীয় ফুল দুর্লভ বেগুনী শাপলার আধিপত্য, ঝলমল স্বচ্ছ পানি, ছায়া নিবিড় পরিবেশ, শাপলা শালুকের উপস্থিতি আনন্দের বাড়তি মাত্রা যুক্ত করেছে। এক দিনেই মাধবপুর লেকের দৃশ্য উপভোগ করে বেরিয়ে এসে একই রাস্তায় প্রায় ১০ কিঃমিঃ যাওয়ার পরই বীর শ্রেষ্ট হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ ঘুরে আসা যাবে।

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধঃ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান আত্মোৎসর্গের কারনে বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করেছে। হামিদুর রহমানের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে তৎকালীন শ্রীমঙ্গলের ১৭ রাইফেল ব্যাটালিয়ন ধলই সীমান্ত ফাঁড়ি সংলগ্ন স্থানে শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান ‘বীরশ্রেষ্ঠ স্মরণী’ নির্মাণ করে। ২০০৬ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গণপূর্ত বিভাগ ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই চা বাগানে বিজিবি’র সীমান্ত ফাঁড়ি সংলগ্ন এলাকায় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। এখানে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক, দর্শনার্থী ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন এ স্মৃতিসৌধ দেখতে আসছেন। সকালে বের হলে লাউয়াছড়া ভ্রমণ শেষে মাধবপুর লেক ও বীরশ্রেষ্ট হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ ঘুরে আসা যাবে।

হামহাম জলপ্রপাতঃ
কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিঃমিঃ পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি বন রেঞ্জের কুরমা বনবিট এলাকার প্রায় ১০ কিঃমিঃ অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন হামহাম জলপ্রপাত। স্থানীয় পাহাড়ি অধিবাসীরা এ জলপ্রপাত ধ্বনিকে হামহাম বলে। তাই এটি হামহাম নামে পরিচিত। সেখানে সরাসরি যানবাহন নিয়ে পৌঁছার ব্যবস্থা নেই। কুরমা চেকপোস্ট পযর্ন্ত প্রায় ২৫ কিঃমিঃ পাকা রাস্তায় স্থানীয় বাস, জিপ ও মাইক্রোবাসে যেতে হয়। বাকি ১০ কিঃমিঃ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। সেখান থেকে প্রায় ৫ কিঃমিঃ দূরে সীমান্ত এলাকায় ত্রিপুরা আদিবাসী পল্লী। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা তৈলংবাড়ী কলাবন বস্তি থেকে পায়ে ঁেহটে রওয়ানা হতে হবে। প্রায় ৬ কিঃমিঃ পাহাড় টিলা ও ২ কিঃমিঃ ছড়ার পানি অতিক্রম করে ৩ ঘন্টা পায়ে হাঁটার পর ১৬০ ফুট উচ্চতার হামহাম জলপ্রপাতের দেখা পাওয়া যাবে। হামহাম জলপ্রপাত ভ্রমণ করতে একদিনের প্রয়োজন।
এছাড়াও ভ্রমণের জন্য রয়েছে মৌলভীবাজারের বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক, কমলগঞ্জে পাক বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের নিরব স্বাক্ষী বধ্যভূমি, ব্রিটিশদের শোষনের প্রতীক তিলকপুর নীলকুটি, ঘটনাবহুল মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ড, বর্নময় শিল্পসমৃদ্ধ মনিপুরী সম্প্রদায়সহ টিপরা, খাসি, গারো সমাজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এলাকা সমূহ।


আরো সংবাদ



premium cement