২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজু খুনের ঘটনায় এখনো ধরা পড়েনি কোনো ঘাতক

রাজু খুনের ঘটনায় এখনো ধরা পড়েনি কোনো ঘাতক - ছবি : সংগৃহীত

সিলেট নগরীর কুমারপাড়ায় ছাত্রদল নেতা ফয়জুল হক রাজু খুনের ঘটনায় এখনো কোনো ঘাতক ধরা পড়েনি। গত শনিবার রাতে সিলেট সিটির পুনর্নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণ শেষে ফেরার পথে নৃশংসভাবে খুন হন রাজু। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ছাত্রদলের এক পক্ষের হামলায় রাজু খুনের ঘটনার পর থেকে নগরীতে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। কোতোয়ালি থানায় রাজুর পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। ওই থানার ওসি মোশারফ হোসেন জানান, রাজু হত্যার ঘটনায় যাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাদের অনেকের সম্পর্কে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। তদন্তে বেশ কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। পুলিশ নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে রোববার তিন ছাত্রদল নেতাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য থানায় নিয়ে যায়। এ ছাড়া হামলার ঘটনায় আহত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাজুর সহকর্মী লিটন ও উজ্জ্বলের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। 
এদিকে পালিয়ে যাওয়া ঘাতকদের গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যাচ্ছে। রাজুর পরিবার ও তার সহকর্মীরা পুলিশকে সন্দেহজনক কয়েকজনের নাম, মোবাইল নম্বর ও ফেসবুক আইডিও দিয়েছেন।
মৃত্যুর কারণ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ

ছাত্রদল নেতা ফয়জুর রহমান রাজুর মৃত্যু হয়েছে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। বিষয়টি নিশ্চিত করে সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানার ওসি মোশারফ হোসেন বলেন, রাজুর শরীরে বহু আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার মাথার আঘাতটি ছিল গুরুতর। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে, হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ময়নাতদন্তের সময় রাজুর ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে হতভম্ব হয়ে যান সংশ্লিষ্টরা। চিকিৎসক রাজুর দেহে একে একে ৪৩ কোপের চিহ্ন শনাক্ত করেন। একেকটি কোপের আঘাত খুবই গভীর ছিল। তবে গুরুতর আঘাত ছিল রাজুর মাথা এবং বুকে। এই দুটি আঘাতের কারণে রাজুর দেহ থেকে প্রচুর রক্তকরণ হয়। মাথার ওপরের দুটি আঘাত ছিল দা কিংবা লম্বা চাপাতি জাতীয় কিছুর। এ ছাড়াও তাকে হত্যার কাজে ব্যবহৃত হয় একাধিক ছোরা। রাজুর মাথার পেছনে বাম পাশে ছিল আরো সাতটি, কপালের ওপর একটি, ডান হাতের বাহু থেকে কব্জি পর্যন্ত ১২টি, দুই হাতে দুটি, চার আঙুলে চারটি, বাম হাতের কব্জির ওপর একটি, বুকে দুটি ও পিঠে দুটি, ডান হাতের নিচে ১০টি এবং ডান পায়ে আরো দুটি ধারালো অস্ত্রের আঘাত পাওয়া যায়। 

‘আপনাদের প্রতিহিংসার বলি আমার ভাতিজা’
‘আপনাদের প্রতিহিংসার রাজনীতির নির্মম শিকার আমার ভাতিজা। আপনাদের কারণেই সে খুন হলো। আপনার আর মুক্তাদিরের জিন্দাবাদ রাজনীতির শিকার সে। কান্নায় ভেঙে পড়ে এমনটি বলছিলেন মধ্যবয়সী লোকটি। তিনি নিহত ছাত্রদল নেতা ফয়জুল হক রাজুর চাচা। গতকাল রোববার দুপুরে ওসমানী হাসপাতালের মর্গের সামনে নবনির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে উদ্দেশ করে এমন ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন তিনি। রাজুর চাচাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন সাবেক সংসদ সদস্য কলিম উদ্দিন মিলনসহ উপস্থিত বিএনপি নেতাকর্মীরা। 

বিজয়কে বিতর্কিত করতেই রাজুকে খুন করা হয় : আরিফ
সিলেট সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেছেন, আমার বিজয়কে বিতর্কিত করতেই একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধনে ছাত্রদল নেতা ফয়জুল হক রাজুকে হত্যা করা হয়েছে।
রোববার দুপুরে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাজুর লাশ দেখতে গিয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেন। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের বিচারও দাবি করেন আরিফুল। এ সময় মর্গের সামনে উপস্থিত ছাত্রদল নেতাকর্মীরা ছাত্রদলের সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটির বিলুপ্তি দাবি করেন।

আরো পড়ুন :

ছাত্রদল নেতা রাজু নিহত হওয়ার নেপথ্যে

সিলেট নগরীর কুমারপাড়ায় গত শনিবার রাতে ছাত্রদলের একপক্ষের হামলায় ফয়জুর রহমান রাজু নামে সাবেক এক ছাত্রদল নেতা নিহত হয়েছেন। নিহত রাজু সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহপ্রচার সম্পাদক। তিনি নগরীর উপশহর ‘এ’ ব্লকের ৯ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাসার বাসিন্দা ফজর আলীর ছেলে। তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার শাহপুর গ্রামে। তিনি সিলেট ল কলেজের ছাত্র ছিলেন। রাজুর শরীরে ২২টিরও বেশি ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

সিলেটের পুনর্নির্বাচিত মেয়র আরিফের বিজয় মিছিল শেষে তার বাসা থেকে ফেরার পথে নগরীর কুমারপাড়া রাস্তায় হামলার ঘটনা ঘটে। এতে রাজুর সাথে থাকা আরো দুই ছাত্রদল নেতা আহত হয়েছেন। তাদের একজনের নাম উজ্জ্বল ও অন্য জনের নাম লিটন। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হতাহত তিনজনই ছাত্রদলের এখলাছুর রহমান মুন্না গ্রুপের অনুসারী বলে জানা গেছে। মুন্না এ ঘটনার জন্য ছাত্রদলের আবদুর রকিব চৌধুরী গ্রুপকে দায়ী করেছেন। 
রোববার দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে রাজুর লাশ হস্তান্তর করা হয়। লাশ নিয়ে সতীর্থ সহকর্মী পদবঞ্চিত ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা মেডিক্যাল ক্যাম্পাস এলাকায় মিছিল করে রাজুর খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। এরপর লাশ অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হয় নগরীর শাহজালাল উপশহরের বাসায়। রোববার বেলা ৩টায় নিহত রাজুর প্রথম নামাজে জানাজা নগরীর উপশহরের এ ব্লক জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। বাদ এশা শাহপুর গ্রামে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে লাশ দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন নিহত রাজুর স্বজনেরা।


একটি সূত্রে জানা যায়, সিসিকের মেয়র হিসেবে আরিফুল হক চৌধুরী ফের নির্বাচিত হওয়ায় শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় আরিফের গাড়িবহরের সাথে মোটরসাইকেলে নগরীর কুমারপাড়া এলাকায় তার বাসায় যান ছাত্রদল কর্মী উজ্জ্বল, রাজুসহ তিনজন। আরিফুল হককে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তিনজন একই মোটরসাইকেলে করে ফিরছিলেন। গলির ভেতর থেকে কুমারপাড়া পয়েন্ট-সংলগ্ন এলাকায় আসা মাত্র শাহী ঈদগাহর দিক থেকে কয়েকটি মোটরসাইকেলে কিছু যুবক এসে তাদের ওপর হামলা চালায়। হামলাকারীদের হাতে ছিল স্টাম্প, দাসহ দেশীয় অস্ত্র। এ সময় এক যুবক সেখানে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে। হামলায় উল্লিখিত তিনজন আহত হন। তাদেরকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ (সিওমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহতদের মধ্যে রাজুর অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। রাত ১১টায় তিনি মারা যান।

প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে অন্য একটি সূত্র জানায়, মেয়র পদে বিজয়ী আরিফুল হক চৌধুরীকে নিয়ে রিটার্নিং অফিসার কার্যালয় থেকে বেরুনোর পর বিজয় মিছিল বের করেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি কুমারপাড়া পৌঁছলে নিজ বাসভবনে চলে যান আরিফুল হক চৌধুরী। এরপর কমিটি নিয়ে বাগি¦তণ্ডার জেরে আরিফের বাসার সামনের সড়কে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রকিব চৌধুরী গ্রুপের নতুন কমিটির নেতাকর্মীরা পদবঞ্চিত ছাত্রদল কর্মীদের কুপিয়ে জখম ও গুলি করেন। এ সময় আহতদের রক্তে রাস্তা রঞ্জিত হয়ে যায়। 

ওই সূত্র আরো জানায়, সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচন চলাকালে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কার্যালয়ে হামলার মামলায় রাজুও আসামি ছিলেন। এ মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন রাজু। জামিনে এসে ধানের শীষের প্রার্থী আরিফের পক্ষে চালিয়েছেন প্রচার-প্রচারণা। খেটেছেন রাত-দিন। কিন্তু যাদের হাতে হাত ধরে রাজু স্বপ্ন দেখেছেন দলীয় প্রার্থীর বিজয়ের, তাদের হাতেই নৃশংসভাবে খুন হলেন তিনি।
হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কমিটি নিয়ে বিরোধ : ফয়জুল হক রাজু নিহত হওয়ার ঘটনায় সিলেট নগর জুড়ে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এ ঘটনার জের ধরে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা আবারো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন সিলেট নগরবাসী। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

জানা গেছে, রাজু খুনের নেপথ্যে রয়েছে ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে গঠন হওয়া সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের কমিটিকে কেন্দ্র করে সংগঠনের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। কমিটি গঠনের পরে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় সিলেট ছাত্রদল। এক পক্ষ কমিটির পক্ষে আরেক পক্ষ বিপক্ষে। নির্বাচনের আগে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া এমনকি সংঘর্ষও হয়। এ বিরোধের জের ধরেই শনিবার রাজুর ওপর হামলা চালানো হয়। নিহত রাজু সিলেট জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এখলাছুর রহমান মুন্নার সহকর্মী ছিলেন। তিনি ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। হামলাকারীরা মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রকিব চৌধুরীর সমর্থক বলে অভিযোগ করেছেন রাজুর সহকর্মীরা। রকিব ও তার কর্মীরা নবগঠিত ছাত্রদলের কমিটির পক্ষে রয়েছেন। ছাত্রদলের পদবঞ্চিত একাধিক নেতা জানান, ২০০৫ সালে জাফলং পাথর কোয়ারি দখল করতে গিয়ে রকিব ও তার সহযোগীদের গুলিতে এক কিশোর নিহত হয়। ওই ঘটনায় রকিবসহ পাঁচজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে জনতা। পরে সেসব ঘটনা আড়াল করতে বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের কাছাকাছি আসেন রকিব। সম্প্রতি জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের নতুন কমিটি নিয়ে বিভেদ তৈরির পেছনে বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার হাত রয়েছে। ফলে নতুন কমিটি ও পদবঞ্চিতদের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। যার বাস্তব প্রতিফলন ঘটে রাজু হত্যার মধ্য দিয়ে। 

খুনিদের গ্রেফতার দাবি মেয়র আরিফের : ফয়জুল হক রাজু নিহত হওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের পুনর্নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি খুনিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। শনিবার রাতেই হামলার খবর শুনে ওসমানি হাসপাতালে ছুটে যান আরিফ। সেখানে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, হামলাকারীরা সন্ত্রাসী। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। একই সাথে এদের যদি কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানান তিনি। 

আরিফ ওসমানী হাসপাতালে রাজুর স্বজনদের সমবেদনা জানান। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। মেয়র আরিফ ছাড়াও বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা: সাখাওয়াত হাসান জীবন, সিলেট জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান আহমদ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট সামসুজ্জামান জামান, জেলা বিএনপি নেতা মইনুদ্দিন সোহেল, জেলা আওয়ামী লীগের উপদফতর সম্পাদক জগলু চৌধুরী, ওয়ার্ড কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদ সেলিম, আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিব বাবলু ও সাবেক ছাত্রদল নেতা রেজাউল করিম নাচন হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় ছাত্রদলের বিদ্রোহী পক্ষের একটি মিছিল ওসমানী হাসপাতালে আসে। মিছিলকারীরা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের বিরুদ্ধে সেøাগান দেন।


আরো সংবাদ



premium cement