২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক হিংসায় মৃত্যুর মিছিল

দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক হিংসায় মৃত্যুর মিছিল - ছবি : সংগৃহীত

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে সহিংস বিক্ষোভে এ পর্যন্ত একজন পুলিশসহ অন্তত ২৭ জন নিহত হয়েছে। ওই আইনের সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে গত সোমবার থেকে শুরু হওয়া এ সংঘর্ষে আহত হয়েছে শতাধিক। দিল্লিতে গত কয়েক দশকে এরকম সহিংসতা আর দেখা যায়নি বলে মন্তব্য অনেকের। উত্তর-পূর্ব দিল্লির বহু বাড়িঘর ও দোকানপাটে আগুন দেয়া হয়েছে এবং কিছু এলাকা সহিংসতার ফলে যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে। দিল্লিতে সহিংসতার তৃতীয় রাতেও বেশির ভাগ ঘটনায় মুসলিমদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলার খবর পাওয়া গেছে। সহিংসতার সময় একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মসজিদে অগ্নিসংযোগ ও মিনারে হনুমানের পতাকা টানানোর খবরও বেরিয়েছে। সাংবাদিকরা বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। সহিংসতা শুরু হওয়ার চার দিন পর শান্তি চেয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইট করেছেন। তিনি দিল্লিতে শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার আবেদন জানান। অন্য দিকে বিরোধী কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী সহিংসতা দমনে ব্যর্থতার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পদত্যাগ চেয়েছেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল রাজধানীতে সহিংসতা দমনে সেনা মোতায়েনের দাবি জানান। খবর রয়টার্স, বিবিসি, আলজাজিরা, এনডিটিভি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও আনন্দবাজার পত্রিকার।

বিবিসির রিপোর্টে দিল্লির ঘটনাকে গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ছবি ও ভিডিওতে সয়লাব হয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া। এসব ছবিতে দেখা গেছে, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লাঠি-রড নিয়ে মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সংঘর্ষকারীরা। নিহতদের মধ্যে মুসলমান ও হিন্দু- এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষই আছে। আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধসহ সব ধরনের হামলার শিকার ব্যক্তিরাই আছে।

খবরে বলা বলা হয়, উত্তর-পূর্ব দিল্লির বেশির ভাগ দোকান গত মঙ্গলবার বন্ধ ছিল। জাফরাবাদ থেকে মৌজপুর মেট্রো স্টেশনের দূরত্ব স্পষ্ট দেখিয়ে দেয় সোমবার যে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। জাফরাবাদ এলাকার মুসলমানদের মালিকানাধীন বেশির ভাগ দোকান জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। রাস্তাগুলো ছেয়ে গেছে নিক্ষেপ করা পাথর, ইট ও কাচে। প্রায় দুই মাস হলো মুসলিম নারী ও পুরুষদের একটি গোষ্ঠী জাফরাবাদে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করছেন। যদিও তিন দিন আগে এদের মধ্যে একটি গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত নেয় ধরনা আর যথেষ্ট নয়। তারা জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনের আরেকটি সড়কে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে রাস্তা অবরোধ করে। এর পরই সম্প্রতি নির্বাচনে হেরে যাওয়া বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রসহ হিন্দুত্ববাদী নেতারা দিল্লি পুলিশ ও সরকারকে হুমকি দিতে শুরু করেন। তারা বলতে থাকেন, সিএএবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সড়ক থেকে সহিংস উপায়ে তুলে দিতে দ্বিধা করবে না।

ঘটনাস্থল থেকে বিবিসির সাংবাদিক বলেছেন, দিল্লিতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়া এলাকার প্রধান সড়কগুলো বিশৃঙ্খল অবস্থায়। রাস্তায় বিক্ষিপ্ত পড়ে আছে ইটপাথর, ভাঙা কাচ, ভাঙা ও পুড়ে যাওয়া গাড়ি এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অনেক ভবনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া। বিবিসি হিন্দির সাংবাদিক ফয়সাল মোহাম্মদ বলেছেন, আংশিক পুড়ে যাওয়া একটি মসজিদ দেখতে পেয়েছেন তিনি। এর মেঝেতে পড়ে ছিল ধর্মীয় গ্রন্থের কিছু পৃষ্ঠা।
এখন পর্যন্ত যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিমরা রয়েছেন। গুরু তেগ বাহাদুর হাসপাতাল কর্মকর্তাদের মতে, সেখানে আহত প্রায় ১৮৯ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। সাংবাদিকরা হাসপাতালে দেখতে পেয়েছেন বিভিন্ন আহত মানুষকে। তাদের কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ। চিকিৎসার জন্য চিৎকার করছেন তারা। তারা বলছেন, ধারণ ক্ষমতার বেশি রোগী গেছেন সেখানে। আহতদের অনেকে এতটাই ভীত শঙ্কিত যে তারা বাসায় যেতেও ভয় পাচ্ছেন।

এই এলাকাগুলো লোনি সীমান্তের কাছাকাছি। এই সীমান্ত দিল্লি ও উত্তর প্রদেশের মধ্যে অবস্থিত। বর্তমানে ওই সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এলাকার স্কুল বন্ধ রয়েছে। বছর শেষের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। সাংবাদিকসহ অনেকে টুইট করেছেন এবং বলেছেন, দাঙ্গাকারীরা তাদের কাছে তাদের ধর্ম কী তা জানতে চেয়েছে। একজন সাংবাদিক বলেছেন, তাকে তার ধর্মীয় পরিচয় জানার জন্য প্যান্ট খুলতে বলা হয়েছে। অতীতেও ধর্মীয় দাঙ্গার সময় এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে মুসলিমদের চেনার জন্য। কারণ মুসলিমদের খতনা করানো থাকে।

এনডিটিভিকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল বলেছেন, ঘটনাস্থলে পর্যাপ্ত ফোর্স আছে। আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ সময় তিনি দিল্লিবাসীকে ইউনিফর্ম পরা মানুষগুলোর প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানান। হামলার সময় পুলিশ পর্যাপ্ত ভূমিকা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। এমন অভিযোগের জবাবে অজিত দোভাল ওই কথা বলেন। এ ছাড়া অপ্রস্তুত থাকা এবং সংখ্যায় কম থাকার অভিযোগ আছে দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে। এই সহিংসতায় কমপক্ষে ৫০ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। রতন লাল নামে একজন পুলিশ কনস্টেবল নিহত হয়েছেন। এ দিকে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের কাছে পুলিশের মুখপাত্র এম এস রাধাওয়া বলেছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে আধা সামরিক বাহিনী।

পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গতকাল বুধবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক বসেছে। এর আগে মঙ্গলবার রাতে কর্মকর্তা ও পুলিশের সাথে বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কিন্তু এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সহিংসতার এই সময়কে তার জন্য বিব্রতকর হিসেবে দেখা হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দুই দিনের জন্য ভারত সফরে যখন অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন, সেই সময়েই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। সহিংসতা মারাত্মক রূপ নেয়ায় তা ট্রাম্পের সফরকে টপকে যায়। দিল্লির এ সহিংসতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সংবাদ শিরোনাম হয়।

টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া বলেছে, দিল্লির সহিংসতায় গুজরাট মডেল দেখা গেছে। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত সঙ্ঘাতে বিধ্বস্ত উত্তর-পূর্ব দিল্লি নিয়ে প্রকাশ্যে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিংবা রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বরাত দিয়ে সরকারি এক কর্মকর্তা দেশের জনগণ ও গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীলতার পাশাপাশি গুজব না ছড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান মঙ্গলবার রাতে একটি টুইট করেছেন। এতে তিনি বলেছেন, ভারত সরকারের একেবারে উচ্চপর্যায়ের নীরবতা নয়াদিল্লির এই সহিংসতাকে দীর্ঘ করতে ভূমিকা রাখছে। কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই সহিংসতায় দিল্লির ক্ষমতাসীনদের বধির হয়ে যাওয়াটা অতি আশ্চর্যজনক। এই মুহূর্তে শান্ত ও ঐক্যবদ্ধ থাকার ডাক দেয়াটা জরুরি। কিন্তু কোথাও থেকে এই ডাক শোনা যাচ্ছে না।

ভারতের বাংলা দৈনিক গণশক্তি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ঘর পোড়া আগুনের পাকিয়ে ওঠা কুণ্ডলী, কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া আকাশ, আর্তনাদ-হাহাকারের মাঝে দিল্লিতে দাঁড়িয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার মোদিকে সার্টিফিকেট দিয়েছেন ‘স্ট্রং ম্যান’ বলে। কিন্তু সমালোচনা শুরু হয়েছে, স্ট্রং ম্যান আর তার ডেপুটির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই ‘গুজরাট মডেল’ কার্যকরী হচ্ছে দিল্লিতে। গণশক্তি বলছে, সাংবাদিকদের ধর্ম প্রমাণ করতে বলে আক্রমণ করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। গুলিবিদ্ধ হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন এক সাংবাদিক। জয় শ্রীরাম, হর হর মহাদেব স্লোগানে আকাশ কাঁপিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে সংখ্যালঘু মুসলিমদের মসজিদে। দিল্লির অশোকনগর এলাকায় এক মিনারের মাথায় উঠে হনুমান পতাকা লাগানোর হিন্দুত্ববাদী আস্ফালনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। একটি মাজারে কিভাবে পেট্রলবোমা, আগুন দেয়া হচ্ছে অল্পবয়সীদের দিয়ে তাও সামনে এসেছে।

গণশক্তির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে মুসলিমদের। সেই ভিডিও তুলে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, নির্ভয়ে। উন্মত্তরা যেন নিশ্চিত ভাইরাল এসব ভিডিও দেখেও পুলিশ তাদের ধরবে না। পুলিশের সামনেই হিন্দুত্ববাদীরা পাথর আনছে, পেট্রল আনছে। ছবি, ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ভিডিওগুলোতে চিৎকার করে হিন্দুত্ববাদীরা বলছেন, পুলিশ আমাদের সাথে আছে।

ভারতীয় এই সংবাদমাধ্যম বলছে, গুলিবিদ্ধ যুবক ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে রয়েছেন, অ্যাম্বুলেন্স পুলিশ আসেনি উদ্ধার করতে। মিশ্র জনবসতির এলাকায় বেছে বেছে মুসলিমদের দোকান ভাঙচুর করা হচ্ছে, আগুন লাগানো হচ্ছে। গোকলপুরীর টায়ার বাজার যেখানে মুসলিমদেরই দোকান অধিকাংশ, পুরোটাই জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

‘মৌজপুর, জাফরাবাদের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দুদের বাড়ির বাইরে গেরুয়া পতাকা লাগানো হয়েছে সোমবার সকালে, যাতে নির্দিষ্ট করে মুসলিমদের বাড়িঘর চিহ্নিত করা যায় আক্রমণের জন্য। তার পরই শুরু হয় হামলা। এসব ঘটনা থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ধনে-প্রাণে মারার এক সুপরিকল্পিত বন্দোবস্ত স্পষ্ট হয়ে গেছে।’ যারা স্মরণে রেখেছেন তারা বলছেন, অবিকল যেন গোধরা-পরবর্তী ২০০২ এর ‘গুজরাট মডেল।’

৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে উত্তরপ্রদেশ লাগোয়া মুসলিম অধ্যুষিত বাবরপুর, মৌজপুর, করদামপুরী, চাঁদবাগ, গকুলপুরী, ভোজনপুরা, যমুনা বিহার, বিজয় পার্ক, জাফরাবাদের মতো এলাকায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠিত কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা। উত্তর-পূর্ব দিল্লিতেই সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা ভোটে আসন পেয়েছে বিজেপি। বাবরপুরের সভা থেকেই অমিত শাহ শাহিনবাগে ‘কারেন্ট’ লাগাতে বলেছিলেন। দিল্লি বিধানসভা ভোটের সময়ে শাহিনবাগকে ঘিরে ব্যাপক ঘৃণা এবং উসকানি ছড়িয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিজেপির শীর্ষনেতারা।

দিল্লিতে নির্বাচনে হারের পরও সেই উসকানি চলেছে। সবশেষে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের প্রত্যক্ষ উসকানির পর এই হামলা শুরু হয়। সে কথা এ দিন কার্যত মেনে নিয়েছেন পূর্ব দিল্লির বিজেপি সাংসদ গৌতম গম্ভীরও। যারা উসকানি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি। তিন দিন ধরে দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদীদের হিংসার ব্যাপকতায় স্পষ্ট হয়ে গেছে অনেক দিন ধরেই এই প্রস্তুতি ছিল। মিশ্র জনবসতি এলাকার সংখ্যালঘুরা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা বাইরের লোক। অভিযোগ উঠছে সংলগ্ন উত্তরপ্রদেশ থেকে লোক আনছে বিজেপি। ভয়ঙ্কর এই পরিস্থিতির মধ্যেও বিজেপির উসকানি অব্যাহত আছে। হিমাচল প্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুর বলেছেন, যারা ভারত মাতা কী জয় বলবে, তারাই শুধু এই দেশে থাকবে। ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় তিন দিন ধরে টানা বিক্ষোভ-সহিংসতা-সঙ্ঘাতে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে রাজধানী নয়াদিল্লি। এর মাঝেই সোমবার দুই দিনের সফরে ভারতে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার এই সফরের আগে নাগরিকত্ব আইনবিরোধী বিক্ষোভ ব্যাপক আকার ধারণ করে।

আইবি কর্মীর লাশ উদ্ধার : দিল্লির চাঁদবাগ এলাকায় গতকাল দুপুরে একটি নর্দমা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক আইবি কর্মীর মৃত দেহ। দিল্লির সহিংসতার আবহে নর্দমা থেকে এক আইবি কর্মীর মৃত দেহ উদ্ধার ঘিরে জোর চাঞ্চল্য ছড়াল রাজধানীতে। উত্তর-পূর্ব দিল্লির চাঁদবাগ এলাকার একটি নর্দমা থেকে উদ্ধার করা হয় এই আইবি কর্মীর দেহ। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে নিখোঁজ ছিলেন ওই ব্যক্তি। বাড়ির কাছ থেকে একদল যুবক তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার ওপর হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিহত ব্যক্তির নাম অঙ্কিত শর্মা। আইবিতে সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতেন তিনি। খাজুরি খাস এলাকায় পরিবারের সাথে থাকতেন অঙ্কিত। জানা গেছে, অঙ্কিতের বাবা দেবেন্দ্র শর্মাও আইবিতে কর্মরত। আইবির হেড কনস্টেবল দেবেন্দ্র।
পুলিশকেই দায়ী করল আদালত : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়, আদালতের নির্দেশের ওপর ভরসা না করে পুলিশকে পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয় দিল্লি হাইকোর্ট। শাহিনবাগ মামলার শুনানিতে দিল্লি হিংসা নিয়ে পর্যবেক্ষণের কথা জানান বিচারপতি কৌল ও যোশেফ। তিনি বলেন, ‘হিংসার মদদদাতাদের পুলিশ প্রশ্রয় না দিলে এ ঘটনাই ঘটত না।
নজিরবিহীনভাবে মঙ্গলবার রাত পৌনে দুইটা পর্যন্ত দিল্লি হিংসা নিয়ে মামলার শুনানি হয় হাইকোর্টে। বিচারপতি এস মুরলিধরের বাড়িতেই চলে শুনানি। দিল্লি পুলিশকে বিচারপতি এস মুরলিধর ও বিচারপতি এ জে ভমম্বানী বেঞ্চের নির্দেশ, অবিলম্বে মুস্তাফাবাদের ছোট হাসপাতাল থেকে দিল্লি হিংসায় জখমদের বড় হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন দিল্লি পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের একটি ফোরাম মঙ্গলবার গভীর রাতে দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। তাদের দাবি ছিল, মুস্তাফাবাদে আহতদের চিকিৎসার জন্য যেতে ইচ্ছুক মেডিক্যাল টিম ও আহতদের নিয়ে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সকে যেন পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হয়।

সেনা মোতায়েনের দাবি কেজরিওয়ালের : দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদিদের তাণ্ডবে সৃষ্ট সহিংসতা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ জন্য সেখানে সেনা নামানোর আবেদন করেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এ নিয়ে গতকাল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি পাঠান তিনি।

রাজধানীর পরিস্থিতি নিয়ে টুইটারে উদ্বেগ প্রকাশ করে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘রাতভর অনেক মানুষের সাথে কথা হয়েছে। পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি পুলিশ। মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফেরানো যায়নি। এবার সেনা নামানো উচিত। ক্ষতিগ্রস্ত সব জায়গায় অবিলম্বে কারফিউ জারি করা উচিত। এই ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছি আমি।

আনন্দবাজার পত্রিকায় বলা হয়, এর আগে মঙ্গলবারও দিল্লিতে সেনা নামানোর পক্ষে দাবি জানিয়েছিলেন কেজরিওয়াল। তবে সে সময়ে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। সেনার পরিবর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েনের পক্ষে মত দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

শান্তিপূর্ণ থাকার আহ্বান মোদির : এনডিটিভি জানিয়েছে, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গত সোমবার শুরু হওয়া সঙ্ঘাত এখনো চলছে। এই সঙ্ঘাতের মধ্যেই টুইট করে দিল্লিবাসীকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

টুইটবার্তায় মোদি বলেন, আমি আমার ভাইবোনদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি দিল্লিতে সবসময় শান্তি এবং ভাতৃত্ববোধ বজায় রাখার জন্য। দিল্লির পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশ এবং অন্যান্য সংস্থা কাজ করছে। শান্তি ও সম্প্রীতি আমাদের বৈশিষ্ট্য।

অমিত শাহের পদত্যাগ দাবি সোনিয়ার : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, দিল্লি হিংসার জন্য কেন্দ্রকে দায়ী করে স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ইস্তফা দাবি করছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। একই সাথে যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায় দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালেরও সমালোচনা করেন তিনি।

সোনিয়া গান্ধী বলেন, গত ৭২ ঘণ্টায় একজন কনস্টেবলসহ বেশ কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন। গুলিসহ হিংসায় আক্রান্ত কয়েক শ’। দিল্লির রাস্তায় রাস্তায় হিংসার ছাপ। দিল্লির পুলিশ এখনো অকেজো হয়ে বসে রয়েছে। এই হিংসার জন্য কেন্দ্র এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই দায়ী। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অবিলম্বে ইস্তফা দাবি করছি।

গতকাল দিল্লিতে দলের সদর দফতরে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে সবিস্তার আলোচনা হয়। হিংসার পেছনে কেন্দ্রীয় শাসক দলের একাধিক নেতার উসকানি দায়ী বলে জানান সোনিয়া গান্ধী। অনুরাগ ঠাকুর থেকে কপিল মিশ্র সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নানা সময়ে ‘বিদ্বেষমূলক’ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, দিল্লি ভোটের সময় বিজেপি নেতারা বহু ঘৃণ্য মন্তব্য করেছেন। তারই পরিণতি এই হিংসা।

বৈঠকে, সোনিয়া গান্ধী ছাড়াও ছিলেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি, সংসদ সদস্য গোলাম নবি আজাদ, পি চিদাম্বরম, দলের সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।

দিল্লি হিংসা প্রসঙ্গে কংগ্রেসকে পাল্টা আক্রমণ করে বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর বলেন, বিপদের সময়ও রাজনীতি করছে কংগ্রেস। দিল্লির সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার কলকাতা ছাড়ার আগে দেশে শান্তি বজায় রাখতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ওই দিন সন্ধ্যায় শহর থেকে ভুবনেশ্বরে যাওয়ার আগে কলকাতা বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সমগ্র দেশের মানুষের কাছে শান্তি বজায় রাখার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।

দিল্লিতে টার্গেটে সাংবাদিকরাও : রয়টার্স ও আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) বিরোধী ও সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আরো বিস্তৃত রূপ নিচ্ছে। এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৯ জন। আগুন দেয়াসহ হামলা হয়েছে একাধিক মসজিদে। দলবেঁধে হামলা করা হচ্ছে বিরোধী মতাদর্শীদের ওপর। আর এসব খবর প্রচার বন্ধে টার্গেট করা হচ্ছে সাংবাদিকদেরও। মঙ্গলবার থেকে এ পর্যন্ত সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচ সাংবাদিক।

বুধবার জম্মুর একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া দুর্বৃত্তদের মারধরে আহত হয়েছেন নারীসহ আরো চার সাংবাদিক।

সাংবাদিক সৌরভ শুক্লা জানান, তারা গত মঙ্গলবার রাত থেকেই উত্তর-পূর্ব দিল্লির নানা এলাকায় সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করছিলেন। গতকাল সকালে মৌজপুরে যান তিনি ও তার সহকর্মী অরবিন্দ গুনসেকর। সেখানে তাদের সরাসরি ভিডিও সম্প্রচারে বাধা দেয় জনতা। পরে তারা কারাওয়াল নগর ও গোকুলপুরীতে যান।

সৌরভ বলেন, গোকুলপুরীতে একটি মসজিদে হামলা হয়। সেখানে গেলে আমাদের মোবাইল ফোন, ক্যামেরা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা হয়। পরে অরবিন্দকে মারধর শুরু করে কয়েকজন। ভুক্তভোগী এ সাংবাদিক জানান, এক দুষ্কৃত অরবিন্দের মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করলে তিনি বাধা দেন। এ সময় লাঠির আঘাত তার কাঁধে পড়ে।
এ দিন উত্তর-পূর্ব দিল্লির আরেকটি এলাকায় খবর সংগ্রহ করছিলেন সাংবাদিক শ্রীনিবাসন জৈন, মারিয়াম আলভি ও ফটোসাংবাদিক সুশীল রাঠি। এ সময় মারিয়ামের পিঠে আঘাত করে দুষ্কৃতরা, আহত হন সুশীলও।

এ দিকে দিল্লি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মঙ্গলবার রাতে জাফরাবাদ, মৌজপুর, চাঁদবাগ, কারওয়ালনগরে সান্ধ্য আইন (কারফিউ) জারি করে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া গোটা উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে আগামী এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। দিল্লি-সংলগ্ন উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদেও ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে।

পরীক্ষা স্থগিত : সহিংসতার কারণে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে গতকালের অনুষ্ঠেয় দশম শ্রেণী ও দ্বাদশ শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষা স্থগিত করেছে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশন (সিবিএসই)। অনলাইন জি নিউজ এ খবর দিয়ে বলছে, ডিরেক্টরেট অব এডুকেশন এবং দিল্লি সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার পর সিবিএসই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ নিয়ে তারা একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাতে বলা হয়, ডিরেক্টরেট অব এডুকেশন এবং দিল্লি সরকারের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এবং শিক্ষার্থী, স্টাফ ও অভিভাবকদের জন্য অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে বোর্ড ২৬ ফেব্রুয়ারির পরীক্ষা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে।

পরীক্ষা স্থগিতের আগে দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মানিশ সিসোদিয়া ঘোষণা করেন, বুধবার উত্তর-পূর্ব দিল্লির সহিংসতা কবলিত এলাকায় সব বেসরকারি ও সরকারি স্কুল বন্ধ থাকবে। সিসোদিয়া দিল্লির শিক্ষামন্ত্রীও।


আরো সংবাদ



premium cement