২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্বামী নেই, সন্তানদের খাওয়াতে ১৫০ টাকায় চুল বিক্রি

- সংগৃহীত

‘আমার সাত বছর বয়সী ছেলে কালিয়াপ্পান স্কুল থেকে ফিরে খাবার চায়। তারপর সে ক্ষুধায় কাঁদতে শুরু করে,’ বলছিলেন প্রেমা সেলভাম।

কিন্তু ৩১ বছর বয়সী এই মা, যে ভারতের তামিলনাড়ুর সালেম জেলায় বাস করেন, ছেলেকে খেতে দেয়ার মতো তার কাছে কিছু ছিল না এবং তিনি অসহায় বোধ করছিলেন। এমনকি গত ৩ জানুয়ারি শুক্রবার তিনি কিছুই রান্না করেননি, কারণ তার কাছে রান্না করার মতো কিছু ছিল না।

এ ধরণেরই কয়েকটি বেদনাদায়ক ঘটনার পর, প্রেমা তার সহ্যের চরম সীমায় পৌছান। এই সব ঘটনা তাকে কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে ধাবিত করে, এরমধ্যে একটি পদক্ষেপের কারণে তার স্থানীয় সম্প্রদায় অভাবনীয় প্রতিক্রিয়া দেখায়।

‘হৃদয় ভেঙ্গে গিয়েছিল’

‘বাচ্চাদের খেতে দেয়ার মতো কোনো খাবার আমার কাছে ছিল না। এটা আমাকে কষ্ট দিয়েছিল। এটা আমার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যদি আমার বাচ্চাদের খাবার দিতে না পারি তাহলে বেঁচে থেকে কী হবে?’ বিবিসিকে বলছিলেন তিনি।

কোনো কিছু বিক্রি করে অর্থ আয় করার মতো কোনো সম্পদ, গয়না, মূল্যবান জিনিস কিংবা রান্নাঘরের তৈজসপত্রও ছিল না প্রেমার কাছে।

তিনি বলেন,‘আমার কাছে ১০ রূপির একটা নোটও ছিল না। আমার কাছে শুধু প্লাস্টিকের কয়েকটি বালতি ছিল।’

এরপর তিনি বুঝতে পারেন যে, তার কাছে কিছু একটা আছে যা তিনি বিক্রি করতে পারেন।

ওজন করে চুল বিক্রি

‘একটা দোকানের কথা আমার মনে ছিল যেটি চুল কিনতো। আমি সেখানে গিয়ে আমার পুরো মাথার চুল ১৫০ রুপিতে বিক্রি করে দেই,’ প্রেমা বলেন।

সারাবিশ্বেই মানুষের চুল কেনা-বেচা হয় এবং ভারত শীর্ষ রপ্তানিকারক। প্রার্থনা পূরণ হওয়ার বিনিময়ে অনেক হিন্দু পূণ্যার্থী মন্দিরে তাদের চুল দান করে থাকেন। ব্যবসায়ীরা সেগুলো কিনে নিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে থাকে।

স্বামীর আত্মহত্যা

চুল বিক্রি করে যে অর্থ তিনি পেয়েছিলেন তা দিয়ে হয়তো একটি বড় শহরে মাঝারি মানের একটি রেস্তোরায় দুপুরের খাবার কেনা সম্ভব। কিন্তু গ্রামে সেই অর্থ দিয়ে তিনি বেশ কিছু জিনিস কিনতে পেরেছিলেন।

তিনি বলেন,‘আমার তিন সন্তানের জন্য ২০ রুপি করে আমি তিন প্যাকেট ভাত কিনি।’

তিনি তার সন্তানদের সাথে ভাগাভাগি করে সেই খাবার কিছুটা খেয়েছিলেন। কিন্তু এটা ছিল ক্ষণিকের আনন্দ মাত্র। প্রেমা জানতেন যে, তিনি নিজের শেষ উপায় ব্যবহার করে ফেলেছেন এবং পরের বেলা তিনি কিভাবে তার পরিবারকে খেতে দেবেন, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

বছরের পর বছর ধরে তিনি তার স্বামীর সাথে একটি ইটের ভাঁটায় কাজ করতেন এবং বেঁচে থাকার মতো পর্যাপ্ত অর্থ আয় করতেন তারা। তার স্বামী নিজের ইটের ভাটা শুরু করার জন্য ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়ন হয়নি এবং এর পরিবর্তে হতাশা ভর করেছিল।

প্রেমার স্বামী কখনোই পর্যাপ্ত অর্থ জোগাড় করতে পারেননি এবং তিনি মরিয়া হয়ে গিয়েছিলেন। একপর্যায়ে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে সাত মাস আগে তিনি আত্মহত্যা করেন। চুল বিক্রির পর এবং আর কোন উপায় না থাকায়, প্রেমাও তার স্বামীর মতো একই পথ অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন।

প্রেমার আত্মহত্যার চেষ্টা

‘আমি একটি দোকানে কীটনাশক কিনতে যাই।’

কিন্তু তার করুণ অবস্থা দেখে দোকানদার তাকে তাড়িয়ে দেয়। তিনি বাড়ি ফিরে এসে অন্য কোন উপায় খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি করবী গাছের বীজ তুলে সেগুলো পিষে মিশ্রণ তৈরি করতে শুরু করেন। ভাগ্যক্রমে প্রেমার বোন বাড়ির পাশেই বসবাস করা এক বোন তাকে সেই বিষাক্ত মিশ্রণ খেতে বাধা দেয়। বোনকে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে প্রেমা বলেন, তার স্বামীর ধার করা অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার চাপ তাকে দুর্বল করে তুলেছে।

ভারী কাজ

স্বামীর মৃত্যুর পর প্রেমাই এখন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তিনি তার স্বামীর মতোই ইট তৈরির কাজ করেন। এটি শারীরিক পরিশ্রমভিত্তিক কাজ হলেও এতে কৃষিকাজে নিযুক্ত শ্রমিকের তুলনায় বেশি মজুরী পাওয়া যায়।

‘কাজে গেলে আমি দিন প্রতি ২০০ রুপি করে পাই যা আমার পরিবার চালানোর জন্য যথেষ্ট,’ প্রেমা বলেন।

কাজে যাওয়ার সময় তিনি সাধারণত তার ছোট দুই ছেলেকে সাথে করে নিয়ে যান, কারণ স্কুলে যাওয়ার মতো বয়স হয়নি তাদের।

কিন্তু চুল বিক্রির আগে তিন মাস ধরে তিনি প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। তার মানে হচ্ছে, সে সময় তিনি এত বেশি অর্থ আয় করতে পারতেন না।

‘আমি অনেক ইট একসাথে বহন করতে পারতাম না। জ্বরের কারণে বেশিরভাগ সময় আমি বাড়িতেই থাকতাম।’

পাহার সমান ঋণ

প্রেমা ধারের অর্থ শোধ দিতে পারতেন না। যখন তার ঋণদাতারা অর্থের জন্য চাপ দিতো, তার হতাশা আরো বেড়ে যেতো। তিনি পড়াশুনা জানতেন না এবং সরকারের স্কিম যা তার মতো মানুষদের সহায়তায় দেয়া হতো সে সম্পর্কে তার কোন ধারণাও ছিল না। ভারতের ব্যাংকিং ব্যবস্থা জটিল সব নিয়ম সম্বলিত হওয়ার কারণে তা থেকে কম সুদে ঋণ পাওয়া দরিদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য খুবই কঠিন।

প্রেমা এবং তার স্বামী স্থানীয় ঋণদাতা এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। এসব ঋণ ছিল অনিরাপদ এবং তা শোধ করার প্রক্রিয়াও ছিল খুবই ব্যয়বহুল। প্রেমা যেহেতু বারবার অসুস্থ হয়ে পড়তেন তাই তার আয় দিন দিন কমতে থাকলো। যা তাকে গভীর হতাশায় ডুবিয়ে দেয়।

এরপরই প্রেমা তার চুল বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন এবং পরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে সাহায্য

প্রেমা যখন তার স্বাস্থ্যের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌছান, তখন একজন ভাল দানশীল ব্যক্তি তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন। এরপরই ভাগ্য ফিরে আসে প্রেমার।

‘আমি প্রেমা সম্পর্কে একটি ইটের ভাঁটার মালিকের নিকট থেকে জানতে পারি,’ বলেন বালা মুরুগান। প্রেমার সংগ্রাম তাকে তার পরিবারের খারাপ সময়গুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বালা জানেন যে কিভাবে দারিদ্র্য মানুষকে হতাশায় ডুবিয়ে দেয়।

‘আমার বয়স যখন ১০ বছর, তখন আমার পরিবারে খাবারের সংকট ছিল। আমার মা তাদের পুরনো বই আর খবরের কাগজ কেজি দরে বিক্রি করে দিয়ে সেই অর্থ দিয়ে চাল কেনেন।’

এমন মরিয়া অবস্থায় তার মা নিজে আত্মহত্যা করতে এবং তার পরিবারকেও মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তিনি স্মৃতিচারণ করেন, কিভাবে তার মা তাদেরকে নিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। ‘আমার মা প্রথমে কয়েকটি ওষুধ খায় এবং পরে যখন আমার বোন ওষুধ খেতে যায় তখন মা তাকে থামিয়ে দেয়।’

শেষ মুহূর্তে গিয়ে তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। পরিবারের সদস্যরা তার মাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায় এবং তার মায়ের জীবন রক্ষা হয়। এ ঘটনার পর, বেশ কয়েক বছরের চেষ্টায় বালা দারিদ্র্যকে জয় করতে সক্ষম হযন এবং এখন তার একটি কম্পিউটার গ্রাফিক্স সেন্টার রয়েছে।

আন্তরিক পরামর্শ

বালা প্রেমাকে তার নিজের জীবনের ঘটনা বলে এবং তাকে আশান্বিত হওয়ার কথা বলেন। তিনি প্রেমাকে খাবার কেনার জন্য কিছু অর্থ দেয়। এর পর পুরো ঘটনাটি বালা ফেসবুকে লেখেন।

‘একদিনের মধ্যে আমি এক লাখ ২০ হাজার রুপি জোগাড় করি। যখন আমি প্রেমাকে জানাই সে খুবই খুশি হয় এবং বলে যে এতে তার বেশিরভাগ ঋণ শোধ হয়ে যাবে।’

কিন্তু প্রেমার অনুরোধে তহবিল সংগ্রহ বন্ধ করা হয়।

‘প্রেমা বলে যে, সে (প্রেমা) কাজ করে বাকি ঋণ শোধ করবে,’ বলেন বালা। এখন তাকে প্রতিমাসে বিভিন্ন ঋণদাতাকে ৭০০ রুপি করে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। জেলা কর্তৃপক্ষও তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে এবং আশ্বাস দিয়েছে যে, তাকে দুধ বিক্রির ডিলারশীপ দেয়া হবে।

দুঃখজনক ভাবে, প্রেমার গল্পটিই একমাত্র ঘটনা নয়। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিনের খাবার যোগাড় করতেই হিমশিম খায়। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে, নাইজেরিয়ার পর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চরম দারিদ্র্য আক্রান্ত মানুষদের (যাদের দৈনিক আয় ১.৯০ ডলারের কম) বাস ভারতে। প্রেমাকে চারজনের খাবার যোগাড় করতে হয় এবং যেদিন সে আয় করে সেদিনও তার পারিশ্রমিক জনপ্রতি ৭২ সেন্টেরও কম হয়। সে দরিদ্রদের মধ্যেও দরিদ্র।

নতুন জীবন

বালা মুরুগান প্রেমাকে তার সাহায্য দেয়া অব্যাহত রেখেছে।

‘এখন আমি বুঝি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আমি বাকি ঋণ শোধ দেয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী।’

প্রেমা বলেন যে, তিনি অচেনা মানুষদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে অত্যন্ত খুশি এবং তিনি এটাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এটা তাকে তার শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছে। সূত্র : বিবিসি।


আরো সংবাদ



premium cement
ঈশ্বরগঞ্জে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ব্যারিস্টার ফারজানাকে সংবর্ধনা যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে‘ভিত্তিহীন' তথ্য ব্যবহারের অভিযোগ বাংলাদেশ সরকারের মোদির মুসলিমবিরোধী মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় সংখ্যালঘু নেতাকে বহিষ্কার ফ্লোরিডায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের নতুন কনসাল জেনারেল সেহেলী সাবরীন চান্দিনায় পানিতে ডুবে একই পরিবারের দুই শিশু মৃত্যু কেএনএফ সম্পৃক্ততা : গ্রেফতার ছাত্রলীগ নেতা সম্পর্কে যা জানা গেছে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ শ্রমজীবি মানুষের মাঝে ক্যাপ, পানি ও স্যালাইন বিতরণ করেছে ছাত্রশিবির ঢাকা মহানগর পশ্চিম নোয়াখালীতে হিট স্ট্রোকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ায় স্ত্রীর ২৭ স্থানে স্বামীর ধারালো অস্ত্রের আঘাত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে ১২ উপজেলায় মানববন্ধন

সকল