২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শেষ দফায় পশ্চিমবঙ্গে শূন্য বিজেপি! নেপথ্যে কি বিদ্যাসাগরের ভাঙা মূর্তি

মমতা ও মোদি - সংগৃহীত

দমদম নাগেরবাজার মোড়ে গেলেই দেখতে পাওয়া যায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি অতিকায় ছবি। তার নিচে লেখা- 'বাংলার গর্ব'। তবে কেবল নাগেরবাজারেই নয়, দমদম লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে বিদ্যাসাগরের ছবি। দক্ষিণবঙ্গের যে আসনগুলোকে বিজেপি পাখির চোখ করেছিল, সেগুলির অন্যতম হলো দমদম। গেরুয়া শিবির আশা করেছিল, প্রবল মোদি হাওয়ায় ভর করে দুই দশক পর ফের দমদমে ফুটবে পদ্মফুল।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য দমদমে জিততে পারেননি বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্য। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায়ের কাছে তিনি হেরে গিয়েছেন ৫২ হাজার ভোটে।

শমীক অবশ্য একা নন। ভারতের সাধারণ নির্বাচনের শেষ দফার ভোটে গত ১৯ মে পশ্চিমবঙ্গে যে ৯টি আসনে নির্বাচন হয়েছিল, তার একটিতেও জিততে পারেনি বিজেপি। দমদম ছাড়া বাকি ৮টি কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীদের জয়ের ব্যবধান ১ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষের বেশি। অথচ, তার আগের ৬টি দফা মিলিয়ে যে ৩৩টি আসনে নির্বাচন হয়েছিল, তার অর্ধেকেরও বেশি আসন জিতেছে গেরুয়া শিবির। মোট ১৮টি।

কেন শেষ দফায় এমন বিপর্যয়? রাজনৈতিক মহলের একাংশের মত, এর পিছনে রয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বয়ং! সপ্তমদফার নির্বাচনের আগে উত্তর কলকাতার বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিনহার সমর্থনে কলকাতায় রোড-শো করেছিলেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। সেই শোভাযাত্রা চলাকালীন উত্তর কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে তাণ্ডব চালানো এবং ঈশ্বরচন্দ্রের মূর্তি ভাঙচুর করার অভিযোগ উঠেছিল কেন্দ্রের শাসকদলের বিরুদ্ধে। নির্বাচনের ফল দেখে পশ্চিমবঙ্গে জল্পনা শুরু হয়েছে, বিদ্যাসাগর কেবল একজন সমাজ সংস্কারক নন। গত দুই শতাব্দী যাবত তিনি বাঙালির আবেগের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। গেরুয়া ব্রিগেডের বিরুদ্ধে তার মূর্তি ভাঙার অভিযোগের ওঠার জন্যই বিজেপি ধাক্কা খেয়েছে সপ্তমদফার নির্বাচনে।

এ হেন জল্পনার সমর্থন মিলেছে স্থানীয়দের কাছেও। নাগেরবাজারের বাসিন্দা রূপক শীল একটি স্টেশনারি দোকানের কর্মী। তাঁর কথায়, এই নির্বাচনে দমদমে বিজেপি-র পক্ষেই হাওয়া ছিল। কিন্তু শেষ মূহুর্তে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় ওঁরা পিছিয়ে পড়লেন।

নাগেরবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা এবং দোকানদারদের অনেকেই রূপকের সঙ্গে একমত। ৭৫ বছর বয়সী রাজেন্দ্র বসু দেশভাগের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে দমদমে এসেছিলেন। তাঁর কথায়, আমি বিজেপি-কে ভোট দিয়েছি। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পর এমন অনেকেই ভোট দেননি, যারা হয়তো পদ্ম প্রতীকেই বোতাম টিপতেন।

গোয়ালাবাগান এলাকার এক বিজেপি কর্মী প্রকাশ্যেই মেনে নিলেন মূর্তি ভাঙার ঘটনা প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, একদম শেষ মূহুর্তে এই ঘটনা ভোটারদের প্রভাবিত করেছে। বাঙালী আবেগ আহত হয়েছে। ভোটারদের অনেকেই বাঙালির অহংকারের পক্ষে ভোট দিতে চেয়েও তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন।

দমদমের পাশের কেন্দ্র বারাসতেও সপ্তমদফায় নির্বাচন হয়েছে। সেখানেও বিজেপি প্রার্থীকে ১ লক্ষেরও বেশি ভোটে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন তৃণমূলের কাকলী ঘোষ দস্তিদার। মূর্তি ভাঙার ঘটনা একই রকম প্রভাব ফেলেছে সেখানেও। লেক টাউন এলাকার বাসিন্দা তথা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেত্রী রূপালি দে বলেন, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পর আমরা বিপুল জনসমর্থন পেয়েছি। এই অঞ্চলে পেশাজীবী মানুষেরা থাকেন, তাঁদের ভোটকে প্রভাবিত করা যায় না। কিন্তু ওই ঘটনার পর আমরা একটি মিছিলের ডাক দিয়েছিলাম। তাতে শয়ে শয়ে মানুষ শামিল হয়েছিলেন। তাঁরা আমাদের জন্য আসেননি, এসেছিলেন বিদ্যাসাগরের জন্য।

গোয়ালাবাগান এলাকার একটি পার্টি অফিসে বসে দমদমের বিজেপি প্রার্থী শমীক বলছিলেন, সাধারণত দমদম নিঃশব্দে এই রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবর্তনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে কাজ করে। তার কথায়, ২০০৯ সালে সৌগত রায় যখন এই এলাকার দীর্ঘদিনের বাম আধিপত্যের অবসান ঘটালেন, তখন আগে থেকে কেউ তা বুঝতে পারেননি। দমদম দীর্ঘদিন বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল, এখন সেই জনভিত্তি সরে গিয়েছে তৃণমূলের দিকে। নির্বাচনের ঠিক আগে শমীক দাবি করেছিলেন, এবার তেমনই বদল আসতে চলেছে বিজেপির পক্ষে।

মূর্তি ভাঙার ঘটনা তাদের সাহায্য করেছে কিনা জানতে চাওয়া হলে দমদমের তৃণমূল এমপি সৌগত রায় জানান, ওই ঘটনার ব্যপক প্রভাব পড়েছে। কিন্তু সেটা দমদমে নয়, কলকাতা শহরের দুই কেন্দ্রে তৃণমূল লাভবান হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক মইদুল ইসলাম বলেন, বিজেপি সর্বত্র ভালো ফল করলেও এই ৯টি কেন্দ্রে ব্যর্থ হয়েছে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার জন্যই। বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেগের ভর করে তৃণমূল এই আসনগুলিতে জিততে পেরেছে।

বাঙালি আবেগের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন দমদমের বিজেপি প্রার্থীও। তার কথায়, এখন দু-ধরনের ভোট আছে- মমতার পক্ষে ভোট এবং মমতার বিপক্ষে ভোট। কিন্তু নেতৃত্বকে বুঝতে হবে, উচ্চকণ্ঠে জয় শ্রীরাম স্লোগান এখানে কাজ করবে না। বড়বাজারে গিয়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গকে বোঝা সম্ভব নয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

 


আরো সংবাদ



premium cement