২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
দিল্লির এশিয়ান এজের প্রতিবেদন

বাংলাদেশের নির্বাচনে গণতন্ত্র বা ভারত কারোই কল্যাণ হয়নি

-

দিল্লিসহ কয়েকটি শহর থেকে প্রকাশিত ভারতের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক এশিয়ান এজে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচনে গণতন্ত্র বা ভারতের স্বার্থ, কোনোটারই কল্যাণ হয়নি। ভারত ভূষণ লিখিত এই প্রতিবেদনের বাংলা অনুবাদ নয়া দিগন্তের পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশের নির্বাচনে ভূমিধস জয়ের জন্য শেখ হাসিনা প্রথম দু’টি অভিনন্দন বার্তা পেয়েছেন যথাক্রমে ভারত ও চীনের কাছ থেকে। অবশিষ্ট বিশ্ব এই ঝুঁকি গ্রহণের ব্যাপারে কিছুটা উদ্বেগে ছিল। বিরোধী দলের বয়কটে হওয়া ২০১৪ সালের নির্বাচনের চেয়েও এবারে অবিশ্বাস্য রকমের ভালো ফলাফল করেছেন তিনি। পাশ্চাত্য নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর পরিচালিত সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে।

বাংলাদেশের নির্বাচনের ফলাফল এই দেশকে যেমন আরো বেশি গণতান্ত্রিক করছে না, একইভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের স্বার্থ বা এর বাইরের অংশের জন্য কল্যাণকর হচ্ছে না।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনকারী বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো প্রধানত বিএনপি ও অন্যরা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। অবশ্য নতুন নির্বাচনের দাবি নির্বাচন কমিশনের মেনে নেয়ার সম্ভাবনা নেই। বিরোধী দল এই কমিশনকে দলীয় বলে অভিহিত করেছে। শেখ হাসিনা উন্নয়নের তকমা পরেছেন, তবে তিনি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য যে ব্যবস্থার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেটি ভীতি প্রদর্শন, অসহিষ্ণুতা ও আতঙ্ক সৃষ্টির কাজ করছে। সময়ের পরিক্রমায় এটি সমালোচক কণ্ঠগুলোকে নীরব করে দেয়, গণতান্ত্রিক ধারা সঙ্কীর্ণ করে দেয়। আওয়ামী লীগের বিপুল, যদিও প্রশ্নবোধক, জয়ে গণতান্ত্রিক স্পেস কেবলই সঙ্কুচিত হবে।

বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াসহ শত শত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ইতোমধ্যেই কারাগারে ঢোকানো হয়েছে। এখনো যারা কারাবন্দী হওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে আছেন, আগামী দিনগুলোতে তারাও তাতে আবদ্ধ হলে বিরোধীদের অবস্থা আরো খর্ব হয়ে যাবে। রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক যন্ত্রের ভয় সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদকে দমন করবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ওই সব শক্তির স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়বে। বিদায়ী সংসদ ও আসন্ন সংসদ উভয়েই এর ভালো নজির। বিদায়ীটি সাধারণ নির্বাচনে বিরোধীদের বয়কটের কারণে অপ্রতিনিধিত্বশীল ছিল, আর পরেরটি পাতানো হিসাবে অভিযোগের কারণে তেমনটিই বোঝাবে।

রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনও দেশে তাদের ঔজ্জ্বল্য হারাবে। রাষ্ট্রীয় নির্দেশনার সাথে তাল মেলাবে মিডিয়া। রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় উভয় হামলার ইতিহাস বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীন ব্লগাররা তাদের জীবনের শঙ্কায় ভুগবে।
গণতান্ত্রিক সেফটি ভালবের অভাবে এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ভিন্নমতালম্বীদের বিরুদ্ধে ‘অস্ত্র হিসেবে’ ব্যবহৃত হলে দেশের জন্য বিশেষ বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে যেসব দেশে তাৎপর্যসংখ্যক ইসলামি চরমপন্থীর উপস্থিতি আছে, সেখানে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা চরমপন্থী রাজনীতি সম্প্রসারণের উর্বর ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। লোকজন সহজেই ইসলামি চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে, যেমনটা হয়েছে মিসর ও আলজেরিয়ার ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতাকে ভারত ও চীন উভয়ে স্বাগত জানালেও তাদের স্বার্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। চীন প্রথমত চায়, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ও দ্বিতীয়ত ভারতের মোকাবেলায় কৌশলগত পা রাখার জায়গা। ক্ষমতাসীন দলের প্রখ্যাত পরিবারগুলোর সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কের মাধ্যমে স্থানীয় রাজনীতিতে হানা দিয়ে চীন তার কৌশলগত লক্ষ্য হাসিল করতে চায়।

আওয়ামী লীগ সরকার চীনকে বেশ কয়েকটি প্রবেশপথ দিয়েছে। বাংলাদেশ হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অবিভাজ্য অংশ। ছয়টি বিআরআই করিডোরের (চারটি স্থল ও দু’টি সামুদ্রিক) মধ্যে বাংলাদেশ কুনমিং থেকে কলকাতা (মিয়ানমারের কিয়াকফু বন্দর থেকে চট্টগ্রাম হয়ে) পর্যন্ত বিস্তৃত গুরুত্বপূর্ণ সাগর পথের অবিভাজ্য অংশ।

ব্যবসায় বাণিজ্য ছাড়াও এটি চীনকে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে প্রবেশের সুযোগ দেবে। ৮৫ ভাগ চীনা মালিকানায় থাকা কিয়াকফু বন্দরটি হবে একটি জ্বালানি হাব। এর ফলে চীন অরক্ষিত মালাক্কা প্রণালীর ওপর থেকে নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে পারবে। এই প্রণালী দিয়েই মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৮০ ভাগ তেল আমদানি করে থাকে চীন।

কিয়াকফু বন্দরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনা তেল জমা করা হবে। সৌদি আরব এখানে একটি শোধনাগার বানাবে, কাতার বানাবে একটি গ্যাস পরিশোধন প্লান্ট। এখান থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে চীনে গ্যাস সরবরাহ করা হবে। কক্সবাজারের কাছে থাকা সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরটির কাজ এখন বন্ধ আছে। চীন তার ভূ-কৌশলগত, ভূ-অর্থনৈতিক ও ভূ-জ্বালানি স্বার্থ এবং সেইসাথে পদ্মা সেতু, চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রকল্প ও ১৩,৫০০ মেগাওয়াট মহেশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো বড় বড় প্রকল্পে তার বিনিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য ঢাকায় ধারাবাহিকতা চায়। মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতায় আসার পর ১.৫ বিলিয়ন ডলারের ইস্ট-ওয়েস্ট রেলওয়ে প্রকল্প বাতিল করার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি নিয়ে ভীত চীন।

বাংলাদেশে ৪০ বিলিয়ন ডলারের বিআরআই প্রকল্পে কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা চায় না চীন। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের পর বিআরআই তহবিলের একটি বড় অংশ বাংলাদেশে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা তার কাম্য। বাংলাদেশে শ্রম সস্তা হওয়ায় কয়েকটি শিল্পকারখানা বাংলাদেশ সরানো প্রয়োজন চীনের। পাশ্চাত্যের বাজারগুলোতে স্বল্প উন্নত দেশগুলো থেকে ‘চীনা পণ্যসম্ভার’ অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশের সুযোগ পেতে পারে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে চীনের ব্যাপক কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থের তুলনায় ভারতের স্বার্থ অনেক ছোট। ভারত যেসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের আশ্রয় প্রদান না করে তা নিশ্চিত করা, পাকিস্তান যাতে জাল ভারতীয় মুদ্রা ভারতে পাচার করতে না পারে সে ব্যবস্থা করা এবং অবৈধ অভিবাসীদের প্রতিরোধ করা। এসব ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সাথে সহযোগিতা করায় ভারত এই সরকারের ধারাবাহিকতা চায়।

বাংলাদেশে চীনের প্রবেশে ভারতের সম্মতি থাকলেও এখানে চীনা উপস্থিতি সময়ের পরিক্রমায় সম্প্র্রসারিত হবে এবং ভারত তাতে ভেটো দিতে পারবে না। চীনা সম্প্রসারণ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের ভূমিকা উত্থান ও সীমান্তে এর প্রভাবের জুজুর ভয়ের মধ্যে একতরফা নির্বাচন হয়তো নতুন জীবন দিয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে অস্থির দেশের বদলে স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সাথেই কাজ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement