শিলিগুড়ি করিডোর দখল করে নেবে চীন?

আপাত ভাবে সংঘাতের বাতাবরণ নেই। কিন্তু গোটা বিষয়টাই ছাইচাপা হয়ে রয়েছে। যেকোনো সময়ে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে ডোকলাম। যার প্রভাব পড়তে পারে শিলিগুড়ি করিডরে।

ভারতীয় পার্লামেন্ট লোকসভা ভোটের আগে যাতে কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়, তার জন্য ভারত সরকারের শীর্ষ স্তর থেকে যাবতীয় সতর্কতা নিতে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। পার্লামেন্টে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, উদ্বেগের কারণ নেই। কিন্তু মন্ত্রণালয়েরই সংসদীয় স্থায়ী কমিটির রিপোর্টে যেমন বিপদের আভাস দেখা যাচ্ছে, তেমনই ভারতীয় প্রতিরক্ষা এবং গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পরিস্থিতি নিরঙ্কুশ নয়।

কেন?

সূত্রের খবর, ৮৯ বর্গ কিলোমিটারের দোকলাম মালভূমির প্রায় ৫০ বর্গ কিলোমিটার এখন চীনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাকি ৩৯ বর্গ কিলোমিটার ভারতের আওতায়। চীনের সেনা, প্রশাসন বা আম নাগরিকদের গতিবিধি ভুটানের হা জেলায় ক্রমশই বাড়ছে। দেকলামও ওই হা জেলার মধ্যে। কিন্তু সরাসরি দোকলামের রাস্তা এড়িয়ে অন্য পথে চীন ক্রমশই শিলিগুড়ি করিডরের দিকে এগিয়ে আসছে।

এক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘ভারত-ভুটান-চীনের সীমান্ত মিশেছে তিব্বতের চুম্বি উপত্যকার খুব কাছে। সিকিমের কুপুপের কাছে এখন যেখানে চীনা সেনাবাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে, সেখান থেকে শিলিগুড়ি করিডরের নাগরাকাটা আকাশপথে মোটামুটি ৪৫-৫০ কিলোমিটার। সেই দূরত্ব কমাতেই চীনা সেনাবাহিনী দোকলাম কব্জা করতে চাইছে। কারণ, দোকলাম থেকে নাগরাকাটার আকাশপথে দূরত্ব বড়জোর ২৫ কিলোমিটার।’’ ওই কর্তা জানাচ্ছেন, দোকলামে স্থিতাবস্থা চলছে বলে এখন হা জেলার মধ্যেই অন্য রাস্তা খুঁজছে চীন।

যাতে ভুটানের মধ্যে দিয়ে শিলিগুড়ি করিডরের খুব কাছে ঘাঁটি গাড়া সম্ভব হয়। দোকলামে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি কংক্রিট হেলিপ্যাড, কংক্রিটের ছাউনি, সুড়ঙ্গ, নজরদারি টাওয়ার তৈরি করেছে চীনা সেনাবাহিনী।

বেশ কিছু নতুন বাঙ্কারও বানিয়েছে। আর রাস্তা তো তৈরি করেইছে। তবে দোকলামের সর্বোচ্চ অংশটিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকায় নজরদারির দিক দিয়ে তারা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।

ভারতীয় গোয়েন্দারা জেনেছেন, ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত-বিবাদ নিয়ে চীনের আলোচনা চলছে ঠিকই। কিন্তু তার আগেই ভুটানের পশ্চিম দিকে ক্রমেই এগিয়ে আসছে চীন। টহলদারি চালাচ্ছে। এক গোয়েন্দা কর্তাকর্তার কথায়, ‘‘ভুটানের মিডল সেক্টরের ৪৯৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা থিম্পুকে ছেড়ে দিতে চায় চীন। তার বদলে পশ্চিম ভুটানে ২৬৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিতে চায় তারা। এই অংশ সিকিম ও কালিম্পং লাগোয়া। গত ২৪-২৫ জুলাই চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী কং শুয়াংইউ থিম্পুতে গিয়ে ফের একই প্রস্তাব দিয়ে এসেছেন।’’ ওই গোয়েন্দা কর্তার বক্তব্য, আনুষ্ঠানিক ভাবে দু’দেশের যা কথাবার্তাই হোক না কেন, পশ্চিম ভুটানের ২৬৯ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ১৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় চীনা সেনাবাহিনী অবাধ গতিবিধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগে মাসে এক বা দু’বার চীনের সেনা ‘লং রুট পেট্রলিং’-এ ভুটানের ভিতরে যেত। এখন প্রায়ই তাদের ওই এলাকায় দেখা যাচ্ছে। চীনের আম নাগরিকেরাও মাঝে-মধ্যে ভুটানি সেনার শিবিরে এসে কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন। এ সবে ভুটানের দিক থেকেও তেমন কোনো বাধা আসছে না।

১) দোকলাম মালভূমি ২) ভুটানের ভিতরে চীনের তৈরি রাস্তা ৩) দোকলাম সংলগ্ন চীনের হেলিপ্যাড

এমন পরিস্থিতির কথা জানিয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করেছেন গোয়েন্দারা। যদিও গত ৭ মার্চ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ভি কে সিংহ লোকসভায় জানান, ২০১৭-এর ২৮ অগস্টের পরে দোকলাম বা সংলগ্ন এলাকায় নতুন করে আর কিছু হয়নি। এক প্রতিরক্ষা বিশেষ়জ্ঞের কথায়, ‘‘ভুটানের পারোতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। পারো থেকে হা জেলায় পৌঁছতে বেশি সময় লাগে না। ফলে এতটা উদ্বেগেরও কোনো কারণ নেই।’’ হাসিমারা ও পানাগড় বিমানঘাঁটি যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষমতা রাখে বলেও জানান তিনি।

তবু ভারত সরকার কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না। কারণ দোকলামে কিছু না-ঘটলেও ২০১৭-এর ২৮ ডিসেম্বর অরুণাচলের আপার সিয়াং জেলার শিয়ুং লা-তে সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে এসেছিল চীনা সেনাবাহিনী। ভারতের আপত্তি ও সীমান্ত বৈঠকের পরে তারা ফিরে যায়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ৫৭তম প্রতিষ্ঠা দিবসে ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ (আইটিবিপি) জানিয়েছে, চীন সীমান্ত বরাবর নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে গতি আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপের একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে তারা।

এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধের মহড়াও। সীমান্তে হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় আইটিবিপি-র কাজের সুবিধার জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক ছাউনি তৈরির কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা