১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চীন থেকে কেন অস্ত্র কিনছে পাকিস্তান

চীন থেকে কেন অস্ত্র কিনছে পাকিস্তান - ছবি : সংগৃহীত

২০০০-১৪ সময়কালে চীন যত সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে, তার ৪২ শতাংশ কিনেছে পাকিস্তান। আরএএনডি এক রিপোর্টে সম্প্রতি এ তথ্য প্রকাশ করেছে। ‘ডন অব বেল্ট অ্যান্ড রোড: চায়না ইন দ্য ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামের ওই রিপোর্টে চীনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সম্ভবত সবচেয়ে বড় অস্ত্র চুক্তি হলো পাকিস্তানের কাছে জেএফ-১৭ জঙ্গি বিমান বিক্রি করা। এই চুক্তির অধীনে বিমানগুলো যৌথ উদ্যোগে পাকিস্তানে নির্মাণ করা হবে।

সামরিক মহড়া

অস্ত্র বিক্রি ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে চীন। ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চীন যত সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে, তার এক-চতুর্থাংশই হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে। এই মহড়াগুলোর অনেকগুলোতেই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল পাকিস্তান, ভারত আর শ্রীলংকা।

২০০২-১৪ সাল পর্যন্ত যে ২৪টি যৌথ মহড়া হয়েছে, এর দুই-তৃতীয়াংশ হয়েছে পাকিস্তানে। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কটা যেখানে আপাত জোটের মতো, কিন্তু সেখানে ভারতের সাথেও যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়েছে চীন। এতে বোঝা যায় যে নয়াদিল্লীর সাথে বিবাদ সৃষ্টি করে ইসলামাবাদের সাথে মিত্রতা চায় না চীন।

চীন-পাকিস্তানের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ সম্পর্ক

দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের সাথে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে চীন। শুধুমাত্র ভারতকে ঠেকানোর জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে এই সম্পর্কের গুরুত্ব এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দলিল অনুযায়ী, পাকিস্তানের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে: চীনের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, ভারতের বিরুদ্ধে ভারসাম্য রক্ষা এবং চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা।

ইসলামাবাদ বেইজিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে সবসময় টিকে থাকবে তার কারণ হলো ও অঞ্চলের সঙ্ঘাতমুখী পরিস্থিতি। “পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় ঐক্য চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ভারতের বিরুদ্ধে ভারসাম্য রক্ষার জন্যই নয়, বরং ইসলামিক ও পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে এর প্রভাব বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যাবে”।

কোমল শক্তি

অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ছাড়াও চীন তার কোমল শক্তিরও প্রসার ঘটাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশে চীন আটটি কনফুসিয়ায় ইন্সটিটিউট স্থাপন করেছে। ভারত ও পাকিস্তানে রয়েছে দুইটি করে সেন্টার। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল আর শ্রীলংকায় রয়েছে একটি করে।

পাকিস্তান-চীন সশস্ত্র ড্রোন চুক্তির তাৎপর্য

পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে ৪৮টি সশস্ত্র ড্রোন – উইং লুং টু কিনতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। চীনের জন্য এটা বৃহত্তম ড্রোন চুক্তি। গ্লোবাল টাইমস এবং চীনের রাষ্ট্রায়ত্ব বার্তা সংস্থাগুলো এ সংবাদ নিশ্চিত করেছে। রিপোর্টে চুক্তির মূল্য বা ড্রোন সরবরাহের সময়সীমা সম্পর্কিত বিস্তারিত কোন তথ্য দেয়া হয়নি। তবে পাকিস্তান অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্স কামরা এবং চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রিয়াল (গ্রুপ) কোম্পানির অ্যাভিয়েশান ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশান ভবিষ্যতে যৌথভাবে এগুলো তৈরি করবে।

উইং লুং টু ড্রোন হলো উইং লুং ওয়ান মনুষ্যবিহীন আকাশযানের উন্নত সংস্করণ। মধ্যম উচ্চতায় দীর্ঘ সময় উড়তে সক্ষম এই ড্রোনগুলো তৈরি করেছে চেংদু এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রিয়াল (গ্রুপ) কোম্পানি। উইং লুং টু বোমা এবং এয়ার-টু-সার্ফেস মিসাইল বহনে সক্ষম। এই ড্রোন ৪৮০ কেজি পর্যন্ত গোলাবারুদ বহন করতে পারে। একটানা ২০ ঘন্টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩৭০ কিলোমিটার গতিবেগে উড়তে পারে এটা। রাতে তথ্য সংগ্রহের জন্য এতে ইনফ্রারেড ক্যামেরা সংযুক্ত রয়েছে।

ভূমি থেকে রিমোট সিস্টেমের মাধ্যমে এই ইউএভি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মার্কিন প্রেডেটোর এবং র‍্যাপার ড্রোনের তুলনায় চীনের উইং লুং টু অনেক পিছিয়ে আছে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র কেনার ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় চীন তাদের পণ্যের জন্য বিভিন্ন ক্রেতা পেয়ে গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে মিশর, উজবেকিস্তান এবং এখন পাকিস্তান।

আমেরিকান ড্রোন এবং চীনা ড্রোনের মধ্যে দামের পার্থক্যও অনেক। আমেরিকার চেয়ে চীনা ড্রোনের দাম প্রায় দুই মিলিয়ন ডলার কম। ভারতের সামরিক বিশেষজ্ঞরা এই চুক্তির সম্ভাব্য হুমকি নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন নন। কারণ এস-৪০০ প্রতিরক্ষা সিস্টেম চুক্তির পর কৌশলগত অগ্রগতির দিক থেকে এগিয়ে গেছে ভারত। তাছাড়া নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং ওয়ার্কিং সীমানা বরাবর অধিকাংশ সক্রিয় সীমান্ত এলাকায় অপ্রত্যাশিত উড়ন্ত যান চিহ্নিত করার জন্য পর্যাপ্ত নজরদারি সিস্টেম বসানো আছে তাদের।

তাছাড়া ভারতের বহরে ইসরাইলের তৈরি হেরোন সশস্ত্র ড্রোন রয়েছে। হেরোন ড্রোনগুলো ২৪ ঘন্টার বেশি সময় ধরে একনাগারে উড়তে সক্ষম ৩২০০০ ফুট উচ্চতা দিয়ে উড়তে পারে এটা। ইসরাইলের এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রির মতে এগুলোর উড়ার সময়কাল ৪০ ঘন্টারও বেশি এবং তাদের দাবি অনুযায়ী এগুলো এক টানা ৫২ ঘন্টা পর্যন্ত উড়েছে। সর্বোচ্চ ৩০০০ কিলোমিটার রেঞ্জের এই ড্রোনগুলো সর্বোচ্চ ২৫০ কেজি পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারে। একাধিক মিশনের জন্য একাধিক বোঝা বহন করতে পারে এই ড্রোনগুলো।

পাকিস্তানে নিজস্বভাবে ড্রোন তৈরির কাজ প্রায় এক দশক ধরে চলে আসছে এবং শাহপার এবং ইউকিউএবি ড্রোন তৈরি করেছে তারা। এই উভয় ড্রোনই নিজেদের সীমানার মধ্যে নজরদারির জন্য উপযোগী। শাহপার ড্রোনগুলো ৫০ কেজি পর্যন্ত বোঝা বহন করতে পারে।

তবে, এগুলো মাত্র ছয় ঘন্টা আকাশে উড়তে পারে, সর্বোচ্চ রেঞ্জ ২৫০ কিলোমিটার। তাই সময়ের দাবি পূরণের জন্য তাদের আরও আধুনিক ড্রোন প্রয়োজন। তাই চীনের কাছ থেকে উইং লুং টু ড্রোন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে এটা পাকিস্তানের ড্রোন গবেষণাকেও আরো এগিয়ে নেবে।


আরো সংবাদ



premium cement