১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পাক-ভারত বিরোধের বলি সার্ক

পাক-ভারত বিরোধে মুখ থুবড়ে পড়েছে সার্ক - ছবি : সংগৃহীত

পাক-ভারত বিরোধের কারণে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) মুখ থুবড়ে পড়েছে। দুই বছর ধরে চেষ্টা করেও ইসলামাবাদ ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করতে পারছে না। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগ তুলে বিশেষ করে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানকে সাথে নিয়ে ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের বিরোধিতা করছে ভারত। সার্ক সনদ অনুযায়ী পাকিস্তানের সম্মতি ছাড়া অন্য কোনো সদস্য দেশে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা সম্ভব নয়। পাকিস্তান বলেছে, সম্মেলন যদি হতেই হয়, ইসলামাবাদেই হবে।

সার্কের তৎপরতা বর্তমানে কাঠমান্ডুতে বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম এবং বিশেষায়িত সংস্থাগুলোর সাথে সার্ক মহাসচিবের সাক্ষাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সংস্থাটির কারিগরি, সচিব বা মন্ত্রী পর্যায়ের কোনো বৈঠক হচ্ছে না। শীর্ষ সম্মেলন না হওয়ায় নেপাল এখনো সার্কের চেয়ারম্যানশিপ পাকিস্তানকে হস্তান্তর করতে পারেনি।

অন্য দিকে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কর্মতৎপরতায়ও ভাটা পড়েছে। পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা এগিয়ে নিতে ভারতের উদ্যোগে বিবিআইএন গঠিত হয়েছিল। ২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে সার্কের সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনে মোটর ভেইক্যাল অ্যাগ্রিমেন্টের (এমভিএ) বিরোধিতা করেছিল পাকিস্তান। ফলে এমভিএ চুক্তি চূড়ান্ত করেও সেই সম্মেলনে তা সই করা সম্ভব হয়নি। এর বিকল্প হিসেবে ভারত বিবিআইএন এমভিএ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভুটানের পার্লামেন্ট সেটি অনুমোদন করেনি। এখন ভুটান অবশ্য তাদেরকে বাদ রেখেই বিবিআইএনের অন্য তিনটি দেশকে এমভিএ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও কোনো অগ্রগতি নেই।

এ ব্যাপারে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেন, সার্ক এখন বেকায়দায় আছে, অথচ আঞ্চলিক সহযোগিতার বাহন হিসেবে সার্কের মতো একটি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সফলতা নির্ভর করে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সক্রিয়তার ওপর। সদস্য রাষ্ট্রগুলো জোটকে কিভাবে দেখতে চায়, কতটা ক্ষমতা দিতে চায়, কতটা কার্যকর করতে চায়- তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তাদের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব থাকলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারে না।

তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অভিন্ন কিছু ইস্যু বা চ্যালেঞ্জ আছে, যা নিয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। দারিদ্র্যবিমোচন, স্বাস্থ্যসেবা, যাতায়াতব্যবস্থা বা পরিকাঠামোর উন্নয়নে আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রয়োজন। এই প্রয়োজনটা সদস্য দেশগুলো সমভাবে উপলব্ধি করতে পারলে সার্কের মতো আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান কার্যকর হবে।
হুমায়ুন কবির বলেন, সার্ককে পরিত্যাগ না করে প্রতিষ্ঠানটিকে কিভাবে আরো কার্যকর করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে ভালো হতো। সার্ক এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি তুলে ধরতে পারেনি। তবুু একটা সহযোগিতার কাঠামো টিকে থাকুক, তা এ অঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশা।

বিবিআইএন সম্পর্কে তিনি বলেন, দুঃখজনকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ নানা কারণে ইতিবাচক ভাবনাকে শক্তিশালী করতে পারছে না। কিন্তু ইতিবাচক ভাবনা নিয়ে না এগোলে কোনো আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানই বেশি দূর যেতে পারবে না। আঞ্চলিক সহযোগিতার অভিন্ন ক্ষেত্র খুঁজে বের করে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে সফলতা মিলবে না।

ইসলামাবাদ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের মাত্র দুই মাস আগে ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের উরিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর ভয়াবহ সশস্ত্র হামলা হয়। হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জয়েশ-ই-মুহাম্মদকে দায়ী করে ভারত। এর পরই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সার্কের অন্য দেশগুলোকে একজোট করতে তৎপর হয় দিল্লি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগ তুলে প্রথমে ভারত, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান এবং পরে ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান ইসলামাবাদ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বর্জনের ঘোষণা দেয়। সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান ক্ষমতা নেয়ার পর পাক-ভারত উত্তেজনা হ্রাসে নতুন উদ্যোগ নেয়া হবে বলে আশা করা হয়েছিল। বিশেষ করে গত মাসে নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে পাকিস্তান ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু ‘আলোচনা ও সন্ত্রাসবাদ একসাথে চলতে পারে না’- এমন মন্তব্য করে ভারত শেষ মুহূর্তে এ বৈঠক বাতিল করে। অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের কোনো সম্ভাবনা দেখা না যাওয়ায় সার্কের ভাগ্যও ঝুলে রয়েছে। 

সার্কের বিকল্প হিসেবে এখন বিমসটেককে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইছে ভারত। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে বিমসটেক গঠিত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর ভারতের গোয়ায় বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ব্রিকসের (ব্রাজিল-রাশিয়া-ভারত-চীন-দক্ষিণ আফ্রিকা) সাইডলাইনে বিমসটেক আউটরিচের আয়োজন করা হয়। এতে বিমসটেকভুক্ত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। গত ৩০ ও ৩১ আগস্ট কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত হয় বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন।

এতে আঞ্চলিক বিদ্যুৎ গ্রিড স্থাপনসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়। সম্মেলনের পরপরই ভারত বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোকে পুনেতে একটি সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু ‘বিমসটেকের আওতায় সামরিক সহযোগিতা নেই’- এই যুক্তিতে নেপাল মহড়ায় অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে। আর থাইল্যান্ড এই মহড়ায় যোগ দেবে না বলে আগে থেকেই জানিয়েছিল। ভারতে সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে নেপালের অস্বীকৃতি চীনের সাথে দেশটির ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার জের বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে নেপাল ও ভুটান ভারতের একচ্ছত্র প্রভাববলয় থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে। ভূমিবেষ্টিত হওয়ায় দেশ দু’টিকে আমদানি-রফতানির জন্য কেবলমাত্র ভারতের ওপরই নির্ভর করতে হয়। এ অবস্থায় নেপালকে আমদানি-রফতানির বিকল্প পথ দিয়েছে চীন। আর ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত রাজনৈতিক দল ভুটানের ক্ষমতায় এসেছে। ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতার উদ্যোগগুলো জটিলতার মধ্যে রয়েছে।

এর বাইরে চীন একটি উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার উদ্যোগ নিয়েছে। বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার) অর্থনৈতিক করিডোর নামে এটি পরিচিত। এই উদ্যোগের মাধ্যমে চীন তার ভূমিবেষ্টিত দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে ইউনান প্রদেশকে বিসিআইএমের অন্যান্য দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর সাথে যুক্ত করতে চায়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে বিসিআইএমের আওতায় একটি কার র‌্যালি কলকাতায় শুরু হয়ে ঢাকা-সিলচর (আসাম), ইম্ফল (মনিপুর), মান্দালয় (মিয়ানমার) হয়ে ইউনানের রুইলিতে পৌঁছায়। এই র‌্যালির মাধ্যমে চীন প্রাচীন সিল্ক রুট আবারো চালুর সম্ভাবনা তুলে ধরে। তবে বিসিআইএম উদ্যোগও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতা থেকে বের হতে পারেনি। এই প্রতিযোগিতার কারণে বিসিআইএম নিয়ে সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছে ভারত।


আরো সংবাদ



premium cement