১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যে কারণে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে ভারত

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি - সংগৃহীত

কাঠমান্ডুতে বিমস্টেক সম্মেলনে যোগ দিয়ে ফিরে আসার পরই বড় এক ধাক্কা খেলেন মোদী, ধাক্কা খেলো তাঁর সরকার। কথা ছিল ভারতে সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ের যৌথ মহড়ায় শামিল হবে বিমস্টেকভুক্ত সাতটি দেশ। শেষ মূহুর্তে নেপাল ও থাইল্যান্ড বেঁকে বসলো।

ফলে দিল্লি পড়ে যায় অস্বস্তিতে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমনকল্যাণ লাহিড়ি মনে করেন, এর কারণ মোদী সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং চীনের প্রভাব।

সাম্প্রতিক বিমস্টেক সম্মেলনে যোগ দিয়ে আসার পর মোদী সরকার নেপাল ও থাইল্যান্ডের কাছ থেকে এটা আশা করেনি। বিমস্টেক অধিবেশনে একটা বড ইস্যু ছিল সন্ত্রাস। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে বিমস্টেক দেশগুলির সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ঠিক ছিল এ মাসেই ভারতের পুনেতে বিমস্টেকভুক্ত ৭টি দেশের (ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা ও ভুটান) যৌথ সামরিক মহড়ায় যোগ দেবে। তাতে বিমস্টেকের প্রত্যেকটি দেশ পাঠাবে পাঁচজন অফিসারসহ তিরিশ জনের সেনাদল। তাতে রাজি হয়েও শেষ মূহুর্তে নেপাল ও থাইল্যান্ড পিছু হটলো। জানিয়েছে, তারা সেনা পাঠাতে পারবে না৷ বড়জোর পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারে।

এই ধরনের উত্তর বিশেষ করে নেপালের কাছ থেকে দিল্লি আশা করেনি, কারণ, নেপাল ঐতিহাসিক এবং অর্থনৈতিক কারণে চিরদিনই ছিল ভারতের ঘনিষ্ট বন্ধু। কাছের দেশ নেপাল অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক চাপের যে কারণটা দেখিয়েছে, কূটনৈতিক দিক থেকে তা ধোপে টেকে না। কারণ, এই সেপ্টেম্বর মাসেই ভারতের নাকের ডগা দিয়ে চীনের সঙ্গে ১২ দিনের সামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে নেপাল। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে চীনের চেংডুতে সাগরমাথা ফ্রেন্ডশিপ মহড়ায় যোগ দিচ্ছে নেপাল।

চলতি বছরে ক্ষমতায় আসার পর নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে.পি ওলি দেশের পররাষ্ট্র নীতিতে চীনকে অগ্রাধিকার দেবার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, একটি দেশের উপর নির্ভর করতে চায় না নেপাল। গত কয়েক মাসে নেপাল যে ক্রমশই ঝুঁকেছে চীনের দিকে, সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। কিছুদিন আগেই চীন নিজেদের বন্দর খুলে দিয়েছে নেপালের জন্য। পরিবহণ ও যোগাযোগ বাড়াতে চীন-নেপাল সমঝোতাপত্র সই হয় আর তারপরই ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী যৌথ সামরিক মহড়া বয়কট করলো নেপাল।

এর সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এর পেছনে দুটো দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে। একটা জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি, আরেকটা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি। জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে যেখানে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটেছে, সেখানে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি অনেকটা দূরে সরে গেছে উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে। যেমন জার্মানি, যেমন ইটালি, যেমন জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। এখনো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার অনেক দেশ জাপান থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। যদিও জাপান সেটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে আমরা দেখছি, বিগত কয়েক বছরে ভারতের রাজনীতিতে একটা উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ভারতকেন্দ্রিক মতবাদ বা অন্য মতাদর্শের প্রতি অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটেছে। এটা ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর। এর কারণে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সার্কের বিভিন্ন আলোচনায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং শ্রীলংকার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে।'

‘বর্তমানে নেপালের উপর চীন ও পাকিস্তানের প্রভাব যথেষ্ট বেশি। চীন থাকলে পাকিস্তানের প্রভাবও থাকে। নেপালের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ যেমন, রাস্তাঘাট নির্মাণের যৌথ উদ্যোগ তৈরি হয়ে গেছে। লাসা থেকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত রাস্তা তৈরি সমস্ত কিছুই হচ্ছে চীনের উদ্যোগে। এটা ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর। নেপাল একটা রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। ভারত যদি প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে চায়, তাহলে বিশেষ পরিকল্পনার প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দুটোকে মিলিয়ে একটা পররাষ্ট্রনীতি দরকার। বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে ভারত যদি আলাদা হতে না চায়' বললেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ি৷

নেপালের এই অবস্থান ভালো চোখে দেখছে না দিল্লি। কড়া বার্তা দিয়ে সে কথা জানিয়েছে, অভ্যন্তরীন বাধ্যবাধকতা একটা অজুহাতমাত্র, কারণ, ওলি সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। দিল্লি অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো পর্যন্ত কোনো প্রতিবাদপত্র পাঠায়নি। দিল্লির নেপালী দূতাবাসও এই নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। তবে কূটনৈতিক মহল মনে করছে, ভারত-নেপাল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যথেষ্ট চাপের মধ্যে রয়েছে। নেপালের স্বার্থে ভারত-নেপাল ভৌগোলিক অবস্থানকে অস্বীকার করা যায় না। 

পাশাপাশি প্রতিবেশী মলদ্বীপের সঙ্গেও চলছে ভারতের সংঘাত। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘকালীন দ্বিপাক্ষিক সুসম্পর্ক আজ পদে পদে বিপন্ন। অথচ ১৯৬৫ সালে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের স্বাধীনতাকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল ভরত। প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল ভারত। অর্থনৈতিক বিকাশে সাহায্যের দুই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারত। ২০০৪ সালের সুনামিতে বিধ্বস্ত মালদ্বীপে প্রথম ত্রাণ সাহায্য নিয়ে যায় দিল্লি। রাজনৈতিক জরুরি অবস্থায় বিরোধী দলগুলি চেয়েছিল ভারত হস্তক্ষেপ করুক। কিন্তু দিল্লি সেই ঝুঁকিটা নিতে ইতঃস্তত করেছিল। বর্তমান মালে সরকার তখন থেকেই চীনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। সম্প্রতি মালদ্বীপে মোতায়েন ভারতীয় হেলিকপ্টার সরিয়ে নিয়ে যেতে বলেছে মালদ্বীপের নতুন সরকার। অন্যদিকে চীন সেখানে বানাচ্ছে নতুন বিমানঘাঁটি। এর মূল কারণ ঐ একটাই। শক্তিশালী চীনের ছায়া এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে দৃঢপ্রতিজ্ঞ। তা সে শ্রীলংকা হোক, নেপাল হোক, ভূটান হোক, বাংলাদেশ হোক বা মালদ্বীপ।


আরো সংবাদ



premium cement