২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভারতীয় রাজনীতিকের শেষকৃত্য নিয়ে তুলকালাম

হাইকোর্টে জয় পেতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন করুণানিধির পুত্র এম কে স্ট্যালিন। - ছবি : সংগ্রহ

তামিলনাড়ুর পরলোকগত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর শেষকৃত্য নিয়ে জটিলতা কেটেছে আদালতের রায়ে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে এ সংক্রান্ত অভিযোগের শুনানি শুরু হয় হাইকোর্টের বিচারপতির বাড়িতে। শেষে বুধবার সকালে রায় দেয় হাইকোর্ট। মেরিনা বিচেই করুণানিধির শেষকৃত্যের অনুমতি দেয় আদালত।

এর আগে মঙ্গলবার তামিলনাড়ু সরকার মেরিনা বিচে করুণানিধির সমাধিস্থল তৈরির অনুমতি না দেওয়ার পরই আদালতের দ্বারস্থ হয় তার দল ডিএমকে। মধ্যরাতে শুনানি শুরু হয় বিচারপতির বাড়িতে; কিন্তু রাতে শুনানি শেষ হয়নি। এ দিন সকালে বিচারপতি জানতে চান, পরলোকগত আরেক মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার সমাধির ক্ষেত্রে কি অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল? সেই অনুমোদনের নথিও দেখাতে বলে আদালত; কিন্তু তা দেখাতে পারেনি রাজ্য সরকার। এর পরই আদালত মেরিনা সৈকতে আন্না সমাধিস্থলেই করুণানিধির শেষকৃত্যের অনুমতি দেয়।

হাইকোর্টে জয় পেতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সদ্য পরলোকগত ভারতীয় রাজনীতিক করুণানিধির পুত্র এম কে স্ট্যালিন। রাজাজি হলে মাদ্রাজ হাইকোর্টের রায়ের খবর পৌঁছতেই কান্নায় মুখ ঢাকেন তিনি। তাঁকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দেন ডিএমকে নেতা এ রাজা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাজাজি হলে গিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন করুণনিধিকে। কানিমোঝি, স্ট্যালিন-সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথাও বলেন তিনি।

মেরিনা বিচেই করুণানিধির শেষকৃত্যের অনুমতি দিল মাদ্রাজ হাইকোর্ট। নজিরবিহীনভাবে মধ্যরাতে শুনানি শুরু হলেও তা শেষ হয়নি। অবশেষে বুধবার সকালে আদালত জানিয়ে দিল, মেরিনা সৈকতে আন্না মেমোরিয়ালেই করুণানিধিকে সমাধিস্থ করা যাবে। আজই সম্পন্ন হবে প্রয়াত ডিএমকে প্রধানের শেষকৃত্য। আদালতের রায়ে স্বাভাবিক ভাবেই মুখ পুড়েছে তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে সরকারের।

তামিলনাড়ুর পরলোকগত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর লাশ রাখা হয় রাজাজি হলে। সেখানেই শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন রাজনীতি, সিনেমা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টরা। বিভিন্ন রাজ্যের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদরা। মঙ্গলবারই চেন্নাই পৌঁছেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সূত্র : আনন্দ বাজার

পূর্বেকার খবর:  ভারতের রাজনীতির এক নক্ষত্রপতন
মুথুভেল করুণানিধি। এই নামটিই যথেষ্ট গোটা তামিল ভাবাবেগের কাছে। ১৯২৪ সালে জন্ম এই তামিল পুত্রের। যিনি একাধারে আঁকতে পারতেন, লিখতে পারতেন চিত্রনাট্য। তামিল ফিল্ম জগতে এভাবেই তার প্রথম প্রবেশ। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি প্রতিভা। নিজেকে এমনভাবেই তৈরি করেছিলেন যে তামিলবাসীরা তাকে দেখে বলতেন, আগুনকে কখনো ছাই দিয়ে চাপা দেয়া যায় না। হয়তো এটাই সত্যি। কারণ তামিল সাহিত্য জগতে তার অবদান এককথায় অনস্বীকার্য। তাঁর লেখা গল্প, নাটক, উপন্যাস তাকে পৌঁছে দিয়েছিল তামিলনাড়ুর মানুষের মনের মণিকোঠায়। নিজের আবেগ দিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় জাতির কষ্টের কথা। ঠিক করেছিলেন কিছু একটা করতে হবে। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। ১৯৬৯–২০১১ পর্যন্ত নানা সময়ে পাঁচবার মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি তাকে তুলে দিয়েছিলেন তামিলনাড়ুর মানুষ। আর টানা দশবার ডিএমকে দলের সভাপতি। কিন্তু তার মাঝে রয়েছে অনেক অজানা ইতিহাস।

তামিলনাড়ুর নাগাপট্টিনাম জেলার তিরুকুভালাই গ্রামে জন্ম করুণানিধির। স্কুল জীবনেই তার সাহিত্য প্রতিভা প্রকাশ পায়। জাস্টিস পার্টির নেতা আজাহাগিরিস্বামীর বক্তব্য তার জীবনে রাজনৈতিক আবেগের ঝড় তুলে দেয়। তাই মাত্র ১৪ বছর বয়সে সামাজিক আন্দোলনে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন। কিছুদিন বাদে তৈরি করেন অল স্টুডেন্টস ক্লাব। দ্রাবিড় আন্দোলনের এটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। তারপর ১৯৫৩ সাল, তৈরি হয় ডিএমকে (‌দ্রাবিদা মুন্নেত্রা কাঝাগাম)‌। দলের মুখপত্র মুরাসোলি কাগজে লিখতে শুরু করেন তামিল রাজনীতি থেকে জাতীয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষণ। ভাষ্যকার হতেও সময় লাগেনি তার। কাল্লাকুড়ি আন্দোলন তাকে তামিল রাজনীতিতে জনপ্রিয় করে তোলে।


শিল্প শহরের আসল নাম ছিল কাল্লাগুড়ি। কিন্তু সেখানে সিমেন্টের প্রকল্প তৈরির নামে শহরের নাম বদলে করে দেয়া হয় কাল্লাক্কুড়ি থেকে ডালমিয়াপুরম। শুরু হয় করুণানিধির আন্দোলন, পথ অবরোধ, ট্রেন অবরোধ, বিক্ষোভ। এই আন্দোলনের ফলে দু’‌জন মারা যায়। গ্রেফতার হন করুণানিধি। ১৯৫৭ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে কুলিথালাই বিধানসভা আসন থেকে জয়ী হয়ে তামিলনাড়ু বিধানসভায় প্রবেশ করেন তিনি। তারপর একের পর এক সাফল্য রাজনীতির ময়দানে। ১৯৬২ সালের বিরোধী দলনেতা এবং ১৯৬৭ সালে তার হাত ধরে ক্ষমতায় আসে ডিএমকে। ১৯৬৯ সালে মুখ্যমন্ত্রী। যিনি ৭০ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা জরুরি অবস্থার প্রতিবাদ করেছিল একমাত্র শাসকদল হিসাবে। যার ফলে তার সরকারকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। বহু নেতাকে জেলে ভরাও হয়েছিল। কিন্তু তাতেও দমে যায়নি এই তামিল নেতা।

১৯৭০ সালে প্যারিসে তৃতীয় বিশ্ব তামিল সম্মেলনে তিনি বিশেষ বক্তব্য রাখেন। তারপরই ১৯৭১ সালে আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডক্টরেট দেয়। তামিল বিশ্ববিদ্যালয় তাকে রাজা রাজন পুরষ্কার দেয়। ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর মাদুরাই কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ও তাকে সাম্মানিক ডক্টরেট দেয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও তাকে ইয়ারান–ই–মিলাথ সম্মানে ভূষিত করা হয়। রাজাকুমারি, পরাশক্তি, অভিমন্যু, মনোহরা, পানাম, কাঞ্চি থালাইভান সহ–অনেক বিখ্যাত ও কালজয়ী সিনেমার চিত্রনাট্য লিখে তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন। ১৯৪৭–২০১১ সময়কালে একের পর এক কালজয়ী সৃষ্টি করেছেন তিনি। যার মধ্যে পোন্নর শঙ্কর ঐতিহাসিক সিনেমা হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।

তবে বিতর্কও ছিল তাকে ঘিরে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী হত্যায় যুক্ত এলটিটি’‌র সঙ্গে যোগ, রামসেতু নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য এবং ভীরানাম প্রকল্পের দুর্নীতি। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল তার একদিকে পাণ্ডিত্য ও অন্যদিকে রাজনৈতিক উত্থান। যা তিনি তামিল নাগরিকদের জন্য রেখে গেলেন। শনিবার তিনি পরলোকে পাড়ি জমালেন। আর তাকেও চোখের পানিতে শেষ বিদায় জানালো তামিলবাসী।


আরো সংবাদ



premium cement