২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

একাধিক ভারতীয়সহ ৫ অবৈধ সন্তানের জনক ইমরান খান: রেহাম খান

ইমরান খান ও রেহাম খান। ছবি - সংগৃহীত

পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ও সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের পাঁচটি অবৈধ সন্তান আছে বলে দাবি করেছেন তার সাবেক স্ত্রী রেহাম খান। রেহাম ছিলেন ইমরান খানের দ্বিতীয় স্ত্রী। ১০ মাসের মাথায় এ জুটির বিচ্ছেদ ঘটে।

বৃহস্পতিবার রেহাম খানের আত্মজীবনী নিয়ে লেখা বইটির ই-বুক অ্যামাজনে প্রকাশ করা হয়েছে। বইটিতে সাবেক তারকা ক্রিকেটার ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা ইমরান খানের বিতর্কিত জীবন উপস্থাপনা করেছেন তিনি। ‘রেহাম খান’নামে ওই বইয়ে তিনি ইমরানের সঙ্গে তার ১০ মাসের বিবাহিত জীবনের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরানের সঙ্গে দাম্পত্য জীবন সুখকর ছিল না, গেল মাসে এমন তথ্য প্রকাশ করে দেশ ও দেশের বাইরে হৈচৈ ফেলে দেন।

বইয়ের একটি অধ্যায়ে তিনি বিয়ের পর ইমরান খানের সঙ্গে তার একটি কথোপকথন হুবহু তুলে ধরেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, ইমরান তার অবৈধ পাঁচ সন্তান থাকার কথা স্বীকার করেছেন। যাদের একাধিক জন ভারতীয় এবং সবচেয়ে বড়জনের বয়স ৩৪। নিজেদের বিবাহিত জীবন রক্ষা করতে ওই সব নারীরা ইমরানের সঙ্গে তাদের সন্তান থাকার বিষয়টি জনসম্মুখে আনছেন না বলেও দাবি করেন রেহাম।

বইয়ের কথোপকথন:

রেহাম: কি? তোমার পাঁচটি অবৈধ সন্তান আছে? তুমি কিভাবে জানো?

ইমরান: তাদের মায়েরা আমাকে বলেছে

রেহাম: তারা সবাই শ্বেতাঙ্গ?

ইমরান: না, কেউ কেউ ভারতীয়। সবচেয়ে বড়জনের বয়স এখন ৩৪।

এই বই লেখার কারণ ব্যাখ্যায় রেহাম বলেন, হয়তো তার অভিজ্ঞতা অন্যকারো কাজে লাগবে।

গত জুনে রেহামের পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ অনলাইনে ফাঁস হয়েছিল। এরপর থেকেই এ নিয়ে আলোচনা সমোলোচনা শুরু হয়। যা নিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় উঠে।

পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের অনেক নেতা মনে করেন, অযোগ্য ঘোষিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দলের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে ইমরানকে ছোট করতে তার সাবেক স্ত্রী রেহাম এই বই লিখেছেন।

 

আরো দেখুন : এবার কি পারবেন ইমরান খান?

ইমরান খান। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া ৬৫ বছর বয়স্ক ইমরান ২২ বছর ধরে আরো ভালো, নতুন পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। রসালো কৌতুকে ভরা বক্তৃতা দিয়ে পাকিস্তানের অন্যতম শক্তিশালী দলটির নেতা শ্রোতাদের মুগ্ধ করতে পারলেও এখন পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট আদায় করতে পারেননি। তবে আশা ছাড়েননি কখনো। বরং আসন্ন নির্বাচনে তিনি বেশ আস্থাশীল হয়ে ওঠেছেন। অনেকেই মনে করতে শুরু করে দিয়েছেন, অবশেষে পারবেন তিনি। সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদ তার ওপর আছে বলেও অনেকে মনে করে থাকে। ভিন্ন মতও আছে অনেকের।

অতীতের প্লেবয় ইমেজের বিপরীতে আজকাল ইমরানের কাজকর্মে ধর্মের প্রতি ঝোঁক স্পষ্টভাবে দেখা যায়। সভা-সমাবেশে তিনি পবিত্র কোরআনের আয়াত তেলায়াত করেন, নবীজীর শিক্ষার নজির দেন। দুইবারের তালাকপ্রাপ্তা যে বুশরা মানেকাকে সম্প্রতি ইমরান বিয়ে করেছিলেন, তিনি দক্ষিণ পাঞ্জাবের পরিচিত এক রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য, তিনি নিজেও আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি পর্দার বিধান মেনে চলেন, অথচ ইমরানের আগের দুই স্ত্রী ছিলেন এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তার প্রথম স্ত্রী জেমিমা ছিলেন ইহুদি বংশোদ্ভূত। ইমরানের প্লেবয় ইমেজের সাথে মানানসই ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় স্ত্রী রেহাম খান ততটা না হলেও খুব রক্ষণশীল ছিলেন না। এরপর তিনি যাকে বিয়ে করেছেন, সেই বুশরা পুরোপুরি রক্ষণশীল। অনেকে মনে করছেন, রক্ষণশীল ভোটারদের মন জয় করতেই এ কাজটি করেছিলেন ইমরান।

ধর্মের প্রতি অনুরাগ ছাড়াও ক্রিকেটার হিসেবে তার বিজয়, লোকহিতৈষী কাজে তার অবদান, দুর্নীতি ও পাকিস্তানের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের প্রতি তার কঠোর নিন্দাবাদ তার ভোটারদের আকৃষ্ট করার অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। তার সভা-সমাবেশে লোকজনের উপস্থিতি ক্রমাগত বাড়ছেই।

এখন তিনি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে চূড়ান্ত সফলতা তথা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খুব কাছাকাছি রয়েছেন। আগামী ২৫ জুলাই পাকিস্তানে উপর্যুপরি দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক পালাবদল হতে যাচ্ছে। ইমরান খান মনে করছেন, তার দল এই নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।

এপ্রিলে পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে রাজনীতিবিদ হিসেবে তার প্রথম দিকের সময়ের কথা স্মরণ করেন। তিনি তখন কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে তার দল পাকিস্তান মুভমেন্ট ফর জাস্টিজের (তেহরিক-ই-ইনসাফ- পিটিআই) হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে বলতেন। কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যান করতেন।

বর্তমানে তার দল দেশের অন্যতম শক্তিশালী দলে পরিণত হয়েছে। তার লক্ষ্য পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবে জয়লাভ। এখানেই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সবচেয়ে বেশি আসন রয়েছে। ফলে এটিই সব রাজনৈতিক দলের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

ইমরান মনে করেন, পাঞ্জাবে ক্ষমতার লড়াইয়ে দুটি দল রয়েছে। একটি হলো তার পিটিআই, অন্যটি নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন)। তবে তার মতে, নওয়াজের দল এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে।

পিটিআই মুখপাত্র ফাওয়াদ চৌধুরী দি ডিপ্লোম্যাটকে বলেন, চলতি বছর জাতীয় পরিষদের ২৭২টি আসনের জন্য ৪,১০০ জন আবেদন করেছেন।

গত ২৯ এপ্রিল ইমরান খান আসন্ন নির্বাচনের জন্য তার ১১ দফা এজেন্ডা প্রকাশ করেন। তিনি মিনার-ই-পাকিস্তান সমাবেশে জনতার উদ্দেশে বলেন, তার পরিকল্পনা কার্যকর হলে একক বিচারব্যবস্থা, দারিদ্র্য বিমোচন ও গরিবদের জীবনমানের উন্নতি হবে।

তিনি দুর্নীতি দূর করে ও আন্তর্জাতিক ঋণ ফিরিয়ে দেওযার মাধ্যমে পাকিস্তানকে আত্ম-নির্ভরশীল করে গড়তে চান। তিনি সবার জন্য সুষম স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ দিতে চান।

ক্রিকেট অধিনায়ক থেকে এমপি

ইমরান খান পাকিস্তনের ক্রিকেট অধিনায়ক হিসেবে প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন। তার নেতৃত্বে পাকিস্তান ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জয় করে। পরে তিনি জনসেবায় নামেন। ১৯৯৬ সালে তিনি তার মায়ের নামে শওকত খানম মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল চালু করেন। এটিই পাকিস্তানের প্রথম ক্যান্সার হাসপাতাল। এটি পরিচালিত হয় দানের অর্থে।

দান সংগ্রহ করার সময়ই তার ভাষায় সবচেয়ে গরিব মানুষেরাই তার চোখ খুলে দিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, রাজনীতির মাধ্যমেই দেশের সত্যিকারের সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব।

তিনি ১৯৯৬ সালে জাতীয়তাবাদী দল পিটিআই শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে প্রথম জাতীয় নির্বাচনে দলটি অংশ নেয়। তবে ওইবার শোচনীয় অবস্থায় পড়ে তারা। একটি আসনও পাননি তিনি। তবে তিনি হান না ছেড়ে দল গঠনে মনোযোগী হন।

তারপর ২০০২ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের আমলে পিটিআই পায় মাত্র ১টি আসন। জিতেছিলেন ইমরান খান। জাতীয় পরিষদে তিনি স্বৈরতন্ত্র, দুর্নীতি ও মার্কিন ড্রোন আক্রমণের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন। তিনি পাকিস্তানের উত্তরাংশের ইসলামী চরমনপন্থীদের পক্ষে কথা বলার জন্য ‘তালেবান খান’ নামেও অবজ্ঞার শিকার হতেন।

তিনি জানান, সেনাবাহিনী যখনই কোনো বেসামরিক এলাকায় অভিযান নামে, তখনই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। তিনি পশতুদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার আহ্বান জানাতেন।

পিটিআই ২০০৮ সালের নির্বাচন বয়কট করে। তাতে আসিফ আলী জারদারির পিপিপি জয়ী হয়। তারা ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত শাসন করে। পিপিটির আমলে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ে পড়ে। দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ ও মুদ্রাস্ফীতি প্রবল আকার ধারণ করে।

এতে সুযোগ দেখতে পেলেন ইমরান খান। তার দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্য জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হলো। তরুণদের টার্গেট করতে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে দলটি। ২০১৩ সালে তার দল জাতীয় পরিষদে ৩৫টি আসন নিশ্চিত করে। এছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত খাইবার পাকতুনখাওয়া প্রদেশে তার দল জয়ী হয়। এই প্রদেশে তার দলই সরকার গঠন করে।

তারপর তিনি পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ১২৬ দিনের অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন। তার টার্গেট ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। তিনি তাকে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ হিসেবে অভিযুক্ত করেন। তবে তার চেষ্টা কাজে লাগেনি।

অবশ্য শেষ হাসি তিনিই হাসেন। ২০১৬ সালের এপ্রিলে পানামা পেপার্স ফাঁস হয়। তাতে নওয়াজের ছেলেদের নাম প্রকাশ পায়। এর জের ধরে ২০১৭ সালের জুলাইতে সুপ্রিম কোর্ট শরিফরেক বরখাস্ত করে।

ইমরান দাবি করেন, নওয়াজ শরিফ হলেন জেনারেল জিয়ার তৈরি পুতুল। সেনাবাহিনীই তাকে রাজনীতিতে এনেছে।

কেপি সরকার

ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হলে কিভাবে পাকিস্তান চলবে, তারই মডেল হিসেবে কেপিতে শাসনকাজ পরিচালনা করে কেপি নেতৃত্ব। দুর্নীতি দমন ও সুশাসন বাস্তবায়নের জন্য কেপি ১৫০টির বেশি বিল পাস করেছে, ১৬৮টি আইন প্রণয়ন করেছে। একটি অভিযোগ নিবন্ধনও প্রবর্তন করা হয়েছে। যাতে কেউ অভিযোগ দায়ের করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। কেপির ৫২ ভাগ লোক মনে করেন, প্রদেশটিতে দুর্নীতি কমেছে, ৩৯ ভাগ মনে করেন, অবস্থা আগের মতোই আছে। মাত্র ৮ ভাগ মনে করেন, দুর্নীতি আগের চেয়ে বেড়েছে।

বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা ইমরান খানের অনুকূলে মনে হলেও তিনি ক্ষমতায় এলে তার দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্য বাস্তবায়িত হবে কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তার বাগাড়ম্বরতা এমন একটি দেশ চালানোর জন্য যথেষ্ট কি, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সুস্পষ্ট প্রভাব থাকে, আর যাদের প্রতি তিনি অব্যাহতভাবে বিতৃষ্ণ? আন্তর্জাতিক ঋণে নিমজ্জিত পাকিস্তানের জন্য কি তার তহবিল সংগ্রহের কৌশল সহায়ক হবে?

আর যদি এই অধিনায়কের ওপর আস্থা রাখতে হয়, তবে বলতে হবে খেলা সম্ভবত এখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে।

এদিকে আবার রেহাম যে হারে ইমরানের বিরুদ্ধে গোলা নিক্ষেপ করছেন, তা তার কতটা ক্ষতবিক্ষত করতে পারে তা দেখার বিষয়। ইমরানের চরিত্র নিয়েই তিনি প্রশ্ন করছেন। পাকিস্তানের মতো সমাজে এরও কিছু প্রভাব পড়তে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়।


আরো সংবাদ



premium cement