২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘আমরা এই মাটির সন্তান, বাংলাদেশী বলবেন না’

দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার শঙ্কায় আসামের মুসলিমরা - ছবি : সংগ্রহ

২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর মধ্য রাতে আসামের মর্জিনা বিবির ঘুম ভাঙে দরজার টোকার শব্দে। বাইরে বের হয়ে দেখেন দুইজন নারী পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো কিছু পুলিশ এসে হাজির হয় সেখানে। তারা মর্জিনাকে তাদের সাথে যেতে বলে। পরের দিন তাকে কোকরাঝাড় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

মর্জিনা বারবার পুলিশসহ অন্যদের কাছে জানতে চান, তার কী অপরাধ, তার সাথে কেন এমন আচরণ করা হচ্ছে? কিন্তু জবাবে তাকে শুধুই চুপ থাকতে বলা হয়। পরে জানতে পারেন তাকে ‘সন্দেহপূর্ণ’ বা ডি-ভোটার হওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নয় মাস পর গত বছরের ১৭ জুলাই তিনি মুক্তি পান। এ পুরোটা সময় তিনি দুর্বিষহ জীবন কাটান। কারাগারে খাবারের মান ছিল খুবই নিম্ন। এ ছাড়া কয়েদিদের ভিড়ও ছিল প্রচুর। ছোট একটি কক্ষে ৫০-৬০ জন লোক থাকত। ঘুমানোর সময় তাদের মধ্যে ঝগড়া বেধে যেত।

ভুল পরিচয়
পরে জানা যায় অন্য গ্রামের মর্জিনা বেগমের জায়গায় ভুল করে তাকে এ শাস্তি দেয়া হয়েছিল। এরপর মর্জিনা বিবির মামলাটি হাতে নেয় আইনি সহায়তা দানকারী সংস্থা অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ)। তারা তার জামিনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু এত বড় ভুলের পরও সেখানকার পুলিশ এ কাজের জন্য ক্ষমা চায়নি বা ক্ষতিপূরণ দেয়নি। তবে এ ধরনের ঘটনা সেখানকার জন্য নতুন কিছু নয়।
আসামের রাজধানী গৌহাটির কাছাকাছি এক গ্রামে থাকতেন আইয়ুব আলী-রহিমা খাতুন দম্পতি। ১৯৯৭ সালে তাদের বৈধতা প্রমাণের নির্দেশ দেয় সন্দেহভাজন লোকজনদের নাগরিকতা নিশ্চিত করার জন্য গঠিত বিশেষায়িত আদালত ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালস (এফটিএস)। দীর্ঘ দিন লড়াই করার পর ২০১৫ সালে আইয়ুব আলীরা মামলায় হেরে গেলে তাদের পুলিশি হেফাজতে নেয়া হয়। এ দিকে সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘ দিন এ মামলা চালাতে তারা তাদের দোকানটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। এখন হাইকোর্টে লড়াই করতে তারা তাদের জমিও বিক্রি করে দিয়েছে।

স্বপ্নগুলো বিলীন হচ্ছে
তাদের ১৮ বছর বয়সী সন্তান রুহুল আমিন অনেক আগেই স্কুল ছেড়ে দিতে হয়েছে, একই অবস্থা তার ছোট ছেলেরও। অভাবের তাড়নায় কম বয়সেই বিয়ে দেয়া হয়েছে মেয়েটির। রুহুল আমিন কান্নাভেজা চোখে জানায়, আমার বয়সী ছেলেরা লেখাপড়া করছে। আমারও স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে জীবনের ভালো কিছু একটা করব। কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ হওয়ার নয়। তার ভয়, যদি আদালত তাকে বিদেশী বলে ঘোষণা দিয়ে গ্রেফতার করে, তাহলে তার ছোট ভাইটির কী হবে? যদি শেষ লড়াইয়ে তার বাবা-মা হেরে যায় তাহলে সারা জীবনই তাদের জেলের প্রকোষ্ঠে কাটাতে হবে। শুধু রুহুল আমিন নয়, তার মতো লাখো মুসলিমের এখনই একই শঙ্কা। এই অভিযোগে এখন আসামের ছয়টি কারাগারে ৮৯৯ জন আটক আছেন। মানবাধিকারকর্মীরা জানান, তথাকথিত বিদেশীদের চিহ্নিত করার নামে পুলিশি অভিযানের কারণে সেখানকার মানুষদের মধ্যে চরম ভীতি কাজ করছে।

অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিতকরণ
আসামে অভিবাসীদের চিহ্নিত করতে ১৯৫১ সাল থেকে কাজ করে আসছে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন (এনআরসি)। কিন্তু বর্তমানে ডি-ভোটারের আড়াই লক্ষাধিক মামলা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালসে ঝুলছে। মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের জীবনটা শেষ হবে কারাগারেই। আর এসব মামলা শেষ হতেও লেগে যাবে কয়েক প্রজন্ম। আবার ২০০৩ সালের পর এসব সন্দেহভাজনদের যেসব শিশু আসামে জন্ম নিয়েছে, তাদের ভারতের নাগরিক হওয়ার জন্য অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে, যা তাদের ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। কারণ তারা না শিক্ষার কোনো সুযোগ পাবে আর না সুযোগ পাবে কোনো চাকরি-বাকরিতে।
আসামে ২০১৬ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতা লাভ করে। তারা সেখানকার বাঙালিদের অনুপ্রবেশকারী বলে আখ্যা দেয়। এক বছরেই তারা ১৫ হাজার লোককে বিদেশী বলে ঘোষণা দেয়, যেখানে ১৯৮৫-২০১৬ সালের মধ্যে এ সংখ্যাটি ছিল ৯০ হাজার। রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপের কারণে সেখানে আত্মহত্যার হার বেড়ে গেছে।

প্রক্রিয়াগত ভুল
বিদেশী ঘোষণার এই প্রক্রিয়াতে কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট ভুল রয়েছে। কোনো ধরনের উপযুক্ত তদন্ত ছাড়াই তাদের বিদেশী ঘোষণা করা হচ্ছে। কিন্তু এ প্রক্রিয়াটিও এত ব্যয়বহুল যে, নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে তাদের সারা জীবনের অর্জন গচ্ছা দিতে হচ্ছে। প্রায় সময়ই যাদের ‘বিদেশী নয়’-এ বিষয়টি প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে, তারা হয়তো গরিব বা প্রান্তিক চাষি, যাদের দৈনিক উপার্জন ২৫০-৩৫০ রুপি। কিন্তু আদালতের সমনের জবাবে তাদের যে ফি পরিশোধ করতে হয় তা ৫০ হাজারেও গিয়ে ঠেকে।

প্রকৃত নাগরিকেরাও হয়রানির মুখে
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ৩০ বছর কাজ করা আজমাল হককেও সম্প্রতি তার নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বলা হয়। তিনি তা প্রমাণও করেন। কিন্তু সবার জন্য বিষয়টি এত সহজ নয়। যেমন- সরকারি স্কুলের শিক্ষক শাজাহান কাজিকে ১৯৯৭ সালে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তার বিষয়টি সমাধান করতে সময় লেগে যায় ২০ বছর। এ সময়টিতে তার ভোটাধিকারসহ অন্যান্য অধিকার স্থগিত ছিল।
এ বিষয়টি দেশের সংবিধানের ১৪, ১৯ ও ২১ নং অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করছে। যেগুলোতে বলা হয়েছে, সঠিক প্রক্রিয়া ছাড়া কারো জীবন বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কোনোভাবেই খর্ব করা যাবে না। কিন্তু এ অনুচ্ছেদগুলো লঙ্ঘন করে যেনতেনভাবেই হয়রানি করা হচ্ছে অনেককে। বিশেষ করে বাংলাভাষীরা অধিক হারে পুলিশের বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

অভিযোগ অস্বীকার পুলিশের
আসামের নাগরিকেরা বিশেষ করে বাংলাভাষীরা পুলিশের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ করলেও পুলিশ কর্তৃপক্ষ এসব আমলে নিতে নারাজ। তারা বলেন, আমরা তদন্তের মাধ্যমে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই কারো ব্যাপারে পদক্ষেপ নিই। এ ক্ষেত্রে ভাষাগত বা ধর্মীয় কোনো বিশেষ বিবেচনায় কারো বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কোনো সুযোগ নেই বলেই আলজাজিরাকে জানান আসাম বর্ডার পুলিশের প্রধান রওনক আলি হাজারিকা।

আদিবাসী না বহিরাগত
তিন কোটি ২০ লাখ মানুষের আসামে এক-তৃতীয়াংশই মুসলিম, যাদের আবার বেশির ভাগ বাঙালি বংশোদ্ভূত। ১৮২৬ সালে অহম রাজার কাছ থেকে ব্রিটিশরা আসাম কব্জা করে নেয়ার পরই বাঙালি চাষিরা সেখানে পা রাখেন। কিছুকাল পরে আসাম আবারো আবাদি হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ নীতির ভিত্তিতে আসামে লাখ লাখ বাঙালি বসত গড়ে। আসামের ঊর্বর ভূমি কেবল বাংলা থেকে নয়, বরং বিহার ও উড়িষ্যা রাজ্য মানুষকে আকৃষ্ট করে। ১৯৩০ সালে ‘খাদ্য উৎপাদন বাড়াও’ প্রকল্পের জন্য সাইয়েদ মোহাম্মদ সাদুল্লাহ সরকার বাঙালি অভিবাসীদের সেখানে আনার নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু পরেব বিষয়টি আদিবাসী না বহিরাগত এই ইস্যুতে পাল্টে যায়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর দুই লক্ষাধিক বাঙালিকে পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করার চেষ্টা চলে। সে সময় থেকেই প্রশ্ন ওঠে ভারতে বাংলাদেশী অভিবাসী : বিদেশী, শরণার্থী না অনুপ্রবেশকারী। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আসামিজ আদিবাসীদের বিপরীতে বাঙালিদের ভূমিদস্যু বা দখলদার হিসেবে চি‎হ্নিত করা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে বলা হয়েছিল, বহিরাগতদের সরাও। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ভারতের অন্য প্রদেশ থেকে আসা ভারতীয়দেরও। এরপর বলা হয়েছিল বিদেশীদের সরাও। তখন এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল নেপালি ও বাংলাদেশীদের। এখন তারা বাঙালি হিন্দুদের বাদ দিয়ে কেবল বাঙালি মুসলমানদের তাড়াতে চাইছে। বহিরাগতদের বহিষ্কারের দাবি এখন শুধু মুসলমানে গিয়ে ঠেকেছে। অথচ ভারত এটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, এখানে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত।

মূলত এই সমস্যাটির সৃষ্টি করেছে বিজেপি। তাদের ভয়, মুসলমানদের জনসংখ্যা এক সময় অন্যদের ছাড়িয়ে যাবে। সে কারণে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নিচ্ছে। অথচ ২৫-৩০ বছরের মধ্যে কোনো বাংলাদেশী আসামে বসবাসের জন্য যায়নি। স্থানীয় মুসলমানদের দুঃখ, ১২৬ আসনের রাজ্যসভার মধ্যে তাদের ৩০ জন প্রতিনিধি ছিল। কিন্তু তারপরও মুসলমানদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। এখনো এ সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরক্ষরতা ও দরিদ্রতার হার অনেক বেশি। তাই সব মিলিয়ে আসামের মুসলমানদের বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের অবস্থা এখন খুবই করুণ।

রাগ আর ক্ষোভ নিয়ে সোলায়মান কাশেমি নামের একজন বলেন, ‘আমরা এই মাটির সন্তান। আমাদের বাংলাদেশী বলবেন না, আমরা ভারতীয়’। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অনেকেই মনে করেন, যারা মুসলিমদের হত্যা করেছে তারা ক্ষমা পেয়েছে। ১৯৮৩ সালে ভিল্লে গ্রামে বাঙালীবিরোধী দাঙ্গায় যে দুই হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে কাশেমির ভাইও ছিলেন। স্থানীয় মসজিদ কমিটির নেতা কাশেমি বলেন, এখন পর্যন্ত ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য কাউকে দোষী করা হয়নি। পাঁচ হাজার রুপি করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছিলো।


আরো সংবাদ



premium cement