২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কাশ্মীরে ভারতের সামরিক অভিযান

কাশ্মীরে ভারতের সামরিক অভিযান - সংগৃহীত

জম্মু ও কাশ্মীরে রমজান মাস উপলক্ষে চলা যুদ্ধবিরতির সমাপ্তি টানলো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং রবিবার এক টুইটে লিখেছেন, কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পুনরায় চালু করা হবে। 

রাজনাথ সিংকে উদ্ধৃত করে খবরে বলা হয়, যুদ্ধবিরতির সময়টুকুতে সামরিক বাহিনী লক্ষণীয় সংযম প্রদর্শন করেছে। অন্যদিকে, সন্ত্রাসীরা বেসামরিক নাগরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর তাদের হামলা চালানো অব্যাহত রেখেছে। এতে করে নিহত ও আহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

পুলিশের প্রতিবেদন অনুসারে, রমজানে যুদ্ধবিরতি চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন হামলায় ছয় বেসামরিক নাগরিক, নয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও ২০ জনের অধিক যোদ্ধাসহ অনেকে নিহত হয়েছেন। এদের বেশিরভাগই নিহত হয়েছেন লাইন অফ কন্ট্রোলের নিকটবর্তী স্থানে। 

নিহতদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক সুজাত বুখারিও রয়েছেন। তাকে শ্রীনগরে গুলি করে খুন করা হয়। তার হত্যা নিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভ করা হয় শ্রীনগরেও। 

রাজনাথ সিং জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির সময়সীমা বাড়ানোর যে প্রস্তাব ছিল, তা খারিজ হয়ে গিয়েছে।

কাশ্মীরে সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ

কাশ্মীর উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়েছে উত্তেজনা। কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেন না। এ প্রেক্ষাপটে সেখানে এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে রাজ্য সরকার। 

সরকারি নির্দেশিকায় জানানো হয়েছে, হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক, স্ন্যাপ চ্যাট, টুইটারসহ যাবতীয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারবেন না কাশ্মীরের বাসিন্দারা। প্রশাসনের দাবি, এই সোশ্যাল মিডিয়া মারফতই অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে উপত্যকায়। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এমনকী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধাচারণের উস্কানিতে সোশ্যাল মিডিয়ার হাত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সে কারণেই এই নয়া নির্দেশিকা। 

গত এক মাস ধরেই ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রয়েছে কাশ্মীরে। সেক্ষেত্রেও এই একই কারণ বলা হয়েছে। সরকারি নির্দেশিকায় আরো জানানো হয়েছে, পরবর্তী সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকবে। 

গত কয়েক মাস ধরেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কাশ্মীরের একাধিক জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলছে উপত্যকার বাসিন্দারা। ছাত্র–যুবদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের। একাধিক জায়গায় সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ার ঘটনা বাড়ছে। কয়েকদিন আগেই শ্রীনগরের উপনির্বাচনে ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় সেনাবাহিনীকে। প্রকাশ্য রাস্তায় সেনা জওয়ানদের মারধর করতে দেখা গিয়েছে উপত্যকার যুবকদের।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের কাশ্মীরে ‘নোংরা যুদ্ধ’ মন্তব্যে তোলপাড়

কাশ্মীরে একটা ‘ডার্টি ওয়ার’ বা নোংরা যুদ্ধ চলছে এবং ভারতীয় সেনারা তাতে নীরব দর্শক হয়ে থাকবে না - সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াতের এই মন্তব্যকে ঘিরে তীব্র আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে।

সামরিক বিশেষজ্ঞরা অনেকেই বলছেন, যে কোনও সংঘাতে দুপক্ষেরই অনেক গোপন যুদ্ধকৌশল থাকে - সেটাকে সামনে এনে সেনাপ্রধান হয়তো খুব একটা বিচক্ষণতার পরিচয় দেননি।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোও মনে করছে, কাশ্মীরে ভারতীয় সেনার নীতি গ্রহণযোগ্য নয় অনেক ক্ষেত্রেই - কিন্তু জেনারেল রাওয়াত সম্ভবত সেটাকেই এখন একটা বৈধতা দিতে চাইছেন।

‘কাশ্মীরের বিক্ষোভকারীরা যদি পাথর না ছুঁড়ে গুলি ছুঁড়ত - তাহলে ভারতীয় সেনা অনেক বেশি খুশি হত’, সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতের এই মন্তব্য চমকে দিয়েছে অনেককেই।

তার যুক্তি ছিল, কাশ্মীরে ডার্টি ওয়ার চলছে - কিন্তু পাথরের জবাবে সেনারা এতদিন গুলি ছুড়তে পারেনি। তবে এখন থেকে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনারাও পাল্টা নোংরামো করতে দ্বিধা করবে না, তার বক্তব্যকে অনেকেই সেই ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।

প্রাক্তন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী অবশ্য মনে করেন কাশ্মীরের সংঘাতে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মানার তেমন বাধ্যবাধকতাও নেই।

‘আমার বক্তব্য হল, যে কোনও যুদ্ধই ডার্টি। জেনেভা কনভেনশন বা ওই জাতীয় অনেক কিছুই হয়তো আছে, কিন্তু আসল যুদ্ধের সময় সব যুদ্ধই নোংরা। ভিয়েতনাম বা বিশ্বের আরও নানা যুদ্ধই এর দৃষ্টান্ত। আর কাশ্মীরে যেটা চলছে সেটা একটা অভ্যন্তরীণ সংঘাত - এবং এরকম ক্ষেত্রে যে জেনেভা কনভেনশন প্রযোজ্য হয় না তার বহু উদাহরণ আছে।’

‘অনেকেই বলেন জেনেভা কনভেনশন সে সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যেখানে দুপক্ষই উর্দি বা ইউনিফর্ম পড়ে লড়ছে। কাশ্মীরে এটা স্পষ্ট যে শুধু এক পক্ষেরই ইউনিফর্ম আছে। সেই ভারতীয় সেনারা কিন্তু একটা ক্লিন ওয়ার লড়ছে - তাদের প্রতিপক্ষ ফিদায়েঁরা কখনওই জেনেভা কনভেনশন মানার প্রয়োজন বোধ করেনি’, বলছিলেন জেনারেল রায়চৌধুরী।


এতদিন সরকারিভাবে ভারতীয় সেনার অবস্থানও ছিল ঠিক এটাই। কিন্তু ভারতীয় সেনাও এখন থেকে ডার্টি ওয়ারের দস্তুর মেনেই লড়বে - সে কথাটা উচ্চারণ করে সেনাপ্রধান অত্যন্ত বোকার মতো কাজ করেছেন, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ভারতের নামী প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ রাহুল বেদী।

তার যুক্তি হল, ‘উত্তর-পূর্ব ভারতই হোক বা পাঞ্জাব-কাশ্মীরের িউগ্রবাদী দমনে - কিংবা মাওবাদীদের মোকাবিলায়, চিরকালই কিছু ধোঁয়াটে অনৈতিক ব্যাপারস্যাপার ছিল - কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ কখনও মুখ খোলেনি। সবাই জানে চম্বলের ডাকাতদের নিকেশ করা হয়েছিল এনকাউন্টারে, তবে কেউ সেটা ঘোষণা করেনি।’

‘জেনারেল রাওয়াত অত্যন্ত নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছেন কারণ এই কথাগুলো মুখে বলা যায় না - কিন্তু ওপেন সিক্রেট হল এই সব ডার্ক অপারেশনের ওপর সিআইএ বা ব্রিটিশরা সবাই নির্ভর করে, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না’, বলছেন মি বেদী।

আর এই যে সেনাপ্রধানের ঘোষণা, এটাকে সেনাবাহিনীর অনৈতিক কাজকে কাশ্মীরে একটা বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হিসেবেই দেখছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

দক্ষিণ এশিয়াতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রধান মীনাক্ষি গাঙ্গুলি পরিষ্কার বলছেন, সেনাবাহিনী বহুদিন ধরেই সেখানে পাথর নিক্ষেপকারী আর উগ্রবাদীদের একই চোখে দেখছে।

তার কথায়, ‘যারা আজ কাশ্মীরে পাথর ছুঁড়ছে তারা হল চিলড্রেন অব কনফ্লিক্ট। কুড়ি-বাইশ বছরের এই যুবকদের জন্ম আশির দশকের পরে, জন্মের পর থেকেই তারা শুধু হিংসা দেখছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন দেখছে। তাদের ডিল করার জন্য যে ধরনের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার বা হিলিং অ্যাপ্রোচ দরকার সেটা আমরা মোটেও দেখছি না।’

‘সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল এদের সঙ্গে উগ্রবাদীদের মতো আচরণ করা হচ্ছে। হ্যাঁ নিশ্চয়, পাথর ছুঁড়ে তারা নিশ্চয় দেশের আইন ভাঙছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করা উচিত। কিন্তু পাকিস্তান থেকে এসে যে উগ্রবাদীরা বন্দুক বা বিস্ফোরক নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে - তাদের সঙ্গে যদি এই ভারতীয় নাগরিকদের আপনি এক করে দেখেন, তাহলে শুধু গোটা একটা কাশ্মীরী প্রজন্মকেই আপনি আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন’, বলছিলেন মিস গাঙ্গুলি।

জেনারেল বিপিন রাওয়াত এখন পরিষ্কার করে দিয়েছেন, এখন থেকে ভারতীয় সেনা এ ব্যাপারে আর কোনো রাখঢাক রেখে চলবে না - বুলেট দিয়েই হোক বা হিউম্যান শিল্ড, যেটাকে তারা ‘ডার্টি ওয়ার’ বলে মনে করছে সেটাকে সেই যুদ্ধের নিয়ম মেনেই লড়বে।

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা অনেকেই মনে করছেন, এটা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সেনার কৌশলের সঙ্গেই তুলনীয় - তবে ফারাক হল ভারত কাশ্মীরে সেটা করতে চাইছে রীতিমতো বলেকয়ে!

সূত্র: বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement