২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনা যুদ্ধ ও চীন নিয়ে ভাবনা

করোনা যুদ্ধ ও চীন নিয়ে ভাবনা - ছবি : সংগ্রহ

‘China never lost wars, China can’t afford to loose battle against a virus.’ কথাটা জোর দিয়ে বলা হচ্ছে।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল চীন সফরে গিয়েছিলেন সামরিক সহযোগিতা বিস্তৃত করার জন্য। ওই দলে ছিলেন তদানীন্তন ব্রিগেডিয়ার জাহানদাদ খান। পরে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য লাহোরে অবস্থানের সময় জেনারেল জাহানদাদ তার মিলিটারি সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আত্মজীবনী Pakistan Leadership Challenges -এ চীনের জনগণের সংগ্রাম ও নৈতিকতা নিয়ে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। চীনারা সব পর্যায়ে আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মোন্নয়নে কিভাবে নিজেদের ব্যাপৃত রেখেছে, তার বইতে সেসবের বেশ ক’টি উদাহরণ পাওয়া যায়। সে সময় বেইজিংয়ের নাম ছিল পিকিং।

জাহানদাদ তার বইয়ের ২৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, চেয়ারম্যান মাও একবার সে দেশ সফরকারী একজন উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি কর্মকর্তাকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন- ‘তোমরা কেবল কুরআন পড়ো, আর আমরা কুরআনের ব্যবহারিক চর্চা করি।’ তিনি নাস্তিক হলেও চীনা ভাষায় অনূদিত কুরআন পড়তেন। তিনি কুরআনের ‘ব্যবহারিক প্রয়োগ’ বলতে বুঝিয়েছিলেন, বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক বিষয়ে চীনে ইসলামের নির্দেশনাগুলো কাজে লাগানো হয়ে থাকে। যেমন- সব মানুষ সমান, অফিসের বড় কর্তা ও পিয়নের মধ্যে মর্যাদায় পার্থক্য থাকলেও মানবিক অধিকারে তারা একই কাতারে, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান সবার মৌলিক অধিকার ইত্যাদি।

জীবনে যখন প্রথমবার বেইজিং গেলাম তখন চীনা সরকারের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা আমাকে বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করেছিলেন। তার নাম ছিল চেন। একজন প্রটোকল অফিসার ছিল আমার দেখভাল করার জন্য। একদিন আমাকে বেইজিংয়ের তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে নিয়ে যাওয়া হলো। ওই কর্মকর্তা নিজে সাথে গেলেন। প্রটোকল কর্মকর্তাকে পাঠালেও চলত। বিশাল স্কোয়ারে দাঁড়ালে এক দিকে মাও সে তুংয়ের ছবি দেখা যায়। তবে পুরো চীনে ওই এক জায়গাতেই তার ছবি পাবলিকলি টাঙানো আছে। ওই ছবি যেখানে টাঙানো, সেই বিল্ডিংয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়েই কমরেড মাও ১৯৪৯ সালে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই কর্মকর্তা আমাকে সেখানে নিয়ে গেলেন, কিভাবে লং মার্চ শেষে কমিউনিস্ট চীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিলেন।

তিনি একটি চমকপ্রদ তথ্য জানালেন। কমিউনিস্ট চীন গঠনের পর বড় বড় নেতা মিলে কতগুলো দিকনির্দেশনা তৈরি করেন। এর মধ্যে ছিল চীনে কোনো প্যাগোডা, চার্চ ও মসজিদ থাকবে না। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ চীনে প্যাগোডাগুলোকে হয় মিউজিয়াম, নয়তো দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিবর্তন করা হবে। মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষালয়গুলোকেও বন্ধ করে দেয়া হবে। ওই ফাইল অনুমোদনের জন্য যখন চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের কাছে যায়, তিনি সব মসজিদ বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশটি কেটে দেন। একই সাথে ইসলামী শিক্ষালয়গুলোর “বেশ ক’টি চালু থাকবে” বলে সিদ্ধান্ত দেন। কী কারণে তিনি মুসলমানদের মসজিদ ও শিক্ষালয় বন্ধ না করে যেমন চলছে তেমনি চলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। অনেকেই বলেন, মাও ইসলামের নবী সা:-এর ‘জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীনে যাও’ বাণী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারেন। এ ছাড়া কয়েক শ’ বছর আগে চারজন মুসলিম অ্যাডমিরাল চীনের প্রথম নৌবহর তৈরি করে দিয়েছিলেন। দু’জন সাহাবা নবী সা:-এর জীবদ্দশাতেই চীন গিয়েছিলেন, যাদের একজনের কবর রয়েছে গোয়াংজু শহরে। চীনে মুসলমানরা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণী। অন্যরা ধর্ম পালন না করতে পারলেও মুসলমানরা ধর্ম পালন করতে পারে। এর অন্তর্নিহিত কারণ যাই হোক না কেন, মাও সে তুংয়ের সেই সিদ্ধান্তের জেরেই হয়তো আজো চীনে প্রায় ৪০ হাজার মসজিদ রয়েছে, যেখানে আজান হয়, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া হয়, প্রতিটি মসজিদে রয়েছেন ইমাম ও মুয়াজ্জিন এবং সাহায্যকারী ব্যক্তি। চীনে ইমামকে ‘মোল্লা’ বলে ডাকা হয় এবং তিনি স্থানীয় সব মুসলমানের সামাজিক নেতা হিসেবে স্বীকৃত।

যা হোক, করোনাভাইরাস ও এর ফলআউট নিয়ে আলোকপাত করাই আজকের এই নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।

চীন শুধু বিশাল দেশই নয়, পুরো বিশে^র বড় বড় সব কোম্পানির পুঁজি বিনিয়োগ রয়েছে চীনে। গাড়ি থেকে শুরু করে যাবতীয় পণ্যের কারখানা গড়ে উঠেছে সেখানে। ধনী, গরিব সব দেশের ব্যবসার বেশির ভাগ চীনের সাথে সম্পৃক্ত। লাখ লাখ পর্যটক প্রতি মাসে চীন সফরে যায় তেমনি এশিয়া, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করে লাখ লাখ চীনা নাগরিক। পণ্যের আদান-প্রদানের সমান্তরালে ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রির বেশির ভাগ এভাবে চীনকেন্দ্রিক হয়ে গড়ে উঠেছে। আগে বিশ্বক্ষমতা ও প্রভাব বলয়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার মতো দেশ। কিন্তু এখন সেই বলয়ে চীনও স্থান করে নিয়েছে। এখন চীন ও বিশ্ব পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশে কোনো অঘটন হলে তা ওই দেশ ও আশপাশের কিছু দেশকে প্রভাবিত করে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু ঘটলে তা বিশ্ববাণিজ্যে ততটা প্রভাব ফেলতে পারে না। কারণ মার্কিন বড় বড় সব কোম্পানি এখন আর নিজ দেশে পণ্য তৈরি করে না, তাদের প্রায় সবার অবকাঠামো চীনে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এশিয়া ও আফ্রিকার সাধারণ ব্যবসায়ীদের দৈনন্দিন লেনদেন তেমন গভীর নয়। ব্রেক্সিট ইস্যু ইউরোপের মাথাব্যথা হতে পারে। কিন্তু ইউরোপের বাইরে কেউ এটা নিয়ে তেমন চিন্তিত হবে না।

চীনের ব্যাপারটি কিন্তু ভিন্ন। সেখানে জার্মান ফক্সওয়াগেন, মার্সিডিজের যেমন কারখানা আছে, তেমনি মার্কিন ফোর্ড, জাপানি টয়োটারও কারখানা আছে। পিয়েরে কার্ডিন, অ্যাডিডাস, হুগো বস ও গুচ্চির মতো পৃথিবীখ্যাত পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলোর কারখানাও চীনে। এসব কারণে প্রতিটি দেশের সাথে চীনের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে জড়িয়ে গেছে। চীন কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব সবার ওপরেই পড়বে, তা সে ধনী বা গরিব যাই হোক না কেন। এর বাইরে চীন বিশাল বাজারও। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সঙ্গত কারণেই চীনাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণ। মোবাইল ফোনের সবচেয়ে বড় বাজার তাই চীন। এত বড় বাজার সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের টার্গেট। চীন বিপদে পড়লে তাই সব কোম্পানির মাথায় হাত পড়াই স্বাভাবিক। যেহেতু বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিকে ধারণ করছে চীন, তাই তার নিজের স্বার্থেও প্রশাসনিক, সামাজিক, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা। দায়িত্ববোধ থাকতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। তা না হলে অন্য দেশের তো ক্ষতি হবেই, চীনের ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি। কারণ সব কিছুই ইন্টিগ্রেটেড। একটার ওপর আরেকটা নির্ভরশীল।

চীনের অর্থনৈতিক, অবকাঠামোগত ও শিল্প উন্নয়ন দেখলে অবাক হতে হবে। এত বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে কিভাবে একটি দেশ দরিদ্র অবস্থা থেকে তিন-চার দশকের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হতে পারে তা অনেক সময় বিশ্বাস করাও কঠিন। চীন এখন চলছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধারায়। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক। এ দুটো পরস্পর সাংঘর্ষিক। দেং শিয়াও পিংয়ের সময় থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করার পর এযাবৎ চীন বিস্ময়করভাবে এ দুটো সিস্টেম ম্যানেজ করে এসেছে। তবে পুঁজির বিকাশ বিস্তৃত হলে সমাজে অনেক ধরনের পরিবর্তন হয়, চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

চীনেও তাই ঘটেছে। পুঁজিবাদের সাথে ফ্রিডম অব স্পিচ, সামাজিক স্বাধীনতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। চীনে এখনো তা নেই। সে দেশের সরকারের এ ব্যাপারে ‘যুক্তি’ রয়েছে। ১৩৮ কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করা দুরূহ। সবচেয়ে জটিল ব্যাপার হলো, সারা বিশে^র মানুষ বিশেষত ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা এখন পঙ্গপালের মতো চীনে যায়। এ ক্ষেত্রে লাখ লাখ বিদেশীর সেখানে চলাচল ও আনুষঙ্গিক কর্মকাণ্ড সহজ করা অর্থাৎ বিশে^র অন্যান্য দেশের সাথে সামঞ্জস্য রাখা জরুরি। যেমন একজন ব্যবসায়ী ও পর্যটক যখন অন্য দেশে যান, তার জন্য তখন কয়েকটি বিষয় মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- মোবাইলের সিম কার্ড কেনা, বিদেশী মুদ্রা ভাঙানো, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার, অফিসিয়াল ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজ দেশ ও বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রাখা এবং সবচেয়ে বড় কথা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইংরেজি ভাষায় ভাব আদান-প্রদান করা। সবাই ন্যূনতম পর্যায়ে এসবের নিশ্চয়তা কামনা করে।

জীবনে বহুবার চীনের বড়, ছোট শহর সফর করেছি। প্রত্যন্ত এলাকাতেও গিয়েছি। চীনাদের কঠোর পরিশ্রম ও আইন মেনে চলার বিষয়টি অবাক হয়ে লক্ষ করেছি। কিন্তু চীনে পা দেয়ার পর যে কারো মনে হবে, সে কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপে এসে হাজির হয়েছে। ভাষার সমস্যায় হাবুডুবু খেতে হয়। এমনকি পাঁচ তারকা হোটেলেও সাধারণ ইংরেজি শব্দগুলো কেউ বুঝতে পারে না। পুরো চীনে গুগল সার্ভিস বন্ধ।

হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ভাইবার, গুগল ম্যাপ, জিমেইল সব নিষিদ্ধ। কেবল চীনের নিজস্ব আবিষ্কার উইচ্যাটে যোগাযোগ করা যায়। ওখানে যে চীনা ম্যাপ অ্যাপ কাজ করে তা চীনা ভাষায়। এর কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। আগে বিদেশী পর্যটকদের পাসপোর্ট ফটোকপি দিয়ে সিম কার্ড নেয়া গেলেও এখন তা স্থগিত। খুব বড় শপিংমল ছাড়া ভিনদেশী কোনো ক্রেডিট কার্ড- তা ভিসা, মাস্টার কার্ড, অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস যাই হোক না কেন কেউ নিতে চায় না। ‘আমেরিকান এক্সপ্রেস’ প্রায় অচ্ছুত একটি বিষয়ও বটে! এখন আসা যাক বিদেশী মুদ্রা ডলার বা পাউন্ড ভাঙিয়ে চীনা টাকা জোগাড় করার ব্যাপারে। কোথাও মানি এক্সচেঞ্জ কারো চোখে পড়বে না। যেতে হবে ব্যাংক অব চায়নায়। তাও সব শাখায় মানি এক্সচেঞ্জ করা হয় না। সেখানে গিয়ে ফরম ফিলাপ করে, পাসপোর্টের ফটোকপি নিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে। বিশাল ঝক্কির ব্যাপার।

চীন সরকার হয়তো এসবই করেছে তাদের নিজস্বতা বজায় রাখার জন্য বা নিরাপত্তার স্বার্থে। দেশ তাদের, সিদ্ধান্তও তাদের। কিন্তু চীন তো কোনো ছোটখাটো বা অনুল্লেখ্য দেশ নয়। বিশে^র দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ। মানুষ ওখানে যাবেই। সংরক্ষণবাদিতা চেপে বসলে সচলতা এমনিতেই কমে যাবে। পৃথিবীর অন্য জাতি বা দেশের সাথে চলতে গেলে এসব সমস্যার সমাধান চীনা সরকারকে অবশ্যই করতে হবে। এটা টু ওয়ে ট্রাফিক, একপক্ষীয় ব্যাপার নয়। অথচ চীনে কিন্তু সব জিনিসই পাওয়া যায়। মুসলমানদের জন্য হাজার হাজার মুসলিম রেস্টুরেন্ট, হালাল ফুড অ্যাসোসিয়েশন আছে! কিন্তু খুঁজে পাওয়া বা এসবের অস্তিত্ব জানা বেশ কঠিন বৈকি।

এখন করোনাভাইরাসে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া চীনের প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই চোখে ভাসে, মহাচীনের সাধারণ মানুষের কল্পনাতীত বিপদে পড়ার দৃশ্য। কোটি কোটি মানুষ ভাইরাসের ছোবলে অসহায়। সে দেশের সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তা হয়তো পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের পক্ষে নেয়া সম্ভব নয়। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেউ কল্পনাও করতে পারে না যে, নিউ ইয়র্ক বা লস অ্যাঞ্জেলস শহর লক ডাউন করা যাবে চিকিৎসার স্বার্থে। চীন কত বড় বিপদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা চীনারা জানে এবং তারা ফাইট ব্যাক করছে সর্বশক্তি দিয়ে। বিশাল জনগোষ্ঠীকে এভাবে নিরাপদ রাখা ও চিকিৎসা সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা ‘মিরাকল’ বটে। এত রিসোর্স মোতায়েন এবং ডিসিপ্লিনড ওয়েতে অচেনা, ভয়ঙ্কর ভাইরাস মোকাবেলা করা চীনের সার্বিক সক্ষমতারই পরিচয় দেয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, তাদের মধ্যে প্যানিক কিন্তু খুব বেশি নেই। সরকারের প্রতিটি প্রশাসনিক স্তরও কাজ করছে স্বাভাবিকভাবে। হাজার হাজার ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, সেনা সদস্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা আক্রান্তদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বিশাল বিশাল শহরে যেসব নাগরিক কোয়ারেন্টাইনে বাসায় আটকে আছেন, প্রয়োজনে তাদের খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দিচ্ছেন। তাদের ডেডিকেশনকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখা যাবে না। এমনকি, উহান হাসপাতালের পরিচালক রাতদিন রোগীদের পাশে থেকে নিজেই ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। নানজিং থেকে একটি হাসপাতালের উপপরিচালক এক মহিলা ডাক্তার ভলান্টারিলি উহানে এসে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন টানা ১৮ দিন এবং তিনিও মৃত্যুবরণ করেছেন। চীনের সরকারি হিসাব মতে, তিন হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

এর ওপর আছে চীনবিরোধী শক্তির ব্যাপক অপপ্রচারণা ও মিসইনফরমেশন ওয়ার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছে যে, তারা যত না করোনাভাইরাস মোকাবেলা করছেন, তার চেয়ে বেশি মোকাবেলা করছেন ফেক নিউজ ও অপপ্রচার। এ ক্ষেত্রে চীনের দুর্বলতা চোখে পড়ে। তা হলো, মিডিয়া। চীনা সরকার এযাবৎ অর্থনীতি, নিরাপত্তা নিয়ে যত মাথা ঘামিয়েছে মিডিয়া নিয়ে তার শতকরা ১ ভাগও তাদের মাথাব্যথা নেই। অপপ্রচারের জবাব দেয়ার ক্ষেত্রেও তাদের আনাড়িপনা চোখে পড়ে।

কিন্তু করোনাভাইরাসের জন্য চীনের যে ক্ষতি হলো তা শুধু আর্থিক নয়, তার সার্বিক জাতীয় নিরাপত্তাকেও নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। এজন্য চীনের সাম্প্রতিক ব্যবস্থাপনায় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাত্তা না দিয়ে সব কিছুকেই নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রবণতাকে অনেকাংশে দায়ী করা যায়। গত ১৬ জানুয়ারি চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহর ভ্রমণকালে হোটেলের টিভিতে কোনো চ্যানেলে উহানের ভাইরাস নিয়ে একটি বর্ণও উচ্চারিত হতে দেখিনি। সব চ্যানেল ব্যস্ত ছিল চীনা নববর্ষ ও ‘যাবতীয় পজিটিভ সংবাদ’ নিয়ে! অথচ, গত বছর ডিসেম্বরের ৩১ তারিখেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উহানের ভাইরাস নিয়ে সতর্কবার্তা প্রচার করেছিল এবং চীনা সরকারকে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। উহানের ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং কয়েকজন রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে সার্স ভাইরাসের অনুরূপ ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি উইচ্যাটে চিকিৎসকদের একটি গ্রুপে এ আশঙ্কা উল্লেখ করেন। কিন্তু হুবেই প্রশাসন ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো একজন চিকিৎসকের আশঙ্কাকে আমলে তো নেয়ইনি, বরং তাকে রীতিমতো হেনস্তা করা হয় কথিত গুজব ও জনবিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে! ওই চিকিৎসক ছাড়াও কয়েকজন সাংবাদিক সতর্কবার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাদেরও হেনস্তা হতে হয়েছে। ডা: লি নিজেই অবশেষে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে জীবন উৎসর্গ করে প্রমাণ করেছেন- কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই! ডা: লি এখন চীনের জাতীয় বীর। কিন্তু চীনা প্রশাসন যদি তখন তার ও অন্যান্য আশঙ্কা প্রকাশকারীর কথা শুনত তাহলে আজ তাদের এত বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো না, এত মানুষের জীবনহানি ঘটত না। সব কিছুকে ছকবাঁধা নিরাপত্তা ইস্যু মনে করার এটাই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। আশা করি, মহাচীন এবার তা বুঝতে পেরেছে। মিডিয়ার সব কিছুর ওপরেই নিয়ন্ত্রণ থাকলে কিভাবে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় আড়াল হয়ে মহাঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে, চীনের বর্তমান ভাইরাস ইস্যু তার জ্বলন্ত প্রমাণ। প্রশাসনও এত নিয়ন্ত্রণের কারণে আসল ঘটনা জানতে পারে না এবং সময়মতো ব্যবস্থা নিতে দেরি হয়।

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স কার্যকর করে চীন তার প্রতিটি নাগরিকের যাবতীয় তথ্য ও চলাচল সম্পর্কে জানতে পারে। এটা প্রয়োজন। আমেরিকাও আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সে পারঙ্গম। সব কিছু জানতে পারার এই বিষয়টিকেই যদি সর্বজনীন করা যায় জনস্বার্থ ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার লক্ষ্যে, তাহলেই করোনার মতো যেকোনো বিষয় চটজলদি সরকারের নজরে আসবে। সহজ প্রশ্ন- যদি চিকিৎসকদের আশঙ্কাকে প্রশাসন গুরুত্ব দিত এবং মিডিয়া এসব নিয়ে খোলাখুলি মতপ্রকাশ করতে পারত তাহলে কি আজ এ অবস্থা সৃষ্টি হতো? এত বিশাল শক্তি নিয়ে মহাচীনকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হতো? না।

বর্তমান চীন মাও সে তুংয়ের চীন নয়। একুশ শতকের প্রযুক্তিগত বিস্ময় ও জটিলতায় আবদ্ধ বিশ্বের পথপরিক্রমায় ছুটে চলা নতুন এক দেশ। তাই চীন বিপদে পড়ার অর্থ বিশ্ব ব্যবস্থাপনা, ক্ষমতার ভারসাম্যে বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়া। চীন বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র। ১৯৭৬ সাল থেকে চীন আমাদের দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা সৃষ্টিতে আন্তরিকভাবে সহায়তা দিয়ে আসছে। চীনের কোনো ক্ষতি হোক, তা আমরা চাই না। চীন ভালো থাকুক।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, চীন ধীরে ধীরে সেই শূন্যতা পূরণ করেছে। চীনের রাষ্ট্রব্যবস্থা অনেকের কাছে ভালো লাগতে না-ও পারে। কিন্তু চীন লণ্ডভণ্ড হলে বিশ্ব হয়ে যাবে ছারখার।

তাই চীনকেই হতে হবে আরো অনেক বেশি দায়িত্বশীল। মিডিয়ার শূন্যতার বিষয়টিকেও তাদের সরকারকে অর্থনীতির পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দিতে হবে। চীনের ভুলগুলো দেখিয়ে দেয়ার অর্থ এই নয় যে, চীনের ধ্বংস কামনা করা। ডা: লির মতো মানুষদের যাতে চীন গুরুত্ব দেয়, সেটাই হলো রক্ষাকবচ।


আরো সংবাদ



premium cement