২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

তাবলিগের অনৈক্য নিরসন করুন

-

বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের সংগঠন ‘তাবলিগ জামাত’। পৃথিবীর এই অঞ্চলে ইসলামের বিকাশ, লালন ও প্রতিষ্ঠা দীর্ষ ইতিহাসের বিষয়। ভারত যখন ‘দারুল ইসলাম’ ছিল তখন দ্বীনের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। ১৭৫৭ সালে পলাশীর ভাগ্য বিপর্যয়ের পর এই উপমহাদেশ যখন ক্রমাগত ‘দারুল হার্ব’ বা বিধর্মীদের কর্তৃত্বশীল দেশ হয়ে যায় তখন ইসলামের ‘দ্বীন ও দুনিয়া’ ক্রমেই সঙ্কীর্ণ হয়ে আসে। ঔপনিবেশিক রাজনীতি পারিপার্শ্বিকতায় মুসলমানরা যখন ধীরে ধীরে ধর্মবিমুখ হয়ে যাচ্ছিল, তখন হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী রহ:-এর বংশধর মওলানা ইলিয়াস রহ: ১৯১০ সালে ভারতে তাবলিগি কার্যক্রম শুরু করেন। দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরবার শরিফ ঘিরে এ কার্যক্রমের সূচনা। অধিকৃত ভারতবর্ষে রক্তক্ষয়ী মুহাম্মাদী আন্দোলনে তথা সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর শাহাদতের পরের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাবলিগি কার্যক্রমের সূচনা হওয়া অসম্ভব ছিল না। ইসলামের ইতিহাসে যখনই শাসক কর্তৃত্ব অন্যায়, অনাচার, অত্যাচার করে ইসলামকে স্তব্ধ করতে চেয়েছে তখন আল্লাহর দ্বীনের অনুসারী আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখরা নিস্তব্ধ হয়ে যাননি। তখন তারা নতুনভাবে, নতুন সংস্কারে এবং নতুন বিকল্প পথে আল্লাহর দ্বীনের কাজ করার চেষ্টা করেছেন। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাবলিগ জামাত ছিল সে ধরনেরই একটি আন্দোলন বা কার্যক্রম। ক্রমেই তাবলিগ জামাত পেশোয়ার থেকে চট্টলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ১৯৪৪ সালে মওলানা আবদুল আজিজ রহ:-এর প্রচেষ্টায় টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব ইজতেমা। এটি কালে কালে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমাবেশ হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানরা আত্মশুদ্ধির আবেগ নিয়ে এখানে জমায়েত হন। তাবলিগের ছয়টি উদ্দেশ্য ১. কালেমা ২. নামাজ ৩. ইলম ও জিকির ৪. ইকরামুল মুসলিমীন বা সবার সেবা ৫. সহিহ নিয়ত ও ৬. দাওয়াত ও তাবলিগ। সমবেত লাখ লাখ মানুষ এই ছয়টি লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কর্মসূচি অনুসরণ করেন। হজরত মওলানা ইলিয়াস রহ: উপলব্ধি করেছিলেন, ‘ব্যক্তিচরিত্র সংশোধন করা না গেলে সামষ্টিক জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে। ব্যক্তিসত্তায় ইখলাস, তাকওয়া ও পরকালীন জবাবদিহি সঞ্চার করা গেলে তা জীবনের সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ব্যক্তিজীবনে যদি কেউ আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রের যেকোনো গুরুদায়িত্ব তার ওপর নির্দ্বিধায় ন্যস্ত করা যায়।’ যদিও বাংলাদেশের তাবলিগ জামাত যথার্থভাবে এই উদ্দেশ্য সাধনে ব্রতী হয়নি, বরং নিছক একটি নিরুপদ্রব ও উদ্দেশ্যহীনভাবে দুর্বল নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনীতিকীকরণও ঘটে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের পীড়নও লক্ষ করা যায়। তবুও বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভে তাবলিগ সমর্থ হয়। সাধারণ মানুষেরা নামাজ না পড়লেও বিশ্ব ইজতেমার সময়ে আখেরি মুনাজাতে নিবিষ্ট মনে অংশগ্রহণ করে। পরস্পর বিবাদে লিপ্ত রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোও প্রতীকী অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে শ্রদ্ধা জানায়। সর্বজন সমর্থিত ও অজাতশত্রু এই তাবলিগ জামাত নিয়ে যখন মানুষ আবেগ-আন্দোলিত তখন এর মধ্যে বিরোধ, কোন্দল ও দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ মানুষের মনে চরমভাবে আঘাত হানে। মানুষ তাবলিগ জামাতকে সব মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। শতধাবিভক্ত বাংলাদেশের সমাজ তাবলিগকে নিঃসন্দেহচিত্তে একক ঐক্যের আধ্যাত্মিক উৎস হিসেবে গ্রহণ করে। সেখানে মারামারি-হানাহানি ও নেতৃত্বের কোন্দল সাধারণ মানুষকে দারুণভাবে আহত করে। মানুষ প্রশ্ন করে, এই যদি হয় আল্লাহ ওয়ালাদের শীর্ষপর্যায়ের অবস্থা, তখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? মাসলা-মাসায়েল ও শরিয়তের বিতর্ক ও বাহাস মানুষ কমই বোঝে। তারা সাধারণভাবে সাধারণ চিন্তা করে। আলেম-ওলামাদের মাথার তাজ মনে করে। কেন তাহলে এই বিরোধ?

বিরোধটি দীর্ঘকালীন নয়। এটি অতি সাম্প্রতিককালের সংযোজন। ২০২০ সালে এই অন্তর্দ্বন্দ্বের সম্ভবত চার বছর পূর্ণ হবে। তবুও থেমে থাকেনি এই আয়োজন ও আন্দোলন। শুধু বাংলাদেশে নয়; এই বিভেদ দেখা দিয়েছে বিশ্বব্যাপী। বিগত ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যে আন্দোলনটি দিনে দিনে বিন্দু বিন্দু ঘাম আর মেহনতের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে তা আজ নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে দ্বিধাবিভক্ত তাবলিগের ইজতেমা হচ্ছে। এক গ্রুপ শেষ হলে আরেক গ্রুপের শুরু হচ্ছে। তাবলিগ জামাতের এই দৃশ্যমান বিভক্তি এর মর্যাদা, গুরুত্ব ও প্রভাবকে ম্লান করেছে। সাধারণ মানুষ তথা ঢাকা নগরবাসীর জন্য অধিকতর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে তিন দিনের যানজট মানুষ মেনে নিয়েছে। এখন ১০ দিনের ফেরে পড়েছে মানুষ। তাই ভোগান্তি, বিরক্তি ও উষ্মার শেষ নেই। বাংলাদেশের সরকারও বিব্রত। যতটা সংবাদপত্র থেকে জানি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই গ্রুপকে একত্র করার চেষ্টার ত্রুটি করেনি। তবে তাদের আনুকূল্যে দু’বারের ইজতেমাও মেনে নেয়া যায় না। পুলিশ এত কিছুর কাজী, তারা শক্ত থাকলে মনে হয় এই দুর্গতি এড়ানো যেত। এমনিতেই রাজনৈতিক বিরোধে আকীর্ণ বাংলাদেশ। তার ওপর এই ধর্মীয় বিভেদ বিরোধের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তাবলিগের বিরোধে সুনাম নষ্ট হচ্ছে দেশের।’ এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের চলমান বিরোধের কারণে বিদেশে দেশের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট হচ্ছে। বিদেশী তাবলিগ সাথীরা এখন বাংলাদেশে আসতে আগের মতো আর আগ্রহী নন। বিশ্ব ইজতেমায় বিদেশী তাবলিগ সাথীদের কাক্সিক্ষত জমায়েত হচ্ছে না। মসজিদ থেকে বের করে দেয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটবে না এবং কোনো ধরনের হাঙ্গামা হবে না- বাংলাদেশে আসার আগে তারা এমন নিশ্চয়তা চাচ্ছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে একটি ছোট্ট মুসলিম রাষ্ট্র। এ দেশকে বিশ্বের মানুষ তেমন চিনত না। বিগত ৫০ বছরে তাবলিগের মোবারক মেহনতের কারণে সারা পৃথিবীতে পরিচিতি লাভ করে বাংলাদেশ। আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানি, রাশিয়াসহ সারা বিশ্বের অসংখ্য মুসলমান এখানে আসতেন। সারা দুনিয়া একযোগে জানত, টঙ্গী মানেই বিশ্ব ইজতেমা- কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাবলিগ জামাতের আজকের চলমান বিরোধের কারণে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা তলানিতে এসে ঠেকেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা নায়েবে আমির ও ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক চেয়ারম্যান মুফতি ইজহারুল ইসলাম এসব ক্ষোভের কথা ব্যাখ্যা করে বিরোধ মীমাংসায় এগিয়ে আসার জন্য দেশ ও বিদেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরামকে আহ্বান জানান। তিনি তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ঐক্য প্রচেষ্টার জন্য তার দীর্ঘ প্রয়াস ও প্রচেষ্টার বর্ণনা দেন। তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত দাওয়াতের সংগঠনটি মানুষের মধ্যে শান্তির কথা বলত। এখন যখন নিজেরাই অশান্তি ঘটাচ্ছে এমনকি নিম্নস্তরে, তখন তাদের বয়ানের তাছির যথার্থ হবে কি? একবার খবর বেরিয়েছিল, হুজুরেরা টাকা পয়সার ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া করছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকও এমন অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেল বিরোধের উৎস ‘হেথা নয় হোথা নয়, অন্য কোথা’।

এবার বিরোধের উৎসমূল নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। ব্যক্তি ও কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আদর্শিক বিরোধ। উল্লিখিত জামাতের ছয় উসুল বা উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো বিতর্ক বা বিভক্তি নেই। এই ব্যক্তি ও কর্তৃত্বের বিরোধ আদর্শিক বিরোধের মোড়কে আরো সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জামাত দু’টি ভাগে বিভক্ত। একটি গ্রুপ দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের বর্তমান আমির মাওলানা সা’দ কান্দলভীর পক্ষে, অপরটি তাবলিগের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু মুরুব্বিসহ আলেম-ওলামাদের পক্ষে। দু’টি গ্রুপের সাথে কমবেশি আলেমরা জড়িত রয়েছেন। মাওলানা সা’দ কান্দলভীর গ্রুপকে ‘এতাআতি গ্রুপ’ বলেও সম্বোধন করা হয়। অপরটির সাথে আলেম-ওলামাদের ঘনিষ্ঠতা বেশি থাকায় ‘আলেম-ওলামাদের গ্রুপ’ বা ‘অজাহাতি গ্রুপ’ বলে ডাকা হয়। এই গ্রুপের নেপথ্যে রয়েছে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা ও বাংলাদেশের আলেম-ওলামারা। সব মিলিয়ে বলা যায়, মাওলানা সা’দ কান্দলভী এক দিকে আর বিশ্বব্যাপী আলেমরা অন্য দিকে। বর্তমানে দুটো গ্রুপই মাঠপর্যায়ে তাদের নিজ নিজ নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়ন এবং সমর্থন ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আলেমরা চাচ্ছেন যুগ যুগ ধরে চলে আসা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের নীতি-আদর্শ থেকে যেন তাবলিগ জামাত একচুলও সরে না যায়। অপর দিকে, এতায়াতি গ্রুপটি চাচ্ছে মাওলানা সা’দ কান্দলভীর আনুগত্য বজায় রাখতে। তাবলিগ জামাতের চলমান এ দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিল ২০১৫ সালে। এ দ্বন্দ্বের নেপথ্যে আছে তাবলিগের বর্তমান আমির সা’দ কান্দলভীর বিতর্কিত বক্তব্য ও ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যা। একপক্ষ অভিযোগ করছে, আলেমদের পক্ষ থেকে একাধিকবার মাওলানা সা’দকে সতর্ক করার পরও তিনি এর ওপর অটল থাকেন। ফলে এ দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে এ দ্বন্দ্ব আজ সহিংস সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। সর্বশেষ বি-বাড়িয়ায় মারকাজ মসজিদেও সংঘর্ষে প্রায় ৩০-৩৫ জন আহত হয়েছেন। তাবলিগ জামাতের বিশ্ব মারকাজ হলো দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজ। ঐতিহ্য অনুযায়ী নিজামুদ্দিন মারকাজের আমিরকেই বিশ্ব আমির বিবেচনা করা হয়। ২০১৪ সালে দিল্লির একটি হাসপাতালে তাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা যুবায়েরুল হাসান মারা যাওয়ার পর এর দায়িত্বে আসেন সাম্প্রতিক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব মাওলানা সা’দ কান্দলভী। তিনি তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভীর পুত্র মাওলানা হারুন কান্দলভীর সন্তান। দিল্লি নিজামুদ্দিনে প্রতিদিন বা’দ ফজর তিনি বয়ান করে থাকেন। বেশ কিছু দিন ধরেই তার বক্তব্য নিয়ে বিভেদ দেখা দেয়। বিশেষ করে আলেম সমাজ তার কোনো কোনো বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করেন। বাংলাদেশের মতো কান্দলভীকে নিয়ে ভারতেও বিভক্তি রয়েছে। কোনো কোনো আলেম তার কথাকে ‘কুফরি কালাম’ বলে বিবেচনা করেন। এ থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। এ অবস্থা আরো ঘোলাটে হয়ে ওঠে দারুল উলুম দেওবন্দ ঘরানা সা’দ কান্দলভীর বেশ কিছু স্খলন চিহ্নিত করলে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইজমার বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান, কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা এবং ইচ্ছামতো ফতোয়া দেয়া। এসব উল্লেখ করে তাকে রুজু বা ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়। মাজলিসুল ওলামা থেকে দেয়া ফতোয়ায় সা’দ কান্দলভীর ছয় বক্তব্যকে কুফরি হিসেবে উল্লেখ করে পূর্ণ ব্যাখ্যা দেয়া হয়। তার বিতর্কিত বক্তব্যের বিষয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের পক্ষ থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিজামুদ্দিনে চিঠি দেয়া হয়। একপক্ষ অভিযোগ করছে, মাওলানা সা’দ এসব বক্তব্য অগ্রাহ্য করেন। এ বিষয়ে প্রকাশ্যে আলোচিত ঘটনা ছিল, ২০১৬ সালের ২ ডিসেম্বর দারুল উলুম দেওবন্দের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির মুহতামিম মাওলানা আবুল কাশেম নোমানী, নদওয়াতুল ওলামা লখনউ-এর পক্ষে এর মুহতামিম মহাপরিচালক মাওলানা সাইয়্যিদ সালমান আহমদ নদভী এবং দিল্লির ওলামাদের সর্বোচ্চ সংগঠন আইম্মা পরিষদের সভাপতি মুফতি অজাহাদ কাশেমী মাওলানা সা’দের বিরুদ্ধে ওই দিন যৌথ বিবৃতি দেন। সম্মিলিত সেই বিবৃতিতে সা’দকে তওবার আহ্বান জানানো হয়। বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। এভাবে ভারতের আলেম ওলামারা কথিত বিভ্রান্তির ব্যাপারে একমত হন। অপর আরেকটি বিষয় ক্ষোভের সঞ্চার হয়। আর সেটি হলো, মাওলানা সা’দ কর্তৃক নিজামুদ্দিনকে মক্কা-মদিনার পরের সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান দাবি করা। এরপর দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে আরেকটি ফতোয়া দেয়া হয়। সেই ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেন দারুল উলুম দেওবন্দের মুফতি আজম হাবিবুর রহমান খয়রাবাদী, দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা আবুল কাশেম নোমানী প্রমুখ। ফতোয়া প্রকাশের পর মাওলানা সা’দ বিতর্কিত বক্তব্য প্রদান না করার অঙ্গীকার পত্র ‘রুজুনামা’য় স্বাক্ষর করেন। কিন্তু এতে বিরোধের অবসান হয়নি। দেওবন্দ ওই রুজুনামার পূর্ণতা ও প্রক্রিয়ার বিষয়ে একমত হতে পারেনি। এখন দেখা যাক, এসব বিরোধ কিভাবে বাংলাদেশী আলেমদের প্রভাবিত করে।

ভারতীয় গণমাধ্যমে দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া প্রকাশের পর মাওলানা সা’দ সম্পর্কে দেওবন্দের অবস্থান জানতে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাধারণ আলেম এবং কাকরাইলের তাবলিগ শূরার সদস্যদের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফর করে। তারা দেওবন্দ, নিজামুদ্দিন ও গুজরাট সফর করে। প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে ফিরে এসে সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মাওলানা সা’দের বিষয়ে দেওবন্দের মতামতের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে তাবলিগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তৎপর হয়ে ওঠেন, যাতে মাওলানা সা’দ কান্দলভী ইজতেমায় আসতে না পারেন। আলেমদের এই উদ্যোগকে উপেক্ষা করে মাওলানা সা’দ ঢাকায় আসেন। সা’দবিরোধী অংশ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে ঘেরাও করে। পরে তিনি কাকরাইল মসজিদে এলেও ইজতেমায় অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়নি। মাওলানা সা’দ ফিরে গেলেও বাংলাদেশে দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হয়। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে তাবলিগের প্রাণকেন্দ্র কাকরাইল মসজিদে দু’গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। সা’দবিরোধী আলেম ওলামারা মসজিদের দখল নেন। সা’দ বিরোধীরা ঘোষণা করে তার কোনো সিদ্ধান্ত এ দেশে বাস্তবায়িত হতে দেয়া হবে না। ওই বছরের জুলাই মাসে আরেকটি দ্বন্দ্ব নিরসন প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়। ওই সভায় হেফাজতে ইসলাম প্রধান শাহ আহমদ শফী সা’দ বনাম আলেমদের দ্বন্দ্বে আলেমদের পক্ষ অবলম্বন করেন। ওই বৈঠকে ছয়টি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১. কুরআন হাদিসের মনগড়া ব্যাখ্যা, তাবলিগ ব্যতীত দ্বীনের অন্যান্য মেহনত যথা দ্বীনি শিক্ষা ও তাসাউফকে হেয় প্রতিপন্ন করা ও তাবলিগ প্রতিষ্ঠাদের উসুল ও কর্মপন্থা থেকে সরে যাওয়ার কারণে মাওলানা সা’দকে অনুসরণ করা সম্পূর্ণ বর্জনীয় ও নিষিদ্ধ। ২. মাওলানা সা’দ নিজেকে যেভাবে আমির দাবি করেছেন তা শরিয়তবিরাধী। ৩. মাওলানা সা’দ বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত থাকবেন। ৪. বাংলাদেশে তাবলিগের কার্যক্রম উলামেয়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। ৫. সা’দপন্থীরা বাংলাদেশে তাবলিগের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। ৬. সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া। তারা পরবর্তী বছর পৃথক পৃথকভাবে ইজতেমা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন। এর পরও বিরোধ চলতে থাকে। কাকরাইল ও বি-বাড়িয়ায় হামলার ঘটনা ঘটে।

উপরিউক্ত পর্যালোচনায় যে অব্যাহত দ্বন্দ্ব ও হামলার ঘটনা ঘটেছে তা তাবলিগের নেছাব বা উদ্দেশ্যের পরিপূরক নয়। সাধারণ মানুষ তাবলিগের ওই দ্বন্দ্ব ও বিরোধ দেখে অসম্ভব ক্ষুব্ধ ও হতাশ। ঈমানের দাবি যত শিগগির সম্ভব এই অনৈক্যের নিরসন। আলেম সমাজ যদি এই দায়িত্ব পালন না করতে পারে তা হলে তাদের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধাবোধ বিলুপ্ত হবে।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement