২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সিয়াচেন কি দ্বিতীয় কাশ্মির?

-

পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু চীনের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে উত্তর লাদাখ বা আকসেই ছিন এলাকা চীনের কাছে ছেড়ে দেন। পণ্ডিত নেহরু এলাকার দাবি ছেড়ে দেয়ার পর জানান যে, ‘আকসেই ছিন জায়গাটি অনুর্বর, ওখানে ঘাসের একটি পাতাও জন্মায় না।’ তাই ‘শুধু শুধু জায়গা পাহারা দিয়ে কী লাভ?’ ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা এখন দেখেছেন যে, হিমালয়ের ওই এলাকাটি ভূকৌশলগত দিক দিয়ে মোক্ষম ও গুরুত্বপূর্ণ।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়ে এখন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করার প্রশ্ন আসছে। কথা বের হয়েছে যে, রাজনৈতিক লাভের আশায় ভারত সিয়াচেন এলাকার জন্য উদগ্রীব নয়। সিয়াচেনকে ভারত শান্তির পর্বত হিসেবে ঘোষণা দিতে চায়! সিয়াচেন এমন এক এলাকা, যেটি প্রতিরক্ষা বা পাহারা দেয়ার জন্য প্রচুর অর্থ, শক্তি ও জনবল নিয়োগ করতে হচ্ছে। এই হিমবাহ এলাকায় পাকিস্তান ও ভারত উভয় যুদ্ধ করেছে, উভয় পক্ষে নিহত হয়েছে শত শত। ভারত যে পরিমাণ অর্থ ও শক্তি খরচ করছে, সে পরিমাণ লাভ নেই মর্মে ভারতের সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। পাকিস্তান মাঝে মধ্যে এমন সব সামরিক মহড়া দিয়ে এলাকায় ভীতির সঞ্চার করে যে, ভারতীয় বাহিনীকেও অস্ত্রসজ্জিত করে ফ্রন্টলাইনে ঠেলে দিতে হয়। এমন এক ঘটনা করতে গিয়ে পাকিস্তান অংশে গ্লেসিয়ারে তিন শ’র মতো পাকিস্তানি সৈন্য বরফে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করে। এমন মর্মান্তিক অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনীও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।

সিয়াচেনের ইতিহাস বেশ বিতর্কিত। সিয়াচেনের কৌশলগত অবস্থান, সিয়াচেন এলাকা ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তানের সরে আসায় আপত্তি, সিয়াচেনকে বেসামরিকীকরণে পাকিস্তানের প্রতি ভারতের আস্থাহীনতা, ভারতীয় বাহিনীর পেছনে সরে যাওয়ায় আপত্তি, সিয়াচেন প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অবস্থান ইত্যাদি বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছে।

সাধারণ জনগণ মনে করেন, সিয়াচেন সেক্টর মানে সিয়াচেন হিমবাহ এলাকা। যদি সিয়াচেন হিমবাহ এলাকা বেসামরিকীকরণ করা হয়, তবে তা তেমন অসুবিধার বিষয় নয়। পাকিস্তান চায় ভারত সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার Saltoro Ridge সম্পূর্ণ ছেড়ে দিক। কিন্তু Saltoro Ridge ১২০ কিলোমিটার লম্বা, যেখানে Actual Ground Position Line (AGPL) রয়েছে, যা কারগিল সেক্টর থেকে উত্তরের চীন সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। সিয়াচেন হিমবাহ ও Saltoro Ridge-এর অনেক কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। যেমন বলা যায়, এই এলাকার অবস্থান থেকে পাকিস্তানের উত্তরের জম্মু ও কাশ্মির এলাকার ওপর আধিপত্য বিস্তারে সুবিধা পাওয়া যায়। লাদাখ সেক্টরে যাতায়াতের রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, পাকিস্তান-চীন সড়ক যোগাযোগে সমস্যা সৃষ্টি হয়, কারগিল সেক্টরে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে বাধা দেয়া সহজতর হয়।

এক সময় এমন রব ওঠে যে, ভারত পাকিস্তানকে সিয়াচেন ছেড়ে দিচ্ছে। ভারত বলে আসছে, সিয়াচেন সেক্টরে কোনো সৈন্য মোতায়েন করবে না, যদি পুরো এলাকা বেসামরিকীকরণ করা হয়। এই বিষয়ে ভারত কিছু শর্ত দিয়েছে যেমন- Actual Ground Position Line (AGPL) পুনর্নির্ধারণ করা, লাইনটি সামরিক ম্যাপে চিহ্নিত করা এবং ভারত ও পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর করা সামরিক গ্রাউন্ড ম্যাপ পরস্পর বিনিময় করা। ভারতের প্রাক্তন বিদেশ সচিব, পাকিস্তানে ভারতের রাষ্ট্রদূত এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা প্রয়াত মি. জে এন দীক্ষিত তার রচিত Anatomy of a Flawed Inheritance বইতে সিয়াচেন বিষয়ে অগ্রগতি না হওয়ায় পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের দোষারোপ করেছেন। তার ভাষায়- 'First, while agreeing that troops would be redeployed at mutually agreed points, they refused to confirm cartographically the points from which their troops would be withdrawn.' অন্য এক জায়গায় তিনি মন্তব্য করেন, "The objective was clear. They (Pakistan) not only wanted India to vacate its strategically secure position on Siachen, making the area a 'no man's land' but also wished to lay claim to several thousand square miles of Indian territory South and South-Westwards from Karakoram ranges to establish future legal claims on the area. One had come to an Impasse."

ভারতীয় সেনাবাহিনী Saltoro Ridge-এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু উঁচু জায়গা দখল করে নিয়েছিল। এই জায়গা দখলে অবশ্য ভারতকে অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। রাজনৈতিক কারণে ভারত Saltoro Ridge থেকে সরে এলে স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কৌশলগত এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হবে। ভারতের জন্য এ বিষয়টি ন্যক্কারজনক ও দুঃখজনক হবে মর্মে তাদের সমরবিশারদরা মনে করেন। পাকিস্তান দাবি করে, এই সীমান্ত অঞ্চলটি পাকিস্তানের এবং বেসামরিকীকরণের ধুয়া তুলে ভারত সেনা অভিযান চালাবে। পাকিস্তান এটা মানতে নারাজ।

সিয়াচেন ২০ হাজার ফুট ওপরে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। দিনে তাপমাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৮৪ সাল থেকে ভারত নিয়মিত পাহারা দিচ্ছে। সেখানে ভারতীয় সেনাদের ১৫০টি পোস্ট রয়েছে। এসব পোস্টে ১০-১৫ হাজার সেনা নিয়মিত পাহারা দেয়। সেনা মোতায়েনের জন্য ভারত সরকারের বছরে এক হাজার ৫০০ কোটি রুপি খরচ হয়। বিরূপ আবহাওয়ার জন্য সেনারা সেখানে মাত্র ৩ মাসের জন্য দায়িত্ব পালন করে; এজন্য তাদের কাশ্মিরের গুলমার্গে অবস্থিত High Altitude Warefare School-এ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এমন অনেক পোস্ট আছে, যেখানে পর্বত ক্লাইম্বিং করে যেতে হয়। সেটি এক জীবন-মরণ সমস্যা। বরফের পর্বতে ওঠার জন্য পেরেকবিশিষ্ট জুতা পরতে হয়, যার ওজন তিন কেজি করে; পিঠে থাকে ৩০-৩৫ কেজির জিনিসপত্র। অনেক পোস্টে হেলিকপ্টার ছাড়া যাওয়া যায় না। হঠাৎ তুষারঝড় হলে হারিয়ে যায় কপ্টার। তাই একটি পোস্টে হেলিকপ্টার ৩০ সেকেন্ডের বেশি থাকে না। সেনাবাহিনী চিতা নামে বিশেষ কপ্টার এখানে ব্যবহার করে। তুষারঝড় কখন হয় তা কেউ বলতে পারে না। ঝড় নিমিষেই সব তছনছ করে দিতে পারে। এমন এক ঘটনায় তুষারঝড়ে হারিয়ে যাওয়া ভারতীয় সৈনিকদের ১৭ বছর পর খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। একটি সেনা পোস্ট আছে, নাম ‘ইন্দির কল’ সেখানে যেতে ২০-২২ দিন লাগে। এই দুর্গম পথে পাকিস্তানি সেনা ছাড়াও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বড় শত্রু। এত উঁচুতে অক্সিজেন কম থাকায় সেনারা বিভিন্ন রোগে ভোগে, যেমন দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া। অক্সিজেন কম থাকায় মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে। ঠাণ্ডায় ঘুমানোর জন্য সেনারা ঘরের ভেতর বোখারি নামে ফায়ার প্লেস ব্যবহার করে। সেখানে মূলত কপ্টারে করে খাবার পাঠানো হয়। একটি ৫ রুপির রুটি নিতে ২০০ রুপি খরচ পড়ে। ঠাণ্ডার কারণে এই তিন মাস সেনারা গোসল করতে পারে না। সিয়াচেনে কাজ করতে পাকিস্তানিদের চেয়েও ঠাণ্ডা বৈরী আবহাওয়া ভারতের বড় শত্রু।

পাকিস্তান ভারতের সাথে শান্তি, বন্ধুত্ব ও নিরাপত্তার চুক্তি করতে চায়। এক সময় মনমোহন সিং প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে ‘করব’ বলেও তা হয়নি। সিয়াচেন হিমবাহ এলাকা, স্যার ক্রিক সীমান্ত বিরোধ, বাগলিহার বাঁধ, কাশ্মিরে প্রবাহিত অনেক নদীর পানিপ্রবাহ ইত্যাদি সমস্যা দ্রুত নিরসনের জন্য কংগ্রেস গুরুত্ব দিলেও মূল কাজ হয়নি। এনজে ৯৮৪২ ম্যাপ অনুসারে সিয়াচেন নিয়ন্ত্রণ রেখা বা (Line of Control, LOC) বরাবর সেনাশূন্য বা demilitarisation এলাকা করার বিষয়টিতে খুব সামান্য অগ্রগতি হয়েছে। উভয় পক্ষের লোকবল ও সম্পদ ক্ষয়ের কারণে মনে করা হয়, কৌশলগত এলাকা হিসেবে সিয়াচেনকে ব্যবহার করার বাসনা উভয় দেশের ছেড়ে দেয়া উচিত এবং দীর্ঘ দিন ধরে যে সামরিক অভিযান চলছে, তারও অবসান হওয়া উচিত।

ভারত পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছে, ভারতীয় বাহিনী Actual Ground Position Line (AGPL)-এর Saltoro Ridge বরাবর অবস্থান করবে। পাকিস্তান বলছে, ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে সিয়াচেন হিমবাহের দক্ষিণে ভারতের অবস্থান মেনে নেয়া যায় না। তাহলে পাকিস্তান যেকোনো সময় আক্রমণ চালিয়ে সুবিধাজনক এলাকাটি দখল করে নিতে পারে। কৌশলগত সুবিধার কারণে পাকিস্তানের জন্য এই দখলদারিত্বমূলক আক্রমণ কোনো সমস্যা নয়। ভারতের সমরবিদরা রাজনৈতিক নেতাদের বলে রেখেছেন, পাকিস্তান চুক্তি ভঙ্গ করে সামনে অগ্রসর হয়ে অগ্রবর্তী অংশ একবার দখল করলে সেটি পুনর্দখল করা ভারতের পক্ষে একটা ‘টোটাল ওয়ার’ ছাড়া সম্ভব হবে না। কেননা জায়গাটি দুর্গম, যাতায়াত কষ্টসাধ্য, বিশেষ প্রশিক্ষিত যোদ্ধারাও সেখানে যেতে চায় না, নানান অসুবিধার সম্মুখীন হয়। যার কিছু বিবরণ ওপরে দেয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। রাজনীতিবিদরা যেন জাতীয় নিরাপত্তার দিক উপেক্ষা না করেন। তবে এখানে সম্মুখসমরে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের অসুবিধা বেশি। পাকিস্তান মনে করে, কারগিলে সম্মুখসমরে ভারতীয়দের পরাজয় হয়েছে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সিয়াচেন নিয়ে পাকিস্তানকে বিশ্বাস করতে অসুবিধার চেয়ে সুবিধা বেশি।

সিয়াচেন অঞ্চল সেনাবিহীন ভূখণ্ড ঘোষণার জন্য সত্যিই যদি চুক্তি হয়, উভয় পক্ষের সেনা কর্মকর্তারা পরবর্তী করণীয়গুলো সারতে পারবেন। উভয় দেশের DGMO একত্রে বসে প্রত্যাহারের খুঁটিনাটি বিষয় ও মনিটরিং সম্পন্ন করতে পারবেন। সেনা প্রত্যাহার বাস্তবে প্রত্যক্ষ করার জন্য ভারত স্যাটেলাইট ইমেজ ও বিমানের সহায়তা নিতে পারে। পাকিস্তানও এরিয়েল সার্ভে যন্ত্রপাতি ও গোয়েন্দা নজরদারির ব্যবস্থা করতে পারে। ভূমিতে বসানো সেন্সরের সাহায্যেও নজরদারি করা যায়। তবে মনে রাখতে হবে, রাজনীতি যদি মাঠের বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যমূলক না হয়; তবে বিপর্যয় বয়ে আনবে। পরমাণু ও সামরিক দিক দিয়ে ভারত শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে। তাই সিয়াচেন থেকে পিছু হঠার কোনো কারণ নেই বলে সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ওইদিকে ওয়াজিরিস্তান ও বেলুচিস্তান সঙ্কট পাকিস্তানকে দুর্বল করে রেখেছে এ কারণে ভারতের সাথে সীমান্ত সঙ্ঘাত পাকিস্তান এড়াতে চায়। মনে হয় বাংলাদেশের উত্থান নিয়ে পাকিস্তান কোনো শিক্ষা লাভ করেনি। ওয়াজিরিস্তান ও বেলুচিস্তানে ‘লেবেল প্লেইং’ থেকে ‘সেনা প্লেইং’ বেশি কাজ করছে। বালুচরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসেবে সুপরিচিত। তাই পাকিস্তান সেখানে হুট করে কোনো সঙ্ঘাত সৃষ্টি করেনি এত দিন। সিয়াচেনের পারিপার্শ্বিক অবস্থায় প্রতীয়মান হয়, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সিয়াচেন যেন দ্বিতীয় কাশ্মির।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement