মোদি-অমিত কি জরুরি আইনের দিকে?

অমিত শাহ্ যে গুজরাটের দাঙ্গাবাজ পুরান গুণ্ডা, দিল্লিতে এসে তিনি সে প্রমাণ আবার রেখেছেন।

ভারতের একাডেমিক জগতের ও হবু শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় কোনটা? ভারতের অভ্যন্তরীণ বিচার ও চোখে নামকরা, উঁচু প্রেস্টিজের বিশ্ববিদ্যালয় বলতে সম্ভবত সবাই বলবে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, সংক্ষেপে জেএনইউ।

সেই জেএনইউতে গত ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যার অন্ধকারে রাস্তার আলো নিভিয়ে সব গেটে পুলিশি পাহারা বসিয়ে কেবল বিজেপি সমর্থকদের লাঠিসোটা নিয়ে প্রবেশ করিয়ে বিরোধী শিক্ষার্থীদের হলে ঢুকে নির্বিচারে পেটানো হয়েছে। আবার কয়েক ঘণ্টা পর হামলাকারীদের অবাধে বেরিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করে, সব রাস্তার বাতি জ্বেলে দিয়ে সব গেট থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়। পরে এসব হামলাকারীর কিছু ছবি মিডিয়াতে দেখা গেছে। তাতে হামলাকারী সবারই মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা দেখা ছিল। এই হামলায় ছাত্র সংসদের ভিপি ঐশী ঘোষসহ প্রায় ৩০ জন গুরুতর আঘাতের শিকার হয়েছেন। আনন্দবাজার লিখেছে, ‘প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ১৮ জন পড়ুয়াকে (পিজি) এমস-এ ভর্তি করা হয়েছে। অন্তত দু’জনের অবস্থা গুরুতর। শুধু হস্টেল নয়, ক্যাম্পাসে গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। পাথর ছোড়া হয়। মেয়েদের হস্টেলে এসিড নিয়েও হামলার চেষ্টা হয় বলে অভিযোগ।’ এখানে লক্ষণীয়, হামলাকারীরা এসিডও বহন করছিল আর তা নিয়ে হামলা হয়েছে।

ইংরেজি ওয়েব মিডিয়া ‘দ্য স্ক্রল’ চারটি প্রশ্ন তুলে এক আর্টিকেল লিখেছে। এক. ফুটপাথের আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছিল কেন? দুই. কেন গেটের পুলিশ বেছে কাউকে ঢুকতে দিয়েছিল, আর কাউকে দেয়নি? তিন. যারা আগ্রাসীভাবে ও সশস্ত্র হয়ে ঢুকছিল পুলিশ কেন তাদের আটকিয়ে রাখেনি? চার. গেটেই সন্ত্রাসী গ্যাংটাকে পুলিশ কেন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেনি?

বলা বাহুল্য, এই চার প্রশ্নেই সব জবাব ও পুলিশের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ আছে।

তবে মূল কথা, মুখ ঢেকে মুখোশ পরে হামলা করলেও মিডিয়ায় বা সামাজিক স্তরে হামলাকারীরা আর ‘অজ্ঞাত’ নয়। মিডিয়াতেই এটা প্রতিষ্ঠিত যে হামলাকারীরা আরএসএসের ছাত্র সংগঠন এভিবিপি (অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ), তাদের নেতৃত্বই এই হামলা হয়েছে। আনন্দবাজার লিখেছে, ‘বিকেল থেকেই ক্যাম্পাসে ভিড় জমতে শুরু করে। মুখোশধারী গুণ্ডারা প্রথমে সাবরমতী ধাবার বাইরে জড়ো হয়। পড়ুয়াদের অভিযোগ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এবিভিপি নেতা-নেত্রীরা ভাড়াটে গুণ্ডাদের নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকে। রড, লাঠি, বাঁশ নিয়ে পড়ুয়াদের ওপর চড়াও হয় তারা। হস্টেলের আলো নিভিয়ে দিয়ে হামলার পাশাপাশি সাবরমতী, কাবেরী, পরিয়ার হস্টেলে ভাঙচুরও চলে। পড়–য়াদের অভিযোগ, আরএসএস-ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের চিনিয়ে দিয়েছিলেন।’

জেএনইউ নিয়ে গর্ব বা একে নামকরা বলার পেছনে অনেক কারণ বা বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন এর সাবেক ছাত্ররা ভারতের একাডেমিক বা কর্মজগতে বড় বড় জায়গা নিয়ে আছেন। আবার অনেক গরিব বা সামাজিক স্ট্যাটাসের বিচারে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু মেধাবী হওয়ার কারণে এখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে নিজের জীবন গড়ে নিতে পেরেছেন, না হলে কিছুই হতে পারতেন না। বলা যায় চেপে বসা সামাজিক স্ট্যাটাস বা স্তরভেদ তারা উলটে দিয়েছেন তাতে তিনি মুসলমান বা দলিত অথবা গরিব যাই হোন না কেন। এসব মিলিত কারণে জেএনইউতে সাবেক স্টুডেন্ট বা সাবেকি শব্দটাও বেশ গর্বের। কিন্তু সেটা এই ঘটনায় বিজেপির বিরুদ্ধে গেছে। হামলা চলাকালীন বা পরে বা দূরে থেকেও এই সাবেকরাই ঘটনার নিন্দা করে পাশে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আর তাতে এমনকি মোদি সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী নিজের সাবেকি পরিচয়ের গৌরব টিকিয়ে রাখতে গিয়ে হামলার নিন্দা করে বিবৃতি দিয়ে বসেন। কেন্দ্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ও অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ হামলার নিন্দা করেন। যেটা অন্য অনেক মন্ত্রী আর সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছকাছি বা পক্ষের মতো শোনায় এমন বিবৃতি দিয়েও ভারসাম্য আনা সম্ভব হয়নি।

কেন অমিত শাহের জেএনইউ’র বিরুদ্ধে এত রাগ ক্ষোভ
সাধারণভাবে জেএনইউতে কমিউনিস্ট চিন্তা এখনো তুলনায় প্রভাবশালী ও ডমিনেটিং ধারা। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি তার আমলে জেএনইউ সংসদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। গত তিন সেশনে এখানে শিক্ষার্থী সংসদের প্রেসিডেন্ট কমিউনিস্ট। এমনিতেও শাসক-চিন্তা বা শাসক-বয়ান বিরোধিতা করে চলার ঐতিহ্য জেএনইউতে ছিলই। এটা সম্ভব হয়েছে জেএনইউ স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আইনে চলা ও শুরু থেকেই তা চর্চা করা হয়ে আসছে বলে। তাই এটা কমিউনিস্ট চিন্তা-চর্চার সেন্টার অবশ্যই, এমনকি এর কমিউনিস্ট নকশালী অপর ধারাও। তবে এমন কমিউনিস্ট প্রভাব কেবল ছাত্রছাত্রীদের কারণে নয়, মূলত ফ্যাকাল্টি মেম্বাররাও অনেকে প্রগতিশীল ও বামপন্থার অনুসারী বলে। এভাবেই চলছিল। কিন্তু গত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর সারা দুনিয়াতেই ‘প্রগতিশীলতা’ বা ‘বামপন্থা’ সবচেয়ে অগ্রসর চিন্তাধারা মনে করার এই ভ্যানিটি ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল। ফলে দুনিয়াজুড়ে এই চিন্তার আধিপত্য ভেঙে পড়ার শুরু এখান থেকে। এ ছাড়া পরে তা আবার এক বড় ধাক্কা খেয়েছিল। নতুন শতাব্দীতে ২০০১ সালের পর আল কায়েদা ফেনোমেনার কারণে গ্লোবাল নতুন মস্ত ইস্যু হাজির হয় ‘ইসলাম প্রশ্ন’। ‘ইসলাম ইস্যু’ এমন অজস্র গুরুত্বপূর্ণ ও সিরিয়াস প্রশ্ন তুলে এনেছিল যেমন ধরা যাক, স্পিরিচুয়ালিটি কী? শুধু তাই নয়, আরো দিক হলো এই প্রশ্নের জবাব পাওয়াটা কী খুব এসেনসিয়াল মানে অনিবার্য প্রয়োজন? এসব গুরুতর প্রশ্নের জবাব কোনো প্রগতিশীলের কাছে তৈরি ছিল না। বরং এগুলো অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন মনে করে তারা ফেলে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু সমসাময়িক প্রধান প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে না পারলে, তৈরি না থাকলে যেকোনো চিন্তার আধিপত্য ভেঙে পড়তে বাধ্য। আসলে, শুধু তাই নয়, এক ধর্মবিদ্বেষ বিশেষত ইসলামবিদ্বেষ দিয়ে এই জবাবহীনতার খামতি ঢেকে রাখা হয়েছিল এতদিন। তবে অবশ্যই আবার ব্যাপারটা এমন নয় যে, প্রশ্নকর্তাদের কাছেও জবাবটা আছে বা ছিল। তাই সার-অবস্থাটা হলো, যে বুঝতে বা আমল করতে চায় সে বুঝবে চিন্তা-জগতের বিরাট ঘাটতির গর্তটা কোথায় লুকিয়ে আছে! কারণ এটাও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, আসলে ঘাটতি লুকাতে চাইলে এই দুর্দশাকে ‘টেরর বা সন্ত্রাসীদের’ কারবার বলে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বুশের কোলে উঠে পড়ার রাস্তা খোলা ছিল। তাই অনেকে সেকালের ‘আমেরিকান প্রেসিডেন্ট’ বুশের কোলে উঠেও নিজেকে প্রগতিশীল বলে দাবি করছিল।

আর যারা নিজেকেই ফিরে দেখা- মানে রিভিউ আর ক্রিটিক্যাল চোখে ফেলে মানে নিজেরই পর্যালোচক হয়ে নিজেকে ঢেলে সাজিয়ে নেয়ার সাহস রাখে তারা নিজেকে পুনর্গঠনের পথ গ্রহণ করল। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই পথে বাংলাদেশও যতটা এগিয়েছে ভারত এর ধারেকাছেও আসেনি। খুব সম্ভবত এর একটা কারণ ভারতের রুলিং বা শাসক শ্রেণীর বয়ান। নিজের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন কম্বিনেশন ও বিকাশের কারণে ভারতের একাডেমিক জগতও শাসক-বয়ানের নিরিখে সমস্যাটাকে দেখেছিল। এই বড় দিকটা না দেখে পাস কাটাতে চেয়েছিল। তাই নিজ চিন্তার খামতি নয় বরং ব্যাপারটাকে ‘টেররিজম’ হিসেবে দেখার বয়ান মেনে নিয়েছিল। তাই ‘ইসলাম প্রশ্ন’ ভারতের কোনো একাডেমিক দুনিয়ায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো তেমন কোনো প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে- স্টাডি খোঁজাখুঁজি গবেষণা চলছে এমন জানা যায় না। যদিও ভারতের স্ট্রাটেজিক ইনস্টিটিউট অনেকগুলোই আছে যেখানে রাষ্ট্রের ডিফেন্সের চোখে ক্ষমতাকে রক্ষার আলাপ সেখানে চলে, তা দরকারিও হয়তো। কিন্তু নিজ চিন্তার দোষ, নিজ ইসলামবিদ্বেষ বোঝা বা নিজ চিন্তায় ঘাটতি বোঝার বিষয়টি সেখানে ইস্যু হওয়ার সুযোগ নেই। তা না হওয়ারই কথা। এক কথায় এসবের মিলিত কারণে ভারতের একাডেমিক ভ্যানিটি এখনো প্রগতিশীল ও বামপন্থার অনুসারীতেই আটকে আছে। তবু ভারতের অন্তত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন প্রগতিশীলতা ও বামপন্থার প্রভাব দেখা যায়- জেএনইউ আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। জেএনইউ তুলনায় অনেক বেশি প্রভাবশালী।

কিন্তু বিজেপি-আরএসএসের চোখে, হিন্দুত্বের চোখে তাকে বধ করতে, তার বয়ান ফুটো করে দিতে, তাকে প্রভাবহীন করে প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলার এখনো ক্ষমতা রাখে ও পারে এই প্রগতিশীল ও বামপন্থার বয়ান। তাই বিজেপি তার প্রতিপক্ষ হিসাবে কংগ্রেসের চেয়েও কমিউনিস্টদের প্রধান শত্রু মনে করে। এর অবশ্য অন্য একটা বড় কারণ আছে। বিষয়টা ভোট বাক্সের, বয়ানের তত নয়।

ভারতের প্রধান ধারার সব রাজনৈতিক দলই একটা পর্যায় পর্যন্ত মূলত হিন্দু জাতীয়তাবাদী যারা-ই ‘জাতি’ ধারণাটা অনিবার্য ভেবে প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে গ্রহণ করেছে মানে রাজনীতিকে রাষ্ট্র-নাগরিক-অধিকার এই ফ্রেমে ভাবে না বা বুঝেনি, বরং ‘জাতি’ হিসেবে বুঝেছে যেমন ভারতীয় জাতি বা হিন্দু জাতি হিসেবে- এমন এরা সবাই এই দলের এই ধারার। যে অর্থে কমিউনিস্টরাও জাতীয়তাবাদকে পাশে রেখেই হাঁটে। কিন্তু কংগ্রেস মূলত হিন্দুইজমের জাতি-বাদী রাজনীতির ধারক এবং রাহুল গান্ধী হিন্দু ভোট হারাবার ভয়ে হিন্দুত্ববাদের জন্য বিজেপিকে সমালোচনা করতে ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। বরং নিজেই নিজেকে ‘সফট হিন্দুত্ববাদী’ বলে লেভেল দেয়। এর বিপরীতে কেউ হিন্দু বলে কমিউনিস্টদের ভোট দেবে তা আশা করা যায় না। এ কারণে বিজেপির সমালোচনায় কমিউনিস্টরা তুলনায় অন্তত কংগ্রেসের চেয়ে এগিয়ে ও বেপরোয়া। এ কারণেই কমিউনিস্ট প্রভাব অমিত শাহের বিশেষ চক্ষুশূল। এ জন্যই কমিউনিস্টদের ‘টুকরোটাকরা গ্যাং’ বলে নাম দিয়ে তুচ্ছ করা শুরু করেছেন অমিত শাহ্। বিজেপির চোখে ‘হিন্দু-জাতির’ জন্য ‘দেশপ্রেম’ একটা আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য আর যাদের তা নেই তারা দেশদ্রোহী- এই বিচারে কমিউনিস্টরা দেশদ্রোহী। মুখ ঢেকে অন্ধকারে হামলার সময় তাই বিজেপি কর্মীদের স্লোগান ছিল- দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। যেটা তাদের আসলে ‘মরাল-শক্তি’ যোগানদার।

অমিত শাহের দৃঢ়বিশ্বাস ভারতে মোদি-অমিতের যে বাধাহীন তাণ্ডব বা প্রভাব বাড়ছিল তা হঠাৎ নাগরিকত্ব ইস্যুতে পা-হড়কে পড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ এই কমিউনিস্টরা। সংখ্যায় এরা কিছুই না কিন্তু ‘এরা গ্যাং’। বিরাট উসকানিদাতা, যা হিন্দুত্ববাদের সুড়সুড়ি বা বিজেপির তৈরি পোলারাইজেশন উল্টে দিতে পারে। অতএব, এদের দৈহিকভাবে হামলা করো, ভয় দেখাও, যেভাবে পারো দমাও।

অমিত শাহের এই হিসাবটাও ভুল। বর্তমানে নাগরিকত্ব ইস্যুতে বিজেপিবিরোধী এই আন্দোলনের আসলে এখন পর্যন্ত মূল শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষার্থীরা। একজন মানুষ কেবল মুসলমান বলে তাকে অধিকারবঞ্চিত করতে হবে, আর এর দায় বিজেপি ওই শিক্ষার্থীদেরও নিতে ও সমর্থন করতে বলবে- এটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে তাদের কাছে। বিজেপির এই মূল্যবোধ তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গ আর আসাম (নর্থ-ইস্ট) বাদে বাকি রাজ্যে এবারের আন্দোলনের মূল শক্তি এই তরুণ শিক্ষার্থীরাই। সম্ভবত এটা বলা সেফ হবে যে, গত ছয় বছর মোদি-অমিতেরা জয় শ্রীরাম বলানো বা লিঞ্চিং-এর হুজুগে যে তরুণদের সংগঠিত করেছিল তারা আলাদা। লিঞ্চিংয়ের তরুণরা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক তরুণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় কম শিক্ষিত ও কম শহুরে। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক তরুণ শিক্ষার্থীরা এখনো কম শিক্ষিত ও কম শহুরে তরুণদের রিপ্লেস করে রাখতে পারছে, মাঠছাড়া করে রাখতে পারছে।

তবে কম শিক্ষিত ও কম শহুরে আগের তরুণদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক তরুণ শিক্ষার্থীদের সমর্থক ও পাশে এসে দাঁড়ানোর মতো জনগোষ্ঠী সমাজে অনেক। যেমন মুসলমানরা তো আছেই সেই সাথে নানা কারণে যারা বিজেপির বিরোধী এমন সবাই এদের সাথে শামিল হয়েছে।

কাজেই নাগরিকত্ব ইস্যুতে যারা মোদি-অমিতের সরকারের বিরোধী, যারা প্রতিবাদের সংগঠক বা পালটা বয়ানদাতা তারা সবাই কমিউনিস্ট এমন নয়। সাধারণভাবে এরা ‘আধুনিক মনের ফ্রিডম’ পছন্দের তরুণ। যাদের সাথে বিজেপির মূল্যবোধের ফারাক বা গ্যাপ অনেক বড়।

তবে কেউ শাসক হিসেবে সামনে গণপ্রতিরোধ দেখলে তাদের পিটিয়ে, ভয় দেখিয়ে ঠাণ্ডা করতে হবে এটা হিটলারি চিন্তা চর্চা করার পথ। তাহলে সব মিলিয়ে অমিত শাহের চোখে এসব কিসের ইঙ্গিত?

পরিকল্পিত দাঙ্গা করে সেখান থেকে নিজেই নিজের লক্ষ্য বের করে আনাতে অমিত শাহ্ নিজেকে সিদ্ধহস্ত মনে করেন। ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলমান মেরে হাত পাকিয়ে তার এই গভীর আস্থা অর্জনের শুরু। সেই অমিত শাহ্ এখন কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আর ওদিকে জেএনইউ দিল্লির কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অন্তর্গত। অর্থাৎ জেএনইউ দিল্লির রাজ্য সরকারের এখতিয়ারের এলাকা নয়। এই সুযোগ নিয়ে অমিত শাহ্ দিল্লির পুলিশ কমিশনার অমূল্য পট্টনায়কের অধীনে জেএনইউয়ের তাণ্ডব ঘটিয়েছেন। ক্যাম্পাসে এভিবিপিকে ঢুকিয়ে গুণ্ডামি করে আবার তাদের সেফ এক্সিটের ব্যবস্থা করে দিয়ে পুলিশ ফিরে গেছে। কিন্তু তবু অমিত শাহ্ এখানে পরাজিত। কেন?

পরের দিন মানে সাত জানুয়ারির এক টিভি টকশোতেই সব ফাঁস হয়ে যায়। ভারতের টকশো বাংলাদেশের টকশোর মতো নয়, ভয়ের খাঁড়া ঘাড়ের ওপর ঝুলছে- ঠিক এ রকম নয়, তুলনামূলক স্বাধীন। আর ভালো টকশো মানে ভালো টিআরপি- এটা প্রতিযোগিতামূলক ভারতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ওই কথিত টকশোতে বিজেপির পক্ষ থেকে ছিলেন এবিভিপির দিল্লি শাখার এক যুগ্ম সম্পাদক অনিমা সোনকর। টকশোতে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে চাপ সামলাতে না পেরে একপর্যায়ে ওই মুখোশ-হামলার পক্ষে সাফাই দিতে গিয়ে তিনি সব স্বীকার করে ফেলেন। তিনি বলেন, “সেদিন এমনই ‘ভয়ের পরিবেশ’ তৈরি হয় যে, ‘আত্মরক্ষায়’ রড, লাঠি এমনকি এসিড সাথে রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন তারা। নির্দেশও তেমনই ছিল-” এটা আনন্দবাজার লিখেছে। আরো লিখেছে, “অনিমার দাবি, বামপন্থী পড়–য়াদের ‘লাগাতার আক্রমণের’ মুখে এবিভিপির সদস্য ও নেতারা এত ‘ভীত-সন্ত্রস্ত্র’ ছিলেন যে, ঘর থেকে বাইরে বেরোলে সাথে আত্মরক্ষার সরঞ্জাম রাখতে বলা হয়েছিল প্রত্যেককে। লাঠি, রড, গোলমরিচ গুঁড়ার স্প্রে, এসিড- যে যা হাতে পেয়েছেন, তা-ই সাথে নিয়ে রেখেছিলেন বলে জানান তিনি। টিভি চ্যানেলে তিনি এ-ও মেনে নিয়েছেন যে, বিকাশ এবিভিপির কর্মী [যাকে বিভিন্ন মিডিয়ায় ছবিতে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছিল।] বেফাঁস বলছেন বুঝতে পেরেই অবশ্য বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় লাঠি হাতে যাকে দেখা যাচ্ছে, তিনিই বিকাশ কি না, তা নিশ্চিত করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বলেন, ‘কোনো হস্টেলে এসিড আক্রমণের ঘটনাও তার জানা নেই।’

এক কথায় বললে, অমিত শাহ্ এখন পুরা ধরা খেয়েছেন। সব কিছুই এখন ওপেন সিক্রেট। ঘটনা এখন আদালত পর্যন্ত যদি যায় বা যখন যাবে তাতে পুলিশ অফিসারসহ অনেকেই নিজেকে শাস্তি বা চাকরিচ্যুতি থেকে বাঁচাতে পারবেন মনে হয় না। তাতে পুলিশ তদন্ত রিপোর্ট এখন অমিত শাহ্ যেভাবেই লেখান না কেন!

তাহলে এখন অমিত শাহ্ এ ঘটনা থেকে কী শিক্ষা নেবেন? এটা বলাই বাহুল্য, মুখোশ পরে এমন বেধড়ক মার দেয়া অমিত শাহ্কে সামনে আরো অনেকবার করতে হবে। এ ছাড়া তার পক্ষে আরো চার বছর ক্ষমতায় থাকা মুশকিল। তাহলে উপায়?

একটাই সহজ উপায় আছে। আর অমিত শাহ্ ধীরে ধীরে তাই গ্রহণ করতে যাবেন সম্ভবত!
সেটি হলো- জরুরি আইন ‘ঘোষণা করে দেয়া। না, ভারতে জরুরি আইন এত অপ্রচলিত বা নতুন তা নয়। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালের জুনে এর নমুনা রেখে গিয়েছেন। এতে বিরাট সুবিধা হলো মিডিয়াসহ বহু কিছুই এখানে নির্দেশ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া যায়। যেমন এই ঘটনায়, মিডিয়ায় টকশো চালু রেখে জেওএনইউ’র মতো ঘটনা চালাতে যাওয়াতেই তো সব সমস্যা। কাজেই মিডিয়ায় বিধিনিষেধ আরোপ করতে চাইলে ‘জরুরি আইন’ জারি করে নেয়ার চেয়ে ভালো বিকল্প নেই। যেমন এবার সবই তো ঠিক ছিল কিন্তু যুগ্ম সম্পাদক অনিমা সোনকর টকশোতে কথা বলতে গিয়েই সব কেঁচে গিয়েছে। কাজেই এই টকশোটা বন্ধ থাকলে এসবের ফাঁস হওয়ার কোনো সুযোগই থাকত না। তাহলে নিশ্চয় অমিত শাহ্ এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাখবেন।
অতএব মোদি-অমিত কি জরুরি আইন ঘোষণার দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে গেলেন!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com