১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্থানীয় সরকার নির্বাচন : একটি বিকল্প ভাবনা

-

অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে আমার কথা বলা অনেকের কাছেই অনধিকার চর্চা মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে সমস্যাগুলো এতই প্রকট যে সাধারণ জ্ঞান নিয়েও সহজে এগুলো সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা যেতে পারে। তা ছাড়া অর্থনীতির সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাষ্ট্রের প্রতিটি ঘটনা অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। তাই রাষ্ট্র বিজ্ঞান সম্পর্কে অবহিত থাকাও একজন অর্থনীতিবিদের অন্যতম দায়িত্ব। আসলে সমাজে যে পরিবর্তন হয়, তা আসে চিন্তাধারা থেকে। পুরনো ধারণার জায়গায় নতুন ধারণা আসে। কেউ যখন কোনো নতুন ধারণা উপস্থাপন করেন তখন অনেকেই ভাবেন এটা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। যুগে যুগে এমনটাই দেখা গেছে। যখনই কেউ কোনো নতুন ধারণা উপস্থাপন করেছেন, তখন তা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে মূলত স্থিতিশীলতা রক্ষার পক্ষে থাকা শক্তিগুলোর কাছ থেকে। এর কারণ হলো সব সমাজেই একটি কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী থাকে। নতুন ধারণা তাদের সেই স্বার্থকে বিপন্ন করে। ফলে তারা প্রতিরোধ তৈরি করে। এতে অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়। সাধারণত আমলা শ্রেণীর কাছ থেকে নতুন কোনো ধারণা আসে না। তবে মৌলিক ধ্যানধারণা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক ভিশন থাকা বাঞ্ছনীয়। সবার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। ক্ষমতা প্রয়োগের এখতিয়ার আছে এমন কারো পক্ষেই এটা সম্ভব। অথবা তার মনে অন্তত প্রত্যয় জন্মাতে হবে যে এ ধরনের একটি পরিবর্তন দরকার। এই পরিবর্তনকেই বলা হয় প্যারাডাইস চেঞ্জ বা আমূল পরিবর্তন। অর্থনীতি শাস্ত্রে শরহশবফ ফবসধহফ পঁৎাব নামের একটি বিষয় আছে। এখানে এসে চাহিদা ও সরবরাহ আর স্বাভাবিক থাকে না। রেখাটি থেমে গিয়ে অন্যদিকে বেঁকে যায়। এখান থেকেই শুরু হয় পরিবর্তন, যা বৈজ্ঞানিক বিপ্লব। ১৯৬০-এর দশকে টমাস কুন তার স্ট্রাকচার অব সাইন্টিফিক রেভ্যুলিউশন বইয়ে এই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের কথা বলেছেন। এভাবেই সমাজে বিবর্তন ঘটে। নতুন ধারণাগুলো বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হলেও আবার ধারণাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া না গেলে আঁতুরঘরেই সেগুলোর মৃত্যু হয়। তাই ধারণার বাস্তব রূপায়ণের সাথে প্রতিষ্ঠানও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সাধারণ কাঠামো। এই বিপ্লব যেকোনো বিষয়ে হতে পারে। এটা হতে পারে রাজনীতিতে, হতে পারে অর্থনীতিতে, বিজ্ঞানে বা সমাজ বিজ্ঞানে। এমন কি খেলার মাঠেও হতে পারে- খেলার নিয়মকানুন বদলে দিলে।

এরই প্রেক্ষাপটে আজ আমরা যদি আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার দিকে তাকাই দেখব এ নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়টিই পরিবর্তন করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে পশ্চিমা গণতন্ত্র প্রযোজ্য নয়। যদিও অনেক উন্নয়নশীল দেশে পশ্চিমা গণতন্ত্র বিদ্যমান। আমার এই বিরোধিতার কারণ হলো পশ্চিমা গণতন্ত্রের পূর্বশর্তগুলো আমাদের এখানে অনুপস্থিত বা শর্তগুলো পূরণ করা হয়নি। পশ্চিমা জগতের মানুষ তাদের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তারা ইস্যু বোঝে, কারণ সেখানে প্রায় শতভাগ মানুষ শিক্ষিত। ফলে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে তারা কে কোন দল করছে সেটা কমই আমলে নেয়। তারা ভোট দেয় কোনো ইস্যুতে। সম্প্রতি ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আমরা এটা দেখেছি। তাদের লিখিত কোনো সংবিধান নেই। কিন্তু তাদের প্রথা ও প্রজ্ঞা এত প্রবল যে যখন কোনো সমস্যা দেখা দেয় তখন সবাই এক জায়গায় বসে আইন প্রণয়ন করে। আমাদের দেশে এমনটা কি হওয়া সম্ভব? এমনটা হওয়া এখানে বরং বিপজ্জনক। গণতন্ত্রের পূর্বশর্তগুলো আমাদের এখানে শক্তিশালী না হওয়ায় দেখা যাবে প্রতিদিনই সংবিধান পরিবর্তন করা হচ্ছে। এটি ভয়াবহ পরিণতির দিকে আমাদের নিয়ে যাবে। আমাদের এখানে অনেকবার সংবিধান পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এতে চেক-অ্যান্ড-ব্যালেন্স অনুপস্থিত। আর সময়ে সময়ে যেসব পরিবর্তন করা হয় সেগুলো চরম বা প্রান্তিক ধরনের। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে আমাদের তৃণমূল পর্যায়ের তথা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।

৩০ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকায় নির্বাচন। যাকে সিটি করপোরেশন নির্বাচন বলা হচ্ছে। মহানগরীর দুই অংশে অর্থাৎ দক্ষিণ ও উত্তর অংশে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যান্য মহানগর, নগর বা পৌরসভাতেও এ ধরনের নির্বাচন হয়। যাকে বলা হয় স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এসব নির্বাচন নির্দলীয় হওয়ার কথা থাকলেও দলীয় সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে এবং দলীয় প্রতীকেই নির্বাচন হচ্ছে বলে এখন পর্যন্ত স্পষ্ট।

এ দেশে নির্বাচন নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। নির্বাচন কিভাবে সুষ্ঠু হবে কিংবা পেশিশক্তি কিভাবে প্রতিরোধ করা যাবে অথবা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার মানসিকতা বিদায় করতে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত তা নিয়েও তুমুল বিতর্ক চলে। আমি এসব বিতর্কে যাবো না। তবে এই বিতর্ক থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট। জনগণ যে সুফল পাওয়ার জন্যই নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে চান সেটা কেউ অস্বীকার করেন না। কিন্তু এই সুফল পাওয়ার উপায় কি?

স্থানীয় সরকারে যারা নির্বাচিত হন তারা পার্লামেন্টে আইন পাস করতে নির্বাচিত হন না। এই নির্বাচনে ব্যক্তিরা নির্বাচিত হন স্থানীয় জনগণের কল্যাণ করতে। অর্থাৎ এখানে কর্ম মুখ্য। যদি তাই হয়; তাহলে আমরা কি এমন কোনো ব্যবস্থার দিকে যেতে পারি যেখানে কোনো ব্যক্তির বদলে জনগণ কর্মভিত্তিক অ্যাজেন্ডাকে ভোট দেবে? বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হচ্ছে সেটা উল্টোদিক থেকে ভাবলে কেমন হয়, আমরা প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে তার কর্মসূচিকে ভোট দেবো। দলীয় প্রার্থী থাকতে পারেন, দল থেকে মনোনয়নও দেয়া হতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক প্রার্থীর একটি কর্মপরিকল্পনা থাকবে। স্থানীয় সমস্যাগুলোর ভিত্তিতে তৈরি করা ওই কর্মপরিকল্পনায় চার বা পাঁচ বছরের মেয়াদকালে যেসব কাজ করা হবে সেগুলো তুলে ধরা হবে। তখন জনগণ প্রার্থীর বদলে তার কর্মসূচিকে ভোট দিতে উৎসাহিত হবে। তখন জনগণ অগ্রাধিকার বাছাইয়েরও সুযোগ পাবে।

প্রার্থী নির্বাচনের তিনটি উপাদান থাকবে : পরিকল্পনা, অগ্রাধিকার ও বাস্তবায়ন। কোনো এলাকার মানুষের সড়কের প্রয়োজন হতে পারে, কারো স্যানিটেশন বা কারো শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন। স্থানীয় জনগণের প্রয়োজন যাচাই করে প্রার্থীরা তাদের অ্যাজেন্ডাগুলো তৈরি করবে। এসব কোনো আন্তর্জাতিক সমস্যা নয় যে, অনেক যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ করতে হবে। স্থানীয়ভাবে একটি সড়ক, একটি ড্রেনের প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করতে বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তখন প্রার্থী সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে কর্মপরিকল্পনা ও অগ্রাধিকার ঠিক করবেন। এ ধরনের নির্বাচনে সরকার অর্থায়ন করবে, প্রার্থী নন। নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের পক্ষে পোস্টারিং করবে। যারা প্রার্থী হবেন তাদের জনগণের কাছে পৌঁছার সমান সুযোগ করে দেবে নির্বাচন কমিশন। এমন ব্যবস্থা করা গেলে দেখা যাবে সমাজের সত্যিকারের যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহী হয়ে উঠবেন।

সরকার আন্তরিকভাবে জনগণের কল্যাণ চাইলে শুধু স্থানীয় সরকারে এমন নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা অসম্ভব কিছু নয়। এমন নির্বাচন হবে যেখানে জনগণ ভোট দেবে প্রার্থীর অ্যাজেন্ডাকে। আবার এমনো হতে পারে অ্যাজেন্ডার ভিত্তিতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো সেখানে একটি নির্দিষ্ট শতাংশ ভোট পাওয়া প্রার্থীদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠিত হবে। সেখানে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ব্যক্তি হবেন বোর্ডের চেয়ারম্যান। এই চেয়ারম্যানশিপ পালাক্রমেও হতে পারে। তবে এগুলো হলো অপারেশনাল ডিটেইল। মৌলিক পরিবর্তনটি হলো প্রার্থীকে নয়, প্রার্থীর পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে ভোট দেবে জনগণ। আর প্রার্থীরও নির্বাচনী ব্যয় থাকবে না।

এটা হবে মৌলিক পরিবর্তন। কারণ এখানে বিভিন্ন মতের লোকজন থাকবে। ফলে চেক অ্যান্ড কাউন্টার-চেক হচ্ছে এখানে। তহবিল বরাদ্দ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দেয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এতে তাৎক্ষণিক যে সুবিধা পাওয়া যাবে তাহলো দুর্নীতি পুরোপুরি নির্মূল না হলেও সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে আসবে। জবাবদিহি বাড়বে। ভোটগ্রহণের পরদিন থেকেই এই জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হবে। আর কর্মসূচি সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে তিনি জনগণের কাছে জবাবদিহির আওতায় চলে আসবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটি অর্জিত হবে সেটি হলো সামাজিক ঐক্য। আমাদের সমাজ থেকে এই জিনিসটি চলে গেছে। আমাদের সমাজে যে অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়েছে তা দূর করা সহজ কাজ নয়। বিভিন্ন জনের মতামতের ব্যাপারে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠা হবে এর মাধ্যমে। এতে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। যখন কোনো প্রার্থীর অ্যাজেন্ডা সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পাবে সেটা ওই প্রার্থীর জন্য গর্বেরও বিষয় হবে। ফলে ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নকে তিনি অগ্রাধিকার দেবেন।

এমন ব্যবস্থা প্রবর্তনে সংবিধান পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। নির্বাচনে প্রার্থীর বদলে তার কর্মসূচিকে ভোট দেয়ার ঘটনা পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আছে বলে আমার জানা নেই। যেখানে এক দলীয় ব্যবস্থা সেখানেও কয়েকজন প্রার্থীর মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেয়া হয়। বিশ্বে বহুরকম সরকারব্যবস্থা ও নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গেছে কোনো ব্যবস্থাই দুর্নীতিকে থামাতে পারেনি। স্বচ্ছতাও আনা যায়নি।

নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে দুর্নীতির জন্ম হয় তা দূর করা, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা ও কাজে স্বচ্ছতা আনার ভাবনা থেকে আসলে আমার এ ধারণার অবতারণা। এ নিয়ে হয়তো বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বিতর্ক না হলে সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে না। আরো নতুন কোনো ধারণার জন্ম হয় না। বর্তমানে আমাদের তরুণরা রাজনীতিতে আসতে শুরু করেছে, তারা তুলনামূলক শিক্ষিত। আমাদের দেশে নির্বাচনী চর্চা সুন্দরভাবে কাজ করছে না, এ কথা সহজেই বলা যায়। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পশ্চিমাদের কাছ থেকে ধার করা। তাদের ব্যবস্থা চোখ বুজে অনুকরণ করে চললেও সেটা স্বীয়করণ করতে পারিনি। তাই দেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থেই বিকল্প চিন্তাধারা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির অধ্যাপক কিং ফয়সাল আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দা।


আরো সংবাদ



premium cement