২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

যে কথা বলতে চাই না

-

চিকিৎসা শাস্ত্রমতে বিষণ্নতা একটি রোগ। অন্যান্য নিন্দনীয় অভ্যাসের মতোই মিথ্যা বলা একটি বদ অভ্যাস। মানুষ অভ্যাসের দাস, এ কথাও বাণীচিরন্তনের মতোই যুগ যুগ ধরে পরীক্ষিত। মিথ্যা বলা যেন মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে অনেকের। বেশির ভাগ মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয় বাদী মিথ্যার আশ্রয় নেয়ার কারণে। বাদি, বিবাদি, সাক্ষী সবাই যখন মিথ্যার আশ্রয় নেন, তখন সত্য খুঁজে বের করে বিচারিক কাজে সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়া জটিল থেকে জটিলতর হয়ে পড়ে। বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা শুধু বাদি-বিবাদির মিথ্যার জন্য নয়, তাতে সংশ্লিষ্টদের পরশ্রীকাতরতাও দায়ী। বর্তমানে আইনি ব্যাখ্যা ও আইন প্রয়োগ করা হয় চাকরি যাদের ওপর নির্ভরশীল তাদের মনমর্জি মেজাজের ওপরে এমন কথা বলা হয়। ‘পুণ্যে (সৎ কাজ) আনে ধন (সম্পদ), পরিশ্রমে আসে সুখ’- এ কথাগুলো গুণীজনদের আবিষ্কৃত। পরশ্রীকাতরতা মানুষের একটি প্রবণতা যা তার কর্মে ফুটে ওঠে, যা দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। ‘পরশ্রীকাতরতা’ বলতে কী বুঝায়? এটা কি জাতিগত বা শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্য, না কি ব্যক্তিগত বিষয়? পরশ্রীকাতরতা বিষণ্নতার মতো একটি রোগ, যা সম্পূর্ণরূপে মানসিক সমস্যা। তবে পরশ্রীকাতরতা ও পরস্ত্রীকাতরতা এক নয়। বর্তমানে সমাজে বিশেষ করে উঁচুতলার ‘ভদ্র’ সমাজে পরস্ত্রীকাতরতার প্রভাব ও প্রয়োগ অনেক বেশি, যা ধর্মহীন সমাজ ও আধুনিকতার প্রতিযোগিতায় দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে মহামারীর আকার ধারণ করে প্রায় পরিবারেই অশান্তির জাল বিস্তার করছে। ধর্মহীনতার নামে আধুনিকতা এবং আকাশ সংস্কৃতির কুপ্রভাব এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু কথিত ভদ্র সমাজ শুধু ধর্মকেই কুসংস্কার মনে করে বিধায় পরশ্রীকাতরতার প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে।

পরাশ্রয় (Dependence on others) এবং পরাশ্রয়ী বা পরাশ্রিত (Protected by others) শব্দ থেকে ‘পরশ্রীকাতরতা’র উৎপত্তি। আক্ষরিক বা আভিধানিক অর্থে পরশ্রীকাতরতার অর্থ যা-ই হোক না কেন, বিবেক যেখানে বন্দী হয়ে যায় সেখান থেকেই পরশ্রীকাতরতার উৎপত্তি। সত্যকে সত্য বলে প্রকাশ না করা বা যে কোনোভাবে সত্যকে এড়িয়ে চলা অথবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজ অবস্থানকে ঠিক রাখা কিংবা উপরস্থদের অনুকম্পা পাওয়ার জন্য ‘অন্যায়’ বা ‘মিথ্যা’কে সমর্থন দেয়ার মনমানসিকতা পরশ্রীকাতরতার সাথে সম্পৃক্ত। অন্য দিকে, বিবেককে ফাঁকি দিয়ে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মিথ্যা ও অন্যায়ের স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে দেয়া থেকে পরশ্রীকাতরতার উৎপত্তি। প্রায় সব জীবজন্তুর মেরুদণ্ড রয়েছে। মানুষও মেরুদণ্ডের ওপর ভিত্তি করেই নিজ দেহকে সচল রাখে। পৃথিবীতে অনেক জীবজন্তু রয়েছে যাদের মেরুদণ্ড নেই, বুকের ওপর ভর দিয়ে চলে। যেমন- সাপ কেঁচো, কুচিয়াজাতীয় প্রাণী। কিন্তু সমাজে এমন মানুষ রয়েছে, যারা ‘মেরুদণ্ডহীন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। অর্থ, বিত্ত, সম্পদ, বংশমর্যাদা, শিক্ষাদীক্ষায় শীর্ষ স্থানে অবস্থান করেও উঁচুতলার অনেক মানুষের ললাটে ‘মেরুদণ্ডহীনের’ তকমা লেগে আছে, যা সমাজের পক্ষ থেকে দেয়া। যখন মানুষ কর্তার ‘ইচ্ছায়’ কর্ম করে, এমনকি, কর্তার ‘ইচ্ছা’ যদি নীতি বা আদর্শ ও বিবেকবহির্ভূত হয়, তার পরও নির্বিচারে সম্পাদন করে, তখন সমাজ বা মানুষ ‘মেরুদণ্ডহীন’ বলে তাকে অখ্যায়িত করে থাকে। এ মেরুদণ্ডহীনতাকে উপরতলার মানুষ আরো উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে। নিজ বিবেকের কাছে যাদের জবাবদিহিতা নেই, তারাই মেরুদণ্ডহীন হতে পারে। মেরুদণ্ডহীন হওয়া বা না হওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষা, বিশাল সম্পদ, খ্যাতি ও মর্যাদা প্রভৃতি কোনো কিছুই প্রতিবন্ধক নয়, যদি ‘বিবেক’ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যে ভেজালের কারণে দেশে ক্যান্সারসহ জটিল রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল কারা দেয়? অন্য কোনো রাষ্ট্রে সম্ভবত এত ভেজাল নেই এবং এত ওষুধ বিক্রি হয় না। অধিকন্তু ভেজাল এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ এদেশের মানুষই বিক্রি করছে। অথচ এ বিবেকবর্জিত ব্যবসা থেকে যারা অধিক হারে মুনাফা অর্জন করছে, তারাও লোক দেখানো কথিত ধর্ম-কর্মেও এগিয়ে থাকে। সুযোগ পেলেই হজ করে, প্রচুর দান খয়রাত করে। যাদের বিবেক নেই, তারাই যেকোনো অপরাধ করতে কুণ্ঠা বোধ করে না। বিবেকবর্জিত মানুষ জঘন্য অপরাধকেও অপরাধ বলে মনে করে না। কিন্তু বিভিন্নভাবে সমাজে তারাই উচ্চ আসনে বসে আছে। এর পেছনের কারণ বিবেকবর্জিত সমাজ এবং ব্যাপক সামাজিক অবক্ষয়।

পরশ্রীকাতর বিষয়টি ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, তবে হাড়ে হাড়ে অনুভব করা যায়। কয়েক ধাপ অতিক্রম করার পর চোখে পড়ে। খেটে খাওয়া দিনমজুর, যার নুন আনতে পানতা ফুরায় সে ব্যক্তিও বিবেকবান বা মেরুদণ্ড সম্পন্ন মানুষ হতে পারে। এটা নির্ভর করে নির্লোভ মনমানসিকতার ওপর।

একজন মানুষ গুণ ও দোষে প্রভাবিত। সে প্রভাবের দায় অনেক সময়ই অন্যকে বহন করতে হয়। বিবেকহীন কর্মের কারণে গোটা সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র বির্পযস্ত হয়ে পড়ে, আর ‘লাভবান’ হয় সে ব্যক্তি নিজে। অন্য দিকে, বিবেকসম্পন্ন কাজের জন্য অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হয় পুরো জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্র। সত্য কথা বলতে গিয়ে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দৃশ্যত অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল নয়। সত্য, নৈতিকতা ও আদর্শের পক্ষে থাকা সাহসের বিষয় এবং অভাবের তাড়নায় বা প্রলোভনে নিজ বিবেক বিক্রি করে দেয়নি, এমন ঘটনাও রয়েছে। তবে বিবেক বিক্রেতার সংখ্যাই বেশি।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, বুদ্ধিজীবী, যারা প্রফেশনাল বুদ্ধিজীবী বেশির ভাগই পরশ্রীকাতর। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায়, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা হক কথা না বলে চামচাগিরি করে। হয়তো প্রফেশনাল বুদ্ধিজীবীরা স্বরূপ পাল্টিয়েছেন। যে কথা বললে ক্ষমতাসীনরা খুশি হন, বুদ্ধিজীবীদের বিরাট অংশ সে কথাই বলছে। বিনিময়ে পাচ্ছে সুখে থাকার নিশ্চয়তা এবং এদের কারণে জাতি আজ বিভিন্নভাবে বিখণ্ডিত। সব বিষয়েই তাদের জিরো টলারেন্স, কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষে বা গণমানুষের অধিকার আদায়ের পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো ভূমিকা নেই তাদের। বাংলাদেশের শাসনকর্তারা পরশ্রীকাতরতাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের কিনেই দেশকে বিরাজনীতিকীকরণসহ প্রকৃত গণতন্ত্র হরণ করে সৃষ্টি করেছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনী অদ্ভুত সংস্কৃতি। এ জন্য পরশ্রীকাতরতাই দায়ী, একটি জাতীয় ব্যাধি।

রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন প্রবন্ধে, বাঙালি চরিত্রকে নিম্নরূপে চিত্রায়িত করেছেন :
‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না, আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভূরিপরিমাণ করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহঙ্কার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহবল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য’ (চারিত্র পূজা, বিদ্যাসাগর চরিত)। ‘আমরা না পড়িয়া পণ্ডিত, আমরা না লড়িয়া বীর, আমরা ধাঁ করিয়া সভ্য, আমরা ফাঁকি দিয়া পেট্রিয়ট, আমাদের রসনার অদ্ভুত রাসায়নিক প্রভাবে জগতে যে তুমুল বিপ্লব উপস্থিত হইতে আমরা তাহারই জন্য প্রতীক্ষা করিয়া আছি, সমস্ত জগৎও সেইদিকে সবিস্ময়ে নিরীক্ষণ করিয়া আছে’ (স্বদেশ ও সমাজ, চিঠিপত্র-৪)। ‘আমরা এগোবই না, অনুসরণ করি, কাজ করি না, পরামর্শ দিবো, দাঙ্গাহাঙ্গামাতে নাই, কিন্তু মকদ্দমা মামলা ও দলাদলিতে আছি। অর্থাৎ হাঙ্গামের অপেক্ষা হুজ্জতটা আমাদের কাছে যুক্তিসিদ্ধ মনে হয়’ (স্বদেশ ও সমাজ, চিঠিপত্র-৫)। ‘আমরা দলাদলি ঈর্ষা ক্ষুদ্রতায় জীর্ণ। আমরা একত্র হইতে পারি না, পরস্পরকে বিশ্বাস করি না, আপনাদের মধ্যে কাহারও নেতৃত্ব স্বীকার করিতে চাহি না’ (রাজা প্রজা, ইংরেজ ও ভারত বাসী)।

এই অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণের উপায় এখনই আবিষ্কার করতে হবে। অপর দিকে, বাঙালির অনেক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাও রয়েছে। যেমন- ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি। মনস্থির করতে হবে, আমাদের জাতিসত্তা কোন পন্থায় এবং কিভাবে গৌরবোজ্জ্বল হয়ে উঠবে। জাতিসত্তা বিনির্মাণের জন্য জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছা একান্ত জরুরি এবং এর এখনই সময়।

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement