২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মানবাধিকার প্রশ্নে পরাশক্তিগুলোর দ্বৈত নীতি

- ফাইল ছবি

সাধারণ অর্থে মানবাধিকার বলতে একজন মানুষের আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারকে বোঝায়। একজন মানুষ যেকোনো রাষ্ট্রের বা সমাজে মানুষ হিসেবে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইলে তার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অধিকার ভোগের বিষয়ে নিশ্চয়তা দেয়ার প্রয়োজন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মানবাধিকারের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্যোগ নেয়। এ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জাতিসঙ্ঘ। বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রই জাতিসঙ্ঘের সদস্য।

মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের যেসব দলিল রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৯৪৮ সালে ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার দলিল। এ দলিলটিতে ৩০টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এ দলিলে যেসব অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে প্রতিপালনে নিশ্চয়তা দিতে বলা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য না করার অধিকার; জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিনিরাপত্তার অধিকার; দাসত্বের শিকল থেকে মুক্তির অধিকার; যন্ত্রণা, নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড বা ব্যবহার থেকে সুরক্ষার অধিকার; আইনের দৃষ্টিতে সর্বত্র মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার অধিকার এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার; স্বেচ্ছচারী গ্রেফতার, আটক ও নির্বাসন থেকে অবমুক্তির অধিকার; ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিয্ক্তু ব্যক্তির আইনে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকার; স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত দিয়ে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আদালতের সামনে নিরপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার অধিকার; প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক থেকে নিজ গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার; চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার; রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে চলাফেরা ও বসবাসের অধিকার এবং রাষ্ট্র ত্যাগ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের অধিকার; নিজ দেশে নিপীড়নের বিরুদ্ধে অপর দেশে আশ্রয় লাভের অধিকার; জাতীয়তার অধিকার এবং স্বেচ্ছাচারীভাবে জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত না করার অধিকার; প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষের নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকার; একক ও যৌথভাবে সম্পত্তির মালিকানার অধিকার এবং স্বেচ্ছাচারীভাবে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হওয়ার অধিকার; চিন্তা, বিবেক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার; বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার; শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সংগঠনের অধিকার; সরাসরি অথবা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকারে অংশ নেয়ার অধিকার এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সুযোগের সমতার অধিকার; সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার; পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতার অধিকার এবং কোনো ধরনের বৈষম্য ভেদে সমকাজের জন্য সমমজুরির অধিকার; নিজ স্বার্থ সংরক্ষণে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও যোগদানের অধিকার; অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলোর অধিকার প্রভৃতি।

জাতিসঙ্ঘের সদস্যভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের সংবিধানে উপরোল্লিখিত অধিকারগুলোর সব বা কিছু কিছু মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। যখন কোনো রাষ্ট্রের সংবিধানে কিছু অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় তখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সেসব অধিকার ভোগের বিষয়ে নাগরিকদের নিশ্চয়তা দেয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।

মানবাধিকারের সাথে গণতন্ত্রের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অন্যভাবে বললে বলতে হয় মানবাধিকার ও গণতন্ত্র একটি অপরটির পরিপূরক। পাশ্চাত্যের বেশির ভাগ দেশ যার মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি নিজেদের গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দাবি করে থাকে এবং এর পাশাপাশি তারা নিজ দেশ ও অপরাপর দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় সচেষ্ট, বিশ্ববাসীকে এমন ধারণা দিতে সদা তৎপর। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি পাশ্চাত্যের এসব দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে নিজ নিজ দেশের ক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভঙ্গি তা সমভাবে অপর অনেক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় না।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের প্রথমার্ধে ঠাণ্ডা লড়াই যুগের অবসান-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে মহাশক্তিধর রাষ্ট্ররূপে পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানটি বর্তমানে আগের মতো দৃঢ় না হলেও অদ্যাবধি বিশ্বের অপর কোনো রাষ্ট্র মহাশক্তিধর হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষের পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। এ সুযোগে বিগত দুই দশকের অধিক সময় ধরে য্ক্তুরাষ্ট্র তার ইউরোপীয় মিত্রদের সহযোগিতায় অবলীলায় বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে জনমানুষের জীবনকে বিপদাপন্ন করে তুলছে।

সাদ্দাম হোসেন ইরাকের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকালীন ইরাকের কাছে মানব বিধ্বংসী রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র রয়েছে- এ মিথ্যা অজুহাতে মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনের বাহিনীকে পরাভূত করে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরাসরি রাষ্ট্রটি পরিচালনা করতে থাকে। সাদ্দামকে উৎখাত-পরবর্তী দেখা গেল ইরাকে কথিত মানব বিধ্বংসী রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্রের কোনো অস্তিত্ব নেই।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের উদ্দেশ্য ছিল তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং উৎখাত-পরবর্তী দেখা গেল ইরাকের তেল বিক্রি করে তারা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ পরিপূরণে সফল হয়েছে। অনুরূপ আফগানিস্তানে তথাকথিত আল কায়দা জঙ্গিদের ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে- এ অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগানিস্তানে বলপূর্বক প্রবেশ করে সেখানকার সরকারের পতন ঘটিয়ে নিজেদের তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করে। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনীর অভিযান পরিচালনার এক দশক পর দেখা গেল তথাকথিত আল কায়দা জঙ্গি দমনে যে অভিযান তা সফলতা পায়নি বরং তাদের অভিযানের ফলে রাষ্ট্রটির স্থিতিশীলতা বিপন্ন হওয়ার কারণে সেখানে জনজীবনে এখনো স্বস্তি ফিরে আসেনি।

বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রারম্ভে আরব বসন্তের জাগরণে তিউনিশিয়া, লিবিয়া ও মিসরে ক্ষমতাসীন বেন আলী, গাদ্দাফি ও মোবারক সরকারের পতন হয়। লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতনকে ত্বরান্বিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী অংশ নিয়েছিল। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ছিল, গাদ্দাফি তার শাসন অব্যাহত রাখার জন্য অবলীলায় বিরোধীদের হত্যা করে চলেছেন। মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তাদের কল্পনাপ্রসূত অভিযোগের ভিত্তিতে ঠিকই গাদ্দাফিকে উৎখাত ও হত্যা করল। কিন্তু তার মৃত্যু-পরবর্তী গাদ্দাফির শাসনামলে লিবিয়ায় যে স্থিতিশীলতা ছিল তা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ফিরিয়ে দিতে পেরেছে? এখনো যে লিবিয়ায় প্রতিদিন সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের সশস্ত্র সংঘর্ষে অগণিত লোক নিহত হচ্ছে এর দায় কার?

মিসরে হোসনি মোবারকের পতন-পরবর্তী অবাধ, স্ষ্ঠুু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম বাদ্রারহুড দল বিজয়ী হয়ে মুরসি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হলে দেশটি স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদেরসহ ইসরাইলের কাছে মুসলিম বাদ্রারহুডের বিজয় আরব ভূ-খণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র এবং ইসরাইলের জন্য হানিকর- এ বিবেচনায় তারা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসিকে অপসারণ করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি বরং জেলে পুরে বিচারের মুখোমুখি করেছে। মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ও ইসরাইল যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে থাকে তবে কি কারণে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসিকে অপসারণ করা হলো? এর জবাব বিশ্ববাসী য্ক্তুরাষ্ট্র এবং তার মিত্র ও ইসরাইলের কাছ থেকে জানতে চায়।

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে এখনো বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত রয়েছে। এ ধরনের বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক শাসন ইসলাম ধর্ম অনুমোদন করে না। কিন্তু এখনো য্ক্তুরাষ্ট্র এবং তার মিত্র ও ইসরাইলের মদদে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশগুলোতে রাজতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত আছে। এসব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অবস্থান রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ও ইসরাইল এসব রাষ্ট্রে রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জুগিয়ে তাদের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দাবিতে ১৯৮৯ সালে চীনের তিয়েনা আনামন স্কয়ারে হাজার হাজার লোক সমবেত হলে চীনের কমিউনিস্ট শাসকেরা নির্বিচারে গুলি করে অসংখ্য জনমানুষকে হত্যা করে। এ হত্যার ব্যাপারে য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় এবং আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে চীনকে চিহ্নিত করার জন্য পুনঃপুন প্রয়াস নেয়। সে প্রয়াস এখনো অব্যাহত আছে।

চীনে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের নির্মূলে যে সংখ্যক মানুষ হত্যা করা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মদদে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের যেভাবে হত্যা করে চলেছে তাতে দেখা যায় তার সংখ্যা তিয়েনমিয়েনের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যার চেয়ে কয়েকশ গুণ অধিক। ইসরাইলের অভ্যন্তরস্থ গাজা ও পশ্চিম তীর দু’টি স্বশাসিত পৃথক এলাকা। এ দু’টি পৃথক এলাকা সমন্বয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে পৃথিবীর সব রাষ্ট্র সম্মত হয়ে এরূপ রূপরেখা দিয়েছে।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর সাম্প্রতিক যে অত্যাচার, নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে এটিকে বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা গণহত্যা মর্মে অভিহিত করছে। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড বিষয়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যেসব রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সোচ্চার তা হলো তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। সার্কভুক্ত মুসলিম অধ্যুষিত ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ রোহিঙ্গা নিধন ও তাদের প্রতি অত্যাচার এবং নিপীড়নের প্রতিবাদে ইতোমধ্যে মিয়ানমারের সাথে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। রুশ অধীনস্থ প্রজাতন্ত্র চেচনিয়ায় মিয়ানমারের নৃশংসতার বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে বিক্ষোভ হয় তাতে পাঁচ লক্ষাধিক লোক সমবেত হয়েছিল। পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রেও ছোট-বড় বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ে এতদঅঞ্চলের দু’টি প্রভাবশালী রাষ্ট্র চীন ও ভারত সম্পূর্ণ অবহিত হলেও উভয় রাষ্ট্র এ বিষয়ে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। মিয়ানমারের ওপর চীনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এ প্রভাবকে লাঘবের প্রয়াসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরকালে রোহিঙ্গা সঙ্কটকে সহিংস বিদ্রোহী আখ্যা দিয়ে দেশটিকে কাছে টেনে নেয়ার সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছেন। অপর দিকে, চীনের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক সূত্রে বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ নিজেকে ভারতের প্রভাবমুক্ত করলে দেশটি বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক পন্থায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হবে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র ও রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিজস্ব পরিকল্পনা রয়েছে। তারা উভয়ে এ অঞ্চলে তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সশস্ত্র পন্থা অবলম্বনের ফন্দিফিকির আঁটছে।

২০০৬ সালে গাজা ও পশ্চিম তীর সমন্বয়ে গঠিত ফিলিস্তিনের ১৩২টি আসনের সংসদ নির্বাচনে ৭৬টি আসনে জয় লাভ করে হামাস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচন-পরবর্তী গাজা হামাসের শাসনাধীন রয়েছে। অপর দিকে, পশ্চিম তীর ফাতাহর শাসনাধীন। ১৯৪৮ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইহুদিদের এনে ফিলিস্তিনিদের ভূ-খণ্ডে যে ইসরাইল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়, এর পর থেকে য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ইন্ধনে ক্রমান্বয়ে ইসরাইল তার ভূ-ভাগ বৃদ্ধি করে চলেছে এবং সে যাত্রা এখনো অব্যাহত আছে।

জুলাই, ২০১৪ সালে পশ্চিম তীরে তিনটি ইহুদি বালককে অপহরণপূর্বক হত্যার অভিযোগে ইসরাইল গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধে এ পর্যন্ত গাজানিবাসী প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার বেশির ভাগ নারী ও শিশু। সামরিক শক্তির দিক থেকে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর তুলনায় হামাস অনেক দুর্বল। ইসরাইলের এ আগ্রাসী অভিযান বিষয়ে য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বলছে তাদের আত্মরক্ষার জন্য এ ধরনের অভিযানের আবশ্যকতা রয়েছে। পশ্চিম তীরে যে তিনজন ইসরাইলি বালক নিহত হয়েছে তার সাথে যে হামাসের সম্পৃক্ততা ছিল না, এ বিষয়টি বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে।

কিন্তু তার পরও নিজেদের আত্মরক্ষা করার মিথ্যা অজুহাতে শক্তিধর ইসরাইলের দুর্বল হামাসের ওপর কেন এ হামলা? ইসরাইল যদিও মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ফিলিস্তিনিদের ভূ-খণ্ডে অবৈধভাবে সৃষ্ট একটি রাষ্ট্র কিন্তু ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূ-খণ্ডে তাদের নিজস্ব রাষ্ট্্র সৃষ্টি হোক এটি কখনও ইসরাইল ও তার মদদদাতা য্ক্তুরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলো চায় না। আর তাই পুনঃপুন ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের আগ্রাসী আক্রমণ এবং নির্বিচারে নারী-পুরুষসহ নিরীহ বেসামরিক জনমানুষ হত্যা।

য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থন ছাড়া ইসরাইলের পক্ষে কখনোও এ ধরনের গণহত্যা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনি ভূ-খণ্ডে ইসরাইলের আগ্রাসী আক্রমণ বিশ্ববিবেকের কাছে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলেও য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে এটি মানবতাবিরোধী অপরাধ বা গণহত্যা নয়। য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিষয়ে দ্বৈত নীতির কারণে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমহ্রাসমান। আর এ অবস্থায় মহাশক্তিধর হিসেবে আবির্ভূত হয়ে অপর কোনো রাষ্ট্র য্ক্তুরাষ্ট্রের আগে যে অবস্থান নেবে এমনই পদধ্বনি শোনা যায়।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement