২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘রোল মডেল’ কি আসলেই নেই

-

একজন মানুষের আচরণ, কর্ম অথবা সফলতা যদি এমন হয়, যাতে অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়ে তার মতো হতে চায় বা ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে; এমন ব্যক্তিই হলেন ‘রোল মডেল’। এই ইচ্ছা বা চেষ্টা হবে নতুন বা পরবর্তী প্রজন্মের পক্ষ থেকে।

রোল মডেল শব্দযুগলের কাছাকাছি অর্থ প্রকাশ করে আরো দু’টি শব্দ। যদিও গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহনের ক্ষেত্রে এ দুটো শব্দ রোল মডেল শব্দযুগলের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। এর একটি শব্দ আইডল, অন্য শব্দটি আইকন। আইডল এমন ব্যক্তি, যার ভাবমর্যাদা মানুষ পছন্দ করে। মানুষ তার মতো হতে চায়। চলচ্চিত্র জগতে এর উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়। আর আইকন হচ্ছে কোনো কিছুর বস্তু প্রকৃতি, যা দৃশ্যমান অবয়বে সামনে রাখা যায়। আইডল আর আইকন হওয়ার প্রতিযোগিতার আয়োজন মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে। সেখানে মানবীয় বিচারে আইডল-আইকন নির্বাচন হচ্ছে।

ঢাকার একটি পত্রিকা ‘তরুণরা কী ভাবছেন?’ শিরোনামে একটি জরিপ করেছে। সেখানে ১৫-৩০ বছর বয়সী এক হাজার ২০০ তরুণের মতামত নেয়া হয়েছে। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘জাতিসঙ্ঘের সংজ্ঞায় যাদের বয়স ১৫-২৯ বছরের মধ্যে, তাদেরই তরুণ বলা হয়। বিশ্বব্যাপী এই তরুণের সংখা ১৮০ কোটি। আবার ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার বাংলাদেশে তরুণের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ। বাংলাদেশে নির্ভরশীল মানুষের তুলনায় কর্মক্ষম জনসংখ্যার পরিমাণ বেশি। এই সুবিধা থাকবে ২০৪০ সাল পর্যন্ত।’

‘কেন জরিপ, কিভাবে জরিপ’ শিরোনামে! পত্রিকাটি আরো বলেছে, তরুণ অংশের চিন্তাভাবনা জীবনযাপন ভবিষ্যতের লক্ষ্য জানা বাংলাদেশের উন্নয়নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদের এই মনোভাব জানতে পত্রিকাটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ওআরজি কোয়েস্টের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো একটি দীর্ঘমেয়াদি জরিপ চালায়।

পত্রিকাটি জরিপের ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন ধারাবাহিক প্রকাশ করছে। প্রথম কিস্তিতে জরিপের ফল জানিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে, ‘প্রতি পাঁচ তরুণের চারজনই জীবনের লক্ষ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন।’ ওই প্রতিবেদনে জরিপের তথ্যকে বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। কেন তরুণদের এমন অবস্থা, সে ব্যাপারে তারা বিশেষজ্ঞ মতামত চেয়েছেন। প্রতিবেদকের ভাষ্য মতে, বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন এ দুরবস্থার কারণ তাদের সামনে এমন কোনো রোল মডেল নেই, যাদের অনুসরণ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করবে। বিশেষজ্ঞরা এমন একসময় রোল মডেলের অভাবের কথা বললেন যখন সমাজে অসংখ্য জ্ঞানী, কর্তব্যসচেতন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া মিডিয়ার কল্যাণে তারা জানতে পারছেন চলমান সময়ে আর কারা বাইরের বিশ্বে রয়েছেন, যাদের অনুসরণ করা যায়। নিকট অতীতের গ্রেট পারসনালিটিজ যারা এমনকি দূর-অতীতের গ্রেট পরসোনালিটিজদেরও জানার সুযোগ এখন হচ্ছে। বস্তুত তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে তরুণদের সামনে রোল মডেলরা সদা উপস্থিত হয়ে রয়েছেন।
রোল মডেল প্রসঙ্গটি আমরা আরো একটু জেনে নিতে পারি। রোল মডেল নামে কিছু কোনো ভাষার ইতিহাসে পৃথিবীতে আগে হয়তো ছিল না। কিন্তু এ দ্বারা যে ভাব বা বাস্তবতা বোঝায়, এর আবহ পৃথিবীতে সব সময় বিদ্যমান ছিল। মার্কিন সমাজতাত্ত্বিক রবার্ট কিং মারটন রোল মডেল ধারণার উদ্ভাবক। ১৯১০ সালে তার জন্ম। তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। সমাজতত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেয়ার জন্য ১৯৯৪ সালে ন্যাশনাল মেডাল অব সায়েন্স পদক পান। ২০০৩ সালে তার মৃত্যু হয়।

রোল মডেল কথাটি চালু হয় ১৯৫০-এর দশকের পরে। তবে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এটি আমেরিকান শব্দকোষে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এটি প্রতিদিনকার ব্যবহারে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে এর সমালোচনা শুরু হয়েছে এবং রোল মডেল ‘সেকেলে’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। সম্ভবত এর দুর্বল মানবীয় বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরে উচ্চমার্গের ধারণা রোল মডেল পরিত্যক্ত হয়েছে মার্কিন সমাজে। ব্যাপারটি এমন যে, উত্তম চরিত্রের মানুষরা আলোচনার খোরাক; কিন্তু বাস্তবে আমল করার উপযুক্ত নয়। কারণ, ব্যাপারটা একটু কষ্টসাধ্য। এই ধরুন, একজন ফজলে হোসেন আবেদ হয়ে উঠতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। তার চেয়ে বরং কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে মজায় সময় পার করা যায়। রোল মডেল প্রসঙ্গটি আমরা নিজেরা যাচাই করে দেখতে পারি। আমাদের সঙ্কট কোথায়, সেটি বোঝার চেষ্টা করতে পারি।

বাংলাদেশের তরুণদের সামনে এখন এমন অনেকে রয়েছেন, যাদের তারা অনুসরণ করতে পারেন। তাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। যাদের কেউ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছেন। কারো কারো গণ্ডি দেশের সীমানা পেরিয়েছে। আমাদের দেশেই রয়েছেন নোবেল বিজয়ী, রয়েছেন ব্রিটেনের নাইটহুড সম্মান পাওয়া ব্যক্তিত্ব। তারপরও যখন রোল মডেল নেই বলা হয়; তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে একটু ফিরে তাকাতে পারি।

এ বিশ্ববিদ্যালয়কে একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। এখন অবশ্য আর কেউ একে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলেন না। তবে এর ছাত্র-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ আসছে; তা সাধারণের হজম করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মীয় আলোকে ভারতে করা আইন নিয়ে সেদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ হচ্ছে। বিশেষ করে সে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলা বিক্ষোভকে পুলিশ যেকোনোভাবে দমন করতে চাইছে। এর প্রতিবাদ হচ্ছে সারা বিশ্বে। এমনকি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন। তারা মিছিল-সমাবেশ করেছেন। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে ঠিক এর উল্টো ঘটনা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এর প্রতিবাদকারীদের নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের কেবল একবার পিটিয়ে হামলাকারীরা ক্ষান্ত হয়নি; উপর্যুপরি তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। শেষে এ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ডাকসুর ভিপি নুরুল হকের ওপর বর্বর হমলা চালানো হয়েছে। এর আগেও তার ওপর ৯ বার হামলা করা হয়েছে। ওইসব হামলার কোনোটির বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। হামলা চালিয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামের একটি সংগঠন। মঞ্চের দাবি হচ্ছে- ইস্যুটি একান্ত ভারতের। তাই ভারতের কোনো প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল সমাবেশ হতে পারবে না।

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ সংগঠনটি এখন দুই টুকরো হয়ে গেছে। উভয় অংশই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। ১৪ মাসের ইতিহাসে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা অনেকগুলো কাণ্ড ঘটিয়েছে। প্রতিটির পেছনে হয় টাকা না হয় নিজেদের প্রতি অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা ছিল। এ ব্যাপারে বিস্তারিত খবর প্রকাশ হয়েছে সংবাদপত্রে। সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এক পক্ষ অপর পক্ষের প্রতি কতটা ‘হীন মানসিকতা’ পোষণ করে, তাদের নিজেদের বক্তব্য থেকে এর প্রমাণ মেলে।

গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে দেয়া মন্তব্যে এক পক্ষের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন অপরপক্ষের পৃষ্ঠপোষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না।’ অন্য দিকে ওই শিক্ষক এই সাধারণ সম্পাদক সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘আমিনুল-মামুনরা ছাত্রসমাজের কলঙ্ক।’ আর নিজের সংগঠনের ব্যাপারে এই শিক্ষক বলেন, এটি একটি ‘অ্যাকশন অর্গানাইজেশন’। তার বক্তব্যের সাথে সংগঠনটির কর্মকাণ্ডে দারুণ মিল রয়েছে।

মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে কেবল অধঃগমন দৃশ্যমান। ব্যতিক্রম যা আছে তা অপকাণ্ডের আড়ালে সব ঢাকা পড়ছে। সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসরণীয় মনে করা হয়। দেশের বেশির ভাগ ছাত্র এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে চায়। সেই প্রতিষ্ঠানকে আমরা টেনে নিয়ে গেছি খাদের কিনারে। এ জন্য ছাত্র -শিক্ষক একাই দায়ী নয়, এর সাথে বৃহত্তর রাজনীতির সংযোগ রয়েছে।

মার্কিন সমাজতাত্ত্বিক রবার্ট কিং মারটনের রোল মডেল ধারণার আমাদের দেশের বাস্তবতা কী? যেখানে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোল মডেল নেই। তারা কাউকে অনুসরণ করার মতো পাচ্ছেন না। বাস্তবে আমাদের সমাজে এমন অনেককে পাচ্ছি, যারা অনুসরণীয় হতে পারেন। কারণ আমাদের সমাজে থাকা এসব বিশিষ্ট ব্যক্তি কোটি কোটি মানুষের জাগতিক সঙ্কটের সুরাহা দিয়েছেন। অর্থনৈতিক সামাজিক মুক্তি দিয়েছেন। বৈষয়িক জীবনকে আপাত শান্ত সুস্থির করতে পেরেছেন। তাহলে আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা ভুল বলছেন? না, প্রকৃত ব্যাপারটি এমন, আমাদের তরুণদের রোল মডেলদের অনুসরণ করতে দেয়া হচ্ছে না। কৌশলে তাদের মুখ এমন দিকে ফিরিয়ে রাখা হয়েছে, যা জাগতিক জীবনে কোনো অভীষ্টে পৌঁছতে পথ দেখাবে না। নাকি আমাদের তরুণরা নিজেরাই সামনে কোনো রোল মডেল রাখতে চান না। সোজা কথায় তারা কী রোল মডেলবিমুখ?
মারটন রোল মডেল বলতে যদি অনুসরণীয় কিছু বুঝিয়ে থাকেন; তাহলে পৃথিবীর ইতিহাসে সেটি একটি সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখা যায়। বিশেষ করে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এই মডেল সব সময় বর্তমান। কেউ সেই প্রতিনিধি হতে পারছেন কি না, তার সনদ কে কাকে দেবে? তবে ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী অবতাররা এ রোল মডেল। ইহুদিরা ছোট একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী হলেও ইবরাহিম ধারার প্রথম ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের দাবি করে। তাদের কাছে অনেক রোল মডেল। তারা আসমানি কিতাব তওরাতের দাবিদার। সেখানে আছে মুসা আ:-এর কথা। এই কিংবদন্তি একজন অনুসরণীয় আদর্শ। তবে ইহুদিরা যদি তাদের অনুসরণ করতেন তাহলে ফিলিস্তিনিরা কোনোভাবে বাস্তুচ্যুত হতেন না নিজগৃহ থেকে।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সম্প্রদায় খ্রিষ্টান। ২২০ কোটি মানুষ এ ধর্মের অনুসারী। তাদের কাছে রয়েছেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব ঈসা আ:। ইনজিলে তার চরিত্র নিখুঁতভাবে চিত্রিত আছে। তাদের কাছে এখন ইনজিল রয়েছে। তারা যদি ঈসা আ: তথা ইনজিলের অনুসারী হতেন; এই ধর্মের অনুসারী আমেরিকা-ব্রিটেন নির্বিচারে বিশ্বের দেশে দেশে অনাচার করতে পারতেন না। মুসা আ: ও ঈসা আ:-এর ধারাবাহিকতায় মোহাম্মদ সা:-এর আগমন। তার উপস্থাপন কেমন ছিল তা অবিকৃত অবস্থায় আমাদের কাছে বিদ্যমান রয়েছে। আমরা নিজেদের ‘মুসলিম’ দাবি করছি। নিজেদের মুহাম্মদ সা:-এর অনুসারী দাবি করছি। তহালে আমাদের মধ্যেও রোল মডেলের অভাব নেই।

প্রকৃতপক্ষে রোল মডেল আমাদের মধ্যে সব সময় বিদ্যমান। মারটনের একাডেমিক ধারণার আগেও তা আমাদের সামনে ছিল। রোল মডেলদের অনুসরণ করতে যে যোগ্যতা দরকার সেটি অর্জন করতে পারছে না মানবতা। আমাদের দেশে আমরা তরুণদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বানাচ্ছি। এটি নিম্নস্তরের একটি মানসিকতা। অন্য দিকে ধুরন্ধর রাষ্ট্রগুলো ভোগবিলাস ও চাহিদাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে অনুসরণীয় চরিত্রগুলো সামনে আসতে পারছে না।

jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement