২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

সবার নজর এখন হেগের দিকে

-

সচেতন বিশ্ববাসীর চোখ এখন নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরের দিকে। এখানকার পিস প্যালেসে অবস্থিত আন্তর্জাতিক (আইসিজে) অপরাধ আদালতে গতকাল মঙ্গলবার শুরু হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত ১১ নভেম্বর মামলা দায়ের করে আফ্রিকার মুসলিম দেশ গাম্বিয়া। দেশটি এই মামলা করেছে মুসলিম দেশগুলোর সংস্থা ওআইসির পক্ষ থেকে। মামলায় মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

এ সম্পর্কিত যেসব খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে এটি স্পষ্ট যে, আপাতত আইসিজের শুনানি হবে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার স্বার্থে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের বিষয়ে। জনসমক্ষে প্রকাশিত ও প্রচারিত তথ্যের ভিত্তিতে গাম্বিয়া আদালতে মিয়ানমারের বিপক্ষে নিজের যুক্তি তুলে ধরবে। আর গাম্বিয়ার সেই যুক্তি খণ্ডন করবে মিয়ানমার। পরে মিয়ানমারের বিপক্ষে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরবে গাম্বিয়া। এভাবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলবে শুনানি।

বলা দরকার, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত জাতিসঙ্ঘের কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নয়; এটি জাতিসঙ্ঘের সদস্য দেশগুলোর একটি আলাদা চুক্তির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংস্থা। নিজের রায় কার্যকর করার জন্য তার কোনো সেনা-পুলিশ নেই। অপরাধীকে গ্রেফতার, হেগের বন্দিখানায় হস্তান্তর, দণ্ড কার্যকর করা ইত্যাদি কাজের জন্য তাকে সদস্য দেশগুলোর সহযোগিতা নিতে হয়। আবার জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদেরও অনুমোদন দরকার হয়। এই আদালত চারটি বিশেষ অপরাধের বিচার করতে পারেন। এগুলো হলো- গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো কেবল যে জনসমক্ষে প্রকাশিত ও প্রচারিত তাই নয়, খোদ জাতিসঙ্ঘের তদন্তে প্রমাণিত। এ ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুসন্ধানেও এই সত্য প্রতিষ্ঠিত যে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু মসলিম জনগোষ্ঠী রেহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে, নারীদের ধর্ষণ, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া এবং দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি এবং আগের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও সব রকম মৌলিক অধিকার হরণ করে সেনাবাহিনীকে সমর্থন জুগিয়েছে।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের অভিযোগসহ আনুষঙ্গিক যেসব বিষয় গাম্বিয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক আদালত তা আমলে নিয়ে শুনানির দিন ধার্য করে মিয়ানমারকে নোটিশ দেয়। মিয়ানমার এই আদালত গঠনের চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এ নোটিশের জবাব দিতে বাধ্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর, একাধারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির প্রধান অং সান সু চি নিজে মিয়ানমারের এবং সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইতে আইসিজেতে হাজির হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তিনি নিজ উদ্যোগে ও নিজ খরচে এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ খণ্ডন করতে সব ধরনের প্রস্তুতিও নিয়েছেন। তার জন্য এটাই স্বাভাবিক। কারণ, রোহিঙ্গা নিধনের বিরুদ্ধে আগেও তিনি টুঁ-শব্দটি করেননি। চুপ থেকেছেন অথবা সেনাবাহিনীর অপকর্মের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এ বর্বরোচিত ঘটনার দায় চাপিয়েছেন রোহিঙ্গাদের ওপরই। তার মতে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনী দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র। এর আগে জাতিগত কাচিন ও কারেনদের ওপর নিধনযজ্ঞকেও তিনি কখনো নিন্দা করেননি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও আঞ্চলিক রাজনীতির ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক এম সাখাওয়াত হোসেন এক নিবন্ধে বলেছেন, মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর সমর্থন ধরে রাখাই হলো হেগে সু চি’র মামলা লড়তে যাওয়ার কারণ। হেগে গিয়ে নিজেই মামলা মোকাবেলার ঘোষণা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মাঠে ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে। নেপিডো, ইয়াঙ্গুন, মান্দালয়সহ মধ্য মিয়ানমারের অন্যান্য শহরে অং সান সু চি’র এ উদ্যোগের সমর্থনে সামরিক বাহিনীর বড় বড় হোর্ডিং লাগানো হয়েছে। প্রতিদিন তার এই পদক্ষেপের সমর্থনে শোভাযাত্রা ও মিছিল হচ্ছে।

সু চি’র এই সেনাপ্রীতি নতুন নয়। সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন সময়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরোধিতা তিনি কখনো করেননি। এমনকি নিজে প্রায় এক যুগ অন্তরীণ থাকার সময়ও করেননি। ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। একই সাথে একজন কট্টরপন্থী জাতীয়তাবাদী বুড্ডিস্ট হিসেবে সু চি নিজের অবস্থান জোরদার করেছেন। সু চি’কে এখন মিয়ানমারের দারুণ এক জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কাজেই আগামী নির্বাচনে তার জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে মনে করা হচ্ছে।

যা হোক, সু চি এরই মধ্যে দলবল নিয়ে হেগে পৌঁছেছেন। এসেছেন গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী। বাংলাদেশ থেকে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সেখানে গেছে। এসেছে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত বব রে’র নেতৃত্বে একটি দল। আছেন ওআইসির প্রতিনিধিরাও। এ ছাড়া, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে রোহিঙ্গারা হেগ-এ এসেছেন। এরই মধ্যে তারা সেখানে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন। রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমার সরকারকে সমর্থনকারী সে দেশের বেশ কিছু গ্রুপের লোকেরাও সেই শহরে বিক্ষোভ দেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। সু চি-ও নিজের সাথে বেশ বড়সড় দল নিয়ে গেছেন। শুধু তা-ই নয়, নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে গত শনিবার সন্ধ্যায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং য়ি-য়ের সাথে বৈঠক করেছেন তিনি। বৈঠকে উভয় দেশ মৈত্রীবন্ধন জোরদারের অঙ্গীকার করেছে বলে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। সুতরাং চীনের জোরালো সমর্থন সু চি পাচ্ছেন। এর আগে চীনের ভেটোর কারণে জাতিসঙ্ঘে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস হয়নি। রাশিয়াও ছিল মিয়ানমারের পাশে। যে ভারতকে নিরাপত্তা বিনা পয়সায় ট্রানজিটসহ অনেক কিছুই তুলে দেয়া হচ্ছে, সেই বন্ধু দেশটির সমর্থনও আমরা পাইনি। ভবিষ্যতে পাওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

তবে মামলা পরিচালনায় গাম্বিয়াকে সমর্থন ও সহায়তা দেবে কানাডা, বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস। গাম্বিয়ার পক্ষে সে দেশের আইনমন্ত্রী আবুবাকর তামবাদোউ এই মামলায় লড়বেন। তিনি এ ধরনের মামলা পরিচালনায় যথেষ্ট অভিজ্ঞ। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় গণহত্যার মামলায় এক দশকের বেশি সময় ধরে লড়াই করেছেন তিনি।

অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের পাশাপাশি রাখাইনের শান্তি ও উন্নয়নের জন্য জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছিল। অং সান সু চি’র পরামর্শে আনান কমিশন গঠিত হলেও মিয়ানমার সরকার ওই কমিশনের সুপারিশ অগ্রাহ্য করেছে। কমিশন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণসহ বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিল। বিশেষ করে, আনান কমিশন মিয়ানমার সরকারকে ১৯৮২ সালের কুখ্যাত ও বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন আনার বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেছিল। ওই আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ১৯৮২ সালে কেড়ে নেয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার এসব সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন করেনি। আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার বক্তব্যে এসব বিষয় গুরুত্ব পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদনে এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হিসেবে আদালতে বিবেচিত হতে পারে।

রোহিঙ্গাদের তাদের হাজার বছরের নিবাস রাখাইন (পূর্বতন আরাকান) থেকে যে পরিকল্পিত নৃশংসতার মাধ্যমে ২০ বছর ধরে মিয়ানমার উচ্ছেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে, তা বিশ্বের অধিকাংশ দেশ, এমনকি জাতিসঙ্ঘের মতে জাতিগত নিধন এবং পরিকল্পিত গণহত্যা। সর্বশেষ নৃশংসতা ও গণহত্যার বাস্তবায়ন হয়েছে দুই বছর ধরে। শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। তবে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে তা চূড়ান্ত রূপ নেয় ভয়াবহ নৃশংসতার মধ্য দিয়ে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনে এমন কোনো বর্বরতা নেই, যা রোহিঙ্গাদের ওপর চালায়নি। কার্যত ভিটেবাড়ি মাটির সাথে মিশিয়ে তাদের দেশছাড়া করেছে। যাদের প্রায় ১১ লাখ এখন বাংলাদেশে এবং কিছু অন্যান্য দেশে পালিয়ে গেছে। বাকি রোহিঙ্গারা রাখাইন অঞ্চলেই আবদ্ধ ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে প্রায় আড়াই বছর হতে চলেছে, বাংলাদেশ এই সঙ্কটের ভার বহন করে চলেছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বিশ্ববাসী সোচ্চার হয়েছিল এবং রয়েছে। সর্বশেষ দেরিতে হলেও ওআইসি একটি দৃশ্যমান উদ্যোগ নিয়েছে হেগের আদালতে মামলা দিয়ে।

এখন আইসিজের মামলার শুনানি কোন পথে যায়, সেটা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠন ও শান্তিপ্রিয় মিয়ানমারের জনসংখ্যার একাংশ ও বিশ্ববাসী। মামলার নিষ্পত্তিতে কতটা সময় লাগবে তার ঠিক নেই। প্রাথমিক শুনানির পর সম্ভবত তদন্ত হবে। এরপর হবে বিচারের প্রস্তুতি। চূড়ান্ত পর্যায়ে বিচারকাজ শুরু হবে এবং রায় ঘোষণা করা হবে। সুতরাং খুব দ্রুতই কোনো ফলাফল আশা করার কিছু নেই। আদালত একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিতে পারেন। যাতে স্থিতাবস্থা রাখতে বলা হতে পারে। তবে এই মামলার সূত্র ধরে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোচিত হচ্ছে নিঃসন্দেহে। বিশ্বের সামনে মিয়ানমারের অপকর্মের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। সু চি’র আন্তর্জাতিক সুনাম এবং শান্তিতে নোবেল পাওয়ার পর যে মানবতার মুখোশ তিনি পরে ছিলেন, সেটি খসে পড়বে। কিন্তু এ জন্য মিয়ানমারের প্রচারণার বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে সক্রিয় থাকতে হবে। সেই সক্রিয়তা বা কূটনৈতিক উদ্যোগ বাংলাদেশ সফলভাবে চালাতে পারবে কি না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বাংলাদেশের দুর্বলতার হাজারও উদাহরণ আছে।


আরো সংবাদ



premium cement
নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর পাথরঘাটায় বদর দিবস পালনে দেড় হাজার মানুষের ইফতারি আদমদীঘিতে ৭২ হাজার টাকার জাল নোটসহ যুবক গ্রেফতার সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান মির্জা ফখরুলের জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : মন্ত্রী গাজীপুরে গাঁজার বড় চালানসহ আটক ২ দুই ঘণ্টায় বিক্রি হয়ে গেল ২৫০০ তরমুজ ড. ইউনূসের ইউনেস্কো পুরস্কার নিয়ে যা বললেন তার আইনজীবী

সকল