২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পেঁয়াজ- একটি প্রাসঙ্গিক উপাখ্যান

-

[৪]

উত্তোলনকালীন প্রতিযোগিতা
বাংলাদেশে মূলত প্রান্তিক চাষিরাই পেঁয়াজ উৎপাদন করে থাকেন। এদের অধিকাংশেরই জমি নেই। তারা অন্যের জমি বর্গা অথবা ভাড়া নিয়ে পেঁয়াজ চাষ করেন। জমির ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মেটাতে বা ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য তারা ফসল উত্তোলনের পরপরই উৎপাদনের বৃহদংশ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। একই সময়ে বাজারে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পেঁয়াজের সাথে সবজি জাতের পেঁয়াজ (যেগুলো সংরক্ষিত করা যায় না বিধায় বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়) এবং আমদানিকৃত পেঁয়াজ প্রতিযোগিতা করে। একই সময়ে এ ধরনের প্রতিযোগিতার ফলে চাষি পণ্যের মূল্য কম পান এবং তার প্রাপ্য ন্যায্য আয় থেকে বঞ্চিত হন। যথাযথ দাম না পেলে চাষি আবাদ বাড়াবেন না এবং ভালো ফলন পেতে উন্নতমানের বীজসহ অন্যান্য উপকরণে বিনিয়োগ করবেন না। যেহেতু ফসল কাটার সময় পণ্যের মূল্য কমে যায়, সেহেতু মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা তখন বেশ কম মূল্যে পেঁয়াজ কিনে গুদামজাত করে এবং সারা বছর সুযোগমতো বেশি দামে বিক্রি করে। এভাবে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা মুনাফা করে, আর কৃষকরা মুনাফা থেকে বঞ্চিত হয়। ফসল কাটার মওসুমে কৃষক যদি তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় অথবা একরপ্রতি ফলন বেশি হলে কৃষকরা যৌক্তিক মুনাফা অর্জন করতে পারবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে চাষিরা প্রতিযোগী ফসলের দিকে ঝুঁকে পড়লে পেঁয়াজের আবাদকৃত জমি কমে যেতে পারে এবং আমদানির পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে।

বিদেশনির্ভর পেঁয়াজের দাম
কৃষকরা সাধারণত উৎপাদন ব্যয় কমাতে নিম্নমানের বীজ ব্যবহার করে। নিম্নমানের বীজে কম ফলন এবং ফসল উত্তোলনের ভরা মৌসুমের প্রতিযোগিতার কারণে উৎপাদিত পেঁয়াজ কম দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় বিধায় তারা যৌক্তিক লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। নিম্নমানের বীজ কেজিপ্রতি কম মূল্যে পাওয়া গেলেও বীজের পরিমাণ বেশি প্রয়োজন হয়। সেই সাথে ফলন কম বিধায় দেশ অতিরিক্ত উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ও আমদানিনির্ভর থেকে যাচ্ছে। যত দিন দেশ আমদানিনির্ভর থাকবে, তত দিন স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম ‘বিদেশনির্ভর’ থাকবে। অতীত ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখা যাবে, দেশে সরবরাহ পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন বাংলাদেশে ‘পেঁয়াজের দাম সব সময় বিদেশনির্ভর’। পেঁয়াজ আমদানির অন্যতম সমস্যা হলো; দূর থেকে পেঁয়াজ আমদানি সম্ভব নয়, পরিবহনে সময় বেশি লাগে। বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না বিধায় পচে যায়। তাতে আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। আবার বন্দর থেকে খালাসের পর বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। অতএব, বাংলাদেশের জন্য সঠিক কৌশল হবে পেঁয়াজ আবাদ বাড়ানোর পাশাপাশি, বেশি ফলনের জন্য ভালো উপকরণ যেমন- ভালো বীজ ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করা।

এখন থেকে উন্নতমানের উচ্চফলনশীল হাইব্রিড বীজ পাওয়া যাবে এবং ভবিষ্যতে একরপ্রতি ফলন বৃদ্ধি পাবে। ফলে পেঁয়াজ চাষাবাদে একরপ্রতি মুনাফা বাড়বে। তাই আশা করা যায়, ভবিষ্যতে পেঁয়াজের আবাদও বাড়বে। কৃষকদেরকে আরো বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনে উৎসাহিত করার জন্য সরকারের উচিত হবে উত্তোলন মওসুমে (মার্চ-মে) পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রাখা অথবা আমদানিকৃত পেঁয়াজের ওপর মৌসুমভিত্তিক করারোপ করা, যাতে কৃষক তাদের উৎপাদিত পেঁয়াজ যথামূল্যে বিক্রি করে লাভবান হতে পারে।

পেঁয়াজের ভবিষ্যৎ চাহিদা- ২০২০-২০২৫ সাল
আইএফপিআরআই ও পিআরএসএসপি সমীক্ষা (২০১৩)-তে অনুমান করা হয়েছিল, ২০১৮ সালে পেঁয়াজের চাহিদা দাঁড়াবে ২১ লাখ টন, কিন্তু বিবিএস-এর উৎপাদন পরিসংখ্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে পেঁয়াজের প্রকৃত চাহিদা ছিল ২৯ লাখ টন, যা প্রায় ৮ লাখ টন বেশি। আইএফপিআরআই-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা ৫ শতাংশ বাড়বে। কিন্তু উৎপাদন ও আমদানি তথ্য থেকে বোঝা যায়, বছরে চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। আগেই বলা হয়েছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর পরিবর্তন, নদীভাঙন, শহর-গ্রামের আয়ের বৈষম্য ও পল্লী জনপদে অকৃষি কর্মসংস্থানের অভাবে দ্রুত নগরায়ন সম্প্রসারণের সাথে সাথে অদূর ভবিষ্যতে পেঁয়াজের চাহিদা বৃদ্ধির হার আরো বেশি হবে বলে ধারণা করা যায়। ধারণা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে পেঁয়াজের চাহিদা দাঁড়াবে ৪১ লাখ টন। বর্তমানে একরপ্রতি পেঁয়াজের উৎপাদন ৪ টন। সেই হিসাবে ২০২৫ সালে চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে পেঁয়াজ উৎপাদন করতে হলে ১০ লাখ একর জমিতে পেয়াজ চাষ করতে হবে, যা আদৌ সম্ভব নয়। সুতরাং একমাত্র বিকল্প হলো আবাদকৃত জমিতে পেঁয়াজের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। উচ্চফলনের মৌলিক বিষয় হচ্ছে উন্নতমানের বীজ। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে এমন জাত উন্নয়ন করতে হবে, যা কৃষক ও ভোক্তা দুই পক্ষই পছন্দ করে। উভয় পক্ষের পছন্দনীয় জাতের উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহারে চাষিদের লাভ বাড়লে আবাদের জমিও বাড়বে। ২০২৫ সাল পর্যন্ত পেঁয়াজ আবাদের জমির পরিমাণ বর্তমানের ৪.৫ লাখ একর থেকে বেড়ে ৬ লাখ একরে পৌঁছবে বলে আশা করা যায়। তবে পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য কন্দ ও বীজ মিলে উৎপাদনের জমি বাদ দিলে সম্ভবত ৫.৫০ লাখ একর জমিতে বাজারে বিক্রির জন্য পেঁয়াজ আবাদ করা হবে।

বর্তমানে একরপ্রতি ফলন ৪ টন। অতএব, ৫ লাখ একর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদন হতে পারে আনুমানিক ২০ থেকে ২২ লাখ টন। অর্থাৎ চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে ১৮ থেকে ২০ লাখ টনের ঘাটতি রয়ে যাবে। যদি একরপ্রতি ফলন ৫ টনে বাড়ানো যায়, তাহলে মোট উৎপাদন হবে ২৫ লাখ টন এবং একরপ্রতি ফলন ৬ টন হলে উৎপাদন হবে ৩০ লাখ টন। ৭ টনে উন্নীত করা গেলে মোট উৎপাদন গিয়ে পৌঁছবে ৩৯ থেকে ৪০ লাখ টনের কাছাকাছি। ২০১৯ সাল থেকে হাইব্রিড জাতের বীজ বাজারজাত হচ্ছে। এই বীজে প্রতি একরে ফলন পাওয়া যাবে একরপ্রতি ১৩ টন। ন্যূনতম গড়ে ১২ টন। অতএব, আমদানিকৃত ৫০ শতাংশ জমিতেও যদি হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজ আবাদ করা হয় তাহলে সম্ভাব্য উৎপাদন হবে ৩৮ লাখ টন। তবে হাইব্রিড বীজের চাষাবাদ যতই বাড়বে ততই পেঁয়াজ চাষের জমি বাড়বে ও মোট উৎপাদন বাড়বে। সাথে চাহিদা ও সরবরাহের ফারাক কমে আসবে।

বর্তমানে কৃষিবিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত কম সম্পদ ও কম উপকরণ ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। ইউএনসিসিডি গুরুত্ব দিয়ে বলেছে, ‘বর্তমান ও ভবিষ্যতের খাদ্য চাহিদা পূরণে জরুরি ভিত্তিতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতোমধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এর প্রভাবে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে।’ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার একের পর এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার ১০টি দেশের মধ্যে অন্যতম বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এন্টার্কটিকায় বরফ গলে যাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, আর্কিটিক ও পর্বতের ব্যস্ততন্ত্র (Ecology) এবং তুষারপাতের আদর্শ (Pattern) পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদনশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণে বেড়ে যাবে। এসব সমস্যার সমাধান করার জন্য আগাম কার্যকলাপ হাতে নেয়ার এখনই মোক্ষম সময়।

২০১৮ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল অনুমিত ১৭ কোটি। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ২৫ কোটিতে দাঁড়াতে পারে। তাই উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা বর্তমানে জাতির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এদের বেশির ভাগ মানুষ বদ্বীপীয় মালভূমির নিম্নাঞ্চলে বসবাস করে। এদের বেশির ভাগ জীবিকা নির্বাহের জন্য এখনো কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এখন জনগণকে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশে পরিবারপ্রতি গড় জমির পরিমাণ মাত্র ০.৬২ একর হওয়া সত্ত্বেও এই প্রান্তিক চাষিরাই কৃষিপণ্য উৎপাদনের মূল নিয়ামক শক্তি। কৃষিপণ্য উৎপাদনে তারা এখনো পুরনো পদ্ধতি অনুসরণ করে। কম উৎপাদনশীলতার কারণে, স্বল্প ফলন, অসময়ে অসম প্রতিযোগিতার ফলে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, সরকারের ভুলনীতি, অনুন্নত বাজার ব্যবস্থাপনা এবং পুষ্টির ঘাটতিজনিত কারণে এই প্রান্তিক কৃষকরা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকে গেছে। কৃষিতে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে প্রান্তিক চাষিদের জীবনমান উন্নয়ন করা সরকারি নীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

যেহেতু কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া ধীরগতিসম্পন্ন, জনবহুল এ দেশে দারিদ্র্য মোকাবেলার জন্য কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে এখনই নজর দেয়া দরকার। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে, গরিব কৃষক ও তাদের পরিবারের জীবনমানের উন্নয়ন হবে। কৃষিপণ্যের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বীজ হচ্ছে মৌলিক ও মুখ্য উপকরণ। উন্নতমানের বীজের সহজলভ্যতা এবং আধুনিক চাষপদ্ধতি অনুসরণে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তাতে চাষিরা লাভবান হবে ও তাঁদের জীবনমানের উন্নয়ন হবে। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতোমধ্যে প্রান্তিক চাষিদের ওপর পড়তে শুরু করেছে, ভবিষ্যতে কৃষি উৎপাদনশীলতা ও টেকসই কৃষি উৎপাদন নির্ভর করবে উন্নতমানের বীজ, মাটির বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা, পানিসম্পদের বিচক্ষণ ব্যবহার ও অন্যান্য উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে আরো প্রয়োজন হলো পরিবর্তনের ক্ষতিকারক ও নেতিবাচক প্রভাবের অভিযোজন ও নিরসন, উন্নত চাষপদ্ধতি ও সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা। উপরি উক্ত বিষয়গুলোর যথাযথ সমন্বিত ব্যবস্থাপনা কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করবে।

লাল তীর সিড লিমিটেড ১৯৯৬ সাল থেকে পেঁয়াজের জাত উন্নয়নে বাস্তবসম্মত কৌশল নিয়ে কাজ করছে। ২০০৩ সালে এলটি-২০ নামে একটি মুক্ত পরাগায়িত জাতের বীজ উদ্ভাবন করে বাজারজাত শুরু করে। এ বীজের ফলন সাধারণ জাতের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। ২০০৮ সালে এলটি-কিং নামে কিছু জাতের সংমিশ্রণে একটি উফশী জাত উদ্ভাবন করে, যার একরপ্রতি ফলন ১১ টন। নতুন জাতের এই পেঁয়াজের ফলন এলটি-২০ জাতের চেয়ে ৮০ শতাংশ বেশি। সেখানে বিজ্ঞানীরা থেমে যায়নি। দীর্ঘ ২৩ বছর বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় ২০১৭ সালে তারা প্রথমবারের মতো তাহেরপুরী জাতের হাইব্রিড উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো এই হাইব্রিড জাতের বীজ সামান্য পরিমাণে বাজারজাত করা হয়েছে এবং চাষিদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। এ জাতের ফলন একরপ্রতি ১২ টন, যার ৯৯ শতাংশ হচ্ছে একক কন্দ। অদূর ভবিষ্যতে যতই চাষিরা এই জাত চাষ করবেন, ততই পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়বে। তাতে সরবরাহ বাড়বে ও পেঁয়াজের আমদানি কমবে।

এ লক্ষ্য অর্জনে লাল তীর সিড ১৯৯৬ সাল থেকে কৃষি গবেষণা ও বীজ উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে। শাকসবজি ছাড়াও পেঁয়াজ, পেঁপে, সরিষাসহ উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ধান এবং গোশত ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবাদি পশুর উন্নয়নের জন্য লাল তীর গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি রেশম উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান। তাই আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে ধান উৎপাদনে টেকসই প্রবৃদ্ধি অতীব জরুরি বিষয়। অন্য দিকে দুধ ও গোশত উৎপাদন বাড়িয়ে জনগণের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য গবাদি পশুর উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। এসব উন্নয়নমূলক গবেষণার প্রধান লক্ষ্য হলো প্রান্তিক চাষি, তাদের পরিবার ও গ্রামীণ মহিলাদের জীবনমানের উন্নয়ন।

টেকসই উন্নয়ন ও বীজের সহজলভ্যতা
জাতিসঙ্ঘের ১৯৩টি সদস্য দেশ ২০১৫ সালে টেকসই উন্নয়নের উদ্দেশ্য পূরণে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে। ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। এসব লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে একটি হলো প্রান্তিক কৃষকগোষ্ঠীর উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। প্রান্তিক চাষিরা কেবল যে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন করতে হবে তা নয়, বরং আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে অধিকতর খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হবে উন্নতমানের বীজের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। একমাত্র বীজ কোম্পানিগুলো এ ব্যাপারে প্রান্তিক চাষিদের সহযোগিতা করে অধিকতর উৎপাদনে অনন্য অবদান রাখতে পারে।

বীজ অধিগত করার ক্ষমতার সূচক
এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রান্তিক চাষির সংখ্যা, কৃষিপণ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা ও সমস্যা এবং খাদ্য নিরাপত্তাকে ভিত্তি করে বিশ্বকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে এবং প্রতিটি অঞ্চলের বীজ কোম্পানিগুলোর ওপর একটি জরিপ চালায়। বিল ও মেলিন্দা গেইটস ফাউন্ডেশন এবং নেদারল্যান্ডস সরকারের যৌথ উদ্যোগে এই জরিপ চালানো হয়। এর উদ্দেশ্য হলো প্রান্তিক চাষিদের চাহিদা পূরণে বীজ কোম্পানিগুলোর বর্তমান অবদানের মাত্রা নির্ণয় করা। সেই সাথে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রান্তিক চাষিদের জন্য উন্নতমানের বীজ উদ্ভাবন ও সরবরাহে উৎসাহিত করা। এই জরিপের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো যেসব বীজ কোম্পানি এ ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রাখছে তাদেরকে একটি মাপকাঠির আওতায় নিয়ে তাদের অবস্থান নির্ণয় করা। ফলে সরকার, গবেষণা ও দাতাপ্রতিষ্ঠান; যারা বীজ কোম্পানির সাথে সহযোগী ভূমিকা রাখতে চায় তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করা। এই জরিপের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর অবদানকে ছয় আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করে। সেগুলো হলো- চাষিদের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী বীজের সরবরাহ, বীজের সহজপ্রাপ্যতা, টেকসই উৎপাদনে কৃষকের সহযোগিতা, কোম্পানির সামর্থ্য, লাভজনকতা ও স্বায়ত্তশাসন। এ ছাড়াও কোম্পানিগুলোর উদ্ভিদ প্রজননে সক্রিয় ভূমিকা, নতুন জাতের উদ্ভাবন, বীজ উৎপাদন, বিপণন ও কৃষকের নিকট গ্রহণযোগ্যতার মতো বিষয়গুলো একত্রে বিচার, বিবেচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে। একই সাথে প্রান্তিক কৃষকদের পছন্দকে কো¤পানিগুলো কতটুকু ও কিভাবে অগ্রাধিকার দেয়, সেটিও তুলে ধরে। এই চার অঞ্চলের একটি হলো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় লাল তীরের অবস্থান- পদমর্যাদা
২০১৯ সালে ১৭টি দেশে স্থাপিত ও অবস্থিত সব বীজ কোম্পানির কার্যক্রম পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে পদমর্যাদার যে সূচক প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে লাল তীর সিড লিমিটেডের পদমর্যাদা ১৩তম। প্রান্তিক কৃষকদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে অধিকতর উৎপাদনের ক্ষেত্রে নেতৃত্বমূলক ভূমিকা রাখার জন্য লাল তীর এই অগ্রবর্তী অবস্থান অর্জন করতে পেরেছে। এর ফলে আমাদের বিজ্ঞানীরা আরো বেশি উদ্যম ও আগ্রহ নিয়ে তাদের গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। [সমাপ্ত]

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই


আরো সংবাদ



premium cement