১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পাথরচাপা জীবনের শোকগাথা

-

মানবসভ্যতা মূলত শ্রমিকের কায়িক পরিশ্রম, অর্থাৎ শ্রম-ঘামের ইতিহাস। তারাই গড়ে তুলেছেন সব সভ্যতা। এখানে অভিজাতদের কোনো স্থান নেই। তারা শুধু সুবিধাভোগী শ্রেণী। আর সভ্যতা মানেই শ্রমিকের পাথরচাপা জীবনের শোকগাথা। সুদূর অতীত থেকে বর্তমান সময়েও একই চিত্র বিদ্যমান। সভ্যতা বিনির্মাণে সেকালে ‘দাস’ আর একালে ‘শ্রমিক’ সমার্থক। পরিণতিও একই।

আমাদের রাজনীতিকরা দেশে গণতন্ত্র রইল কি রইল না, ক্ষমতায় কে থাকল, কে ছিটকে পড়ল- সেসব নিয়ে লাখো শব্দবাণ ছুড়তে থাকেন প্রতিদিন। ক্রমাগত নানা দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর মিছিল নিয়ে সামান্য কিছু কথাও অবশিষ্ট রাখেন না। নানা অঘটনে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। দায়িত্বশীল সবার ভাবখানা এমন, চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া যেন কারো কিছু করার নেই। যেমন চলছে, তেমনি চলবে। এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, এ দেশে মানুষের জীবন সত্যিই মূল্যহীন। কঠিন অভিজ্ঞতায় সাধারণের মনে হতাশার সাথে এ বিশ্বাসও জন্মেছে, কোনো ধরনের দুর্ঘটনার কারণ শনাক্ত করে তা দূর করার পদক্ষেপ নেয়া এ দেশে কখনই হয়তো সম্ভব হবে না। দুর্ঘটনা ঘটলে প্রথামাফিক সংবাদপত্রে নতুন উদ্দীপনায় প্রতিবেদন আর কলাম ছাপা হবে। টিভি চ্যানেলগুলো এ বিষয়ে টকশো প্রচার করবে। বিশেষজ্ঞরা মতামত দিতে থাকবেন। তবে তা আমলে নেয়ার কোনো কর্তৃপক্ষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটিই এখন দেশের স্বাভাবিক চালচিত্র।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের মতো নির্মাণশ্রমিক যারা, তাদের জীবন অতি তুচ্ছ। মূল্যহীন। তাদের ‘চারআনাও দাম নেই’। খেটেখাওয়া মানুষরা কে কিভাবে মারা গেলেন তাতে কারো কিছু যেন আসে যায় না। সবাই যেন দায়মুক্ত। স্থাপত্য শিল্পে শ্রমজীবীদের জীবন এতই মূল্যহীন যে, উন্নয়নের বিচিত্র সাফল্যগাথার কথা শুনে মনে যে পুলক জাগে তা সবই ফিকে হয়ে আসে। হতাশার খণ্ডচিত্রের অভাব নেই। মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে শ্রমিকের যতই অবদান থাকুক না কেন, জীবন বর্ণহীন। তাদের কান্না পাথরচাপা পড়াই যেন অমোঘ নিয়তি। অথচ পৃথিবীর তাবৎ স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম ‘কাঁচামাল’ শ্রমিকের শ্রম-ঘাম। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়।

অতি বিস্ময়কর পিরামিডের কথাই ধরা যাক। পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যের একটি, মিসরের পিরামিড। ফেরাউন বংশের শাসনামলে এসব পিরামিড নির্মিত হয়েছিল। আধুনিক স্থাপত্যকলার স্থপতিদের কাছে পিরামিডের নির্মাণশৈলী আজো রহস্যাবৃত এক দুর্ভেদ্য জগৎ। পিরামিড প্রযুক্তি এখনো অপার এক রহস্য। কিভাবে, কোন কৌশলে এত উঁচুতে দানবাকৃতির এক একটি পাথর তোলা হতো, তা বড় জিজ্ঞাসা। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, পিরামিড নির্মাণে নির্মাণশ্রমিক ছিল বনি ইসরাইল। তারা ছিল দাস। পিরামিড নির্মাণকালে বিরাট বিরাট পাথর উত্তোলনের সময় চাপা পড়ে জীবন গেছে হাজার হাজার অসহায় বনি ইসরাইলের। তাদের সেই করুণ ইতিহাস অনেকের অজানা। পিরামিডের সৌন্দর্য দেখে পর্যটক মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে দেখে অপলক নয়নে। সুদূর অতীতের দাস থেকে সমকালীন নির্মাণশ্রমিকের জীবনের ভেদরেখা টানা সত্যিই কষ্টসাধ্য। তখনো তাদের জীবনে ছিল না কোনো বাঁকবদল। এখনো একই রকম। কোনো হেরফের নেই। তখনো তাদের জীবনের কোনো মূল্য ছিল না। একালেও নেই। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা বড়ই করুণ আর ধূসর। এ দেশেও নির্মাণশ্রমিকের প্রাণের কোনো মূল্য আছে বলে মনে হয় না।

রাজধানীজুড়ে অট্টালিকার পর অট্টালিকা। এসব সুরম্য অট্টালিকায় নিরাপদে বসবাস করছেন লাখ লাখ মানুষ। যারা এই ইমারত গড়ে তুলছেন, সেই নির্মাণশ্রমিকদের জীবন কতটুকু নিরাপদ? পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার পর সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছেন নির্মাণশ্রমিক। ভবন থেকে পড়ে বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এ বছর ১৪৮ জন নির্মাণশ্রমিক মারা গেছেন। নিহত শ্রমিকদের কতজনের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে; সে সংখ্যাও একেবারে নগণ্য। আইনের প্রয়োগ না থাকায় মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) নির্বাহী পরিচালক জাফরুল হাসানের ভাষায়, ‘আমরা শুধু পত্রিকার কাটিং থেকে তথ্য সংগ্রহ করি। সেখানে এ বছর মৃত্যুর সংখ্যা পেয়েছি ১৪৮ জন। কিন্তু বাস্তব চিত্র আরো বেশি। ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে নিহত হয়েছেন এক হাজার ৬৭৭ জন নির্মাণশ্রমিক। আমরা এ তালিকা তৈরির পর শ্রমিক নেতা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেই; যাতে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক তার ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পান’ (ইত্তেফাক, ২৫ নভেম্বর ২০১৯)। দুর্ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধানে কয়েকটি বিষয় জানা যায়। তবে এসব মৃত্যুর পেছনে শ্রমিকদেরও দায় আছে। তারা অনেক সময় নিরাপত্তাব্যবস্থা না নিয়েও বহুতল ভবনের ওপরে কাজ করছেন। আর তদারকির কাজে যারা নিয়োজিত, তারা এগুলো দেখেও না দেখার ভান করেন। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হলো, আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নির্মাণাধীন বেশির ভাগ ভবনে যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয় না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের তথ্য মতে, বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ এ পেশায় বাংলাদেশে কাজ করছেন প্রায় ৩৭ লাখ শ্রমিক। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হওয়া বেশির ভাগ নির্মাণশ্রমিকের কাজের সময়ে থাকে না হেলমেট, গামবুট, বেল্টসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। সড়কের পাশে নির্মাণাধীন ভবনেও নেয়া হয় না পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা। ফলে সেখান থেকে নির্মাণসামগ্রী পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পথচারীরাও। কিন্তু কেউই পাচ্ছেন না পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ।

রিয়েল এস্টেট হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) গত তিন বছরে সাত হাজার শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। প্রশিক্ষণের সময় তাদের ভাতা দেয়া হয়েছে চার হাজার টাকা করে। ৩৭ লাখ শ্রমিকের মধ্যে তিন বছরে মাত্র সাত হাজার শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেয়া একেবারেই নগণ্য। বহু ডেভেলপার কোম্পানির সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যাতে তারা নির্মাণাধীন ভবনে সঠিক আইনকানুন মেনে শ্রমিকদের কাজ করাতে পারেন। রিহ্যাবের বাইরেও বহু নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের প্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকরা ঠিকমতো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। রিহ্যাবের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রত্যেক শ্রমিককে দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকেও কিছু টাকা নিয়ে দেয়া হয়।

ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ সূত্রে জানা যায়, ‘ক্ষতিপূরণ খুব বেশি মানুষ পাচ্ছেন না। যারাও বা পাচ্ছেন, অর্থের পরিমাণ খুবই কম। বহু শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ থাকে অজানা।’ তাহলে তারা কিভাবে ক্ষতিপূরণ পাবেন? আসলে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত না করে ভবন নির্মাণের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। শ্রমিকদের সচেতন করার কাজও চালিয়ে যেতে হবে।

বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণশ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের বক্তব্য- ‘যেসব শ্রমিকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করা হয়। শ্রম মন্ত্রণালয় থেকেও ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেয়ার চেষ্টা চালানো হয়। তবে সেটি পর্যাপ্ত নয়। আর বেশির ভাগ শ্রমিকের মৃত্যুর খবর জানাই যায় না। সরকার আইনে কড়াকড়ি করলে মালিকরা সচেতন হতেন। তখন দুর্ঘটনা কমে যেতে পারে। মালিকরা যদি সচেতন না হন, তাহলে কাজ হবে না।’

স্থাপত্য শিল্পের সাথে জড়িত বেশির ভাগেরই অভিমত, আইন মেনে না চলায় ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে প্রথমে দরকার সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার পথ কী, তা শনাক্ত করা। শুধু সচেতনতার দোহাই দেয়া নিরর্থক। কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ না করা হলে এসব দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। দেশের সার্বিক উন্নয়ন সবার প্রত্যাশা। তবে নির্মাণশ্রমিকদের সাথে সভ্য আচরণ করতে হবে। তাদের মানবাধিকার সংরক্ষণে উদ্যোগ নিতে হবে। রাষ্ট্রকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে এ ব্যাপারে। কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে আইন। তখনই সম্ভব নির্মাণশ্রমিকদের জীবনের উপযুক্ত মূল্যায়ন। এতে আমাদের সবার দায়মুক্তির পথ প্রশস্ত হতে পারে।

camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement