২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল

-

ইসলাম দারিদ্র্য বিমোচনে সক্ষম কি না, এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবতে গেলে এক দিকে মনে হয়-প্রশ্নটি সঠিক নয়। কেননা, ঐতিহাসিক বিচারে যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখব, ইসলাম যখন বিস্তার লাভ করেছিল, তার খিলাফতের যখন প্রসার ঘটে, তার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্য উৎখাত হয়ে গিয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, এমন সময় পার হয়েছে যখন জাকাত নেয়ার মতো কোনো লোক ছিল না। জাকাত নেয়ার লোক থাকে না কখন? যখন কোনো সমাজে দারিদ্র্য থাকে না। কিন্তু আজকের আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজ কি এই দাবি করতে পারবে যে, এ সমাজে সাহায্য নেয়ার কেউ নেই? এর থেকে বুঝা যায়, ইসলামের ইতিহাস অনেক বেশি গৌরবোজ্জ্বল আর এই অর্থে শ্রেষ্ঠ যে, ইসলাম দারিদ্র্য দূর করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এই দাবি পশ্চিমা বিশ্ব এখনো পুরোপুরিভাবে করতে পারবে না।

এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ইসলামের লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণ। ইসলামের শ্রেষ্ঠ আলেমরাও তাদের বইপুস্তকে এই কল্যাণের কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে ইমাম গাজ্জালি, ইমাম শাতিবি, ইবনুল কাইয়ুমের কথা উল্লেখ করা যায়। মাকাসিদ আল-শরিয়াহ অর্থাৎ শরিয়াহর লক্ষ্য হচ্ছে জনকল্যাণ। আর জনকল্যাণ হচ্ছে যা কিছু ঈমান বা বিশ্বাস, বুদ্ধিবৃত্তি, প্রাণ বা জীবন, মাল বা অর্থনীতি, ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য কল্যাণকর। সেগুলোকে তারা বলেছেন প্রকৃত জনকল্যাণ। আর যা কিছু এসবকে নষ্ট করে দেয় অর্থাৎ জীবনের কল্যাণ, অর্থ বা অর্থনীতি কিংবা মালের কল্যাণের বিরোধী হবে, যা কিছু ঈমানের পরিপন্থী, যা কিছু মানুষের বুদ্ধি-বিবেক নষ্ট করে দেয় সেগুলোকে ‘মাফাসিদ’ বা অকল্যাণ বলেই গণ্য করা হবে (দ্রষ্টব্য : ইমাম গাজ্জালি, আল-মুসতাসফা, প্রথম খণ্ড; ইবনুল কাইয়ুম, ইলাম আল-মুয়াক্কিয়িন-তৃতীয় খণ্ড)।

আমরা লক্ষ করেছি, আধুনিক যুগে যারা ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে লিখেছেন, যেমন- ড. এম উমর চাপড়া, ড. ফাহিম খান, ড. মনওয়ার ইকবাল, প্রফসর খুরশীদ আহমদ, ড. তরিকুল্লাহ খান, ড. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, ড. মনজের কাহাফ এবং বড় বড় ইসলামী অর্থনীতিবিদের কথা যদি বলি, তাহলে দেখা যায়, তারা যে ইসলামী অর্থনীতির দার্শনিক ভিত্তি খাড়া করেছেন, তার মধ্যে একটি হচ্ছে আদল বা ন্যায়বিচার। তারা কুরআন শরিফ বিশ্লেষণ করে বলেছেন, কুরআনের প্রায় এক শ’ আয়াত আছে যেখানে আদল, জাস্টিস, ইনসাফ বা ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে। আবার এক শ’টা আয়াত আছে, যেখানে জুলুমের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, তারা বুঝাতে চাচ্ছেন, প্রায় দুই শ’ আয়াতে ইনসাফ করার কথা বলা হয়েছে। তারা বলেছেন, ইনসাফ করার মূল তাৎপর্য হচ্ছে, মানুষের প্রয়োজন মেটাতে হবে।

প্রশ্ন হলো- ইসলামী অর্থনীতি দারিদ্র্য দূর করার জন্য কী পদ্ধতি গ্রহণ করেছে? কী কৌশল গ্রহণ করেছে? অর্থনীতিতে ইসলাম তার কৌশল ও কর্মপদ্ধতিকে এমনভাবে সাজিয়েছে যে, মানুষ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করবে, রোজগার করবে, নিজের সম্পত্তির ওপর তার মালিকানা রয়েছে এবং থাকবে, ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক যে মালিকানা হয়, তা তার থাকবে। সে স্বাধীনভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়তে পারবে। তবে সব কিছুই শরিয়াহ’র সীমার মধ্যে হতে হবে। ইসলামী অর্থনীতিতে এমনভাবে স্ট্রাকচার করা হয়, যাতে মানুষ নিজেরাই নিজেদের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করতে পারে। এর পরও যারা কোনো কারণে রোজগার কিংবা প্রয়োজনীয় আয় করতে পারবে না, তাদের দায়িত্ব ইসলামী ব্যবস্থায় পরিবার বা আত্মীয়স্বজনদের ওপর বর্তায়। আবার তারাও যদি সে দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, তাহলে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির দায়িত্ব পড়বে রাষ্ট্রের ওপর।

এই যে ওয়েলফেয়ার সিস্টেম বা কল্যাণমূলক ব্যবস্থা- যেটার কথা ইসলাম বলছে, তার মধ্যে জাকাত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের যে কর্মসূচি, তার মধ্যে জাকাত একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

জাকাতব্যবস্থার সাথে সাথে ওয়াক্ফ বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। আমাদের ওয়াক্ফ সিস্টেম ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা এটাকে নষ্ট করে ফেলেছি। কিন্তু আমরা জানি, ইসলামের ইতিহাসে ওয়াক্ফর বিরাট ভূমিকা ছিল। আমরা তা অস্বীকার করতে পারি না। এ ব্যবস্থাটাকে আমাদের পুনরুদ্ধার করতে হবে। একসময় ইসলামে যে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে, তা মূলত এক দিকে জাকাত, আরেক দিকে ওয়াকফর কারণে। এমন সময় ছিল যখন সবাই, কিছু না কিছু সম্পত্তি আল্লাহর পথে দান করে দিতেন, আর সেটি দিতেন বলেই সেই সময় সব স্কুল ফ্রি চালানো সম্ভব হতো। ওয়াক্ফর কারণে সব ইউনিভার্সিটি ফ্রি চালানো হতো। অর্থাৎ গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই ফ্রি ছিল। ওয়াক্ফর কারণেই সব চিকিৎসাসেবা ফ্রি দেয়া হতো। পথিক কিংবা আগন্তুকদের জন্য যে সরাইখানার ব্যবস্থা ছিল, তা-ও ওয়াক্ফ সম্পত্তির মাধ্যমেই ফ্রি চালানো সম্ভব হয়েছে।

তেমনিভাবে, ইসলাম তার রাজস্বনীতিকে কাজে লাগাবে। রাজস্বনীতিতে আয় ও ব্যয়ের নীতিগুলোকে পুরোপুরি কাজে লাগাবে। ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যয়ের নীতির ব্যাপক পরিবর্তন হবে। যেমন-ঢাকা শহরে যারা রাস্তাঘাটে থাকে (এর মধ্যে নারীই অর্ধেক) তাদের জন্য কি আমাদের বাজেট থেকে এক দুই বছর ৫০০ কোটি টাকা করে বের করতে পারি না? আমরা কি বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের শহর থেকে যার যার গ্রামে নিয়ে পুনর্বাসন করে দিতে পারি না? তেমনিভাবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে মনিটরি পলিসি বা মুদ্রানীতি, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ইসলামের আলোকে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে এটাতে। কারণ সেন্ট্রাল ব্যাংক প্রতি বছরই নতুন অর্থ বাজারে ছাড়ে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ। এটা একটা ক্রিয়েটেড মানি। এতে নতুন অর্থের সৃষ্টি হয়। এই অর্থ ব্যবহার করা যায় জনকল্যাণমূলক কাজে। সেন্ট্রাল ব্যাংকের এই নতুন অর্থের জন্য কোনো খরচ করতে হচ্ছে না; এর জন্য তাকে কোনো জিনিস বেচতে হচ্ছে না। এটা একদমই ‘আকাশ থেকে পাওয়া’ অর্থই বলা যায়। এটা নোট প্রিন্টের মাধ্যমে সেন্ট্রাল ব্যাংক প্রতি বছর বাজারে ছাড়ে। সে টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সরকারকে দেয়ার সময় বলে, এটা শুধু জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতে হবে, দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয় করতে হবে, তাহলে এর মাধ্যমে সামগ্রিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে কর্জ বা বিনা সুদে দিতে পারে। অতএব, যে সরকারই থাকুক সে সরকার যদি ইসলামকে অগ্রাধিকার দেয় এবং কমিটেড বা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, আর সেই সাথে জনগণ যদি তা গ্রহণ করতে রাজি হয়, তাহলে ইসলামের চেয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের আর কোনো ভালো আদর্শ হতে পারে না।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement