২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সংবিধান কতটুকু কার্যকর

-

পাকিস্তানে সামরিক শাসন বহাল থাকাকালে লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডারের অধীনে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত, তদানীন্তন জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা ১৬৭টি আসনে জয় লাভ করেছিলেন। নির্বাচনটিতে জাতীয় পরিষদের মোট ৩০০টি আসনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৬৭টি আসনে দলটির সমর্থিত প্রার্থীরা জয় লাভ করায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা পরিচালনার অধিকার অর্জন করে। ১৯৬৯ সালে সমগ্র পাকিস্তানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিলে তৎকালীন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন। তিনি ক্ষমতা দখলের পর আইয়ুব খানের শাসনামলে প্রণীত ১৯৬২ সালের সংবিধান বাতিল করে ঘোষণা দেন যে, লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডারের অধীনে পাকিস্তানে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের কাজ হবে দেশের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা। ১৯৭০ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি তৎকালীন পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে বিজয়ী হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।

পাকিস্তানের সামরিক শাসক, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বিজয়ীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ও সংসদের বৈঠক আহ্বান নিয়ে কালক্ষেপণকরত সামরিক বাহিনী দিয়ে, নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং জনমানুষকে অবদমিত করতে চাইলে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে পরিচালিত হয়েছিল এবং স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালে তিনি পাকিস্তানে কারান্তরীণ ছিলেন।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রবাসে মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে, ওই ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে, তাকে বাংলাদেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং আরো উল্লেখ করা হয় যে, তার অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয়, এটি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার ধারণা ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের অপরাহ্ণে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। ১১ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর শপথ গ্রহণের সাথে মন্ত্রিসভার অপরাপর সদস্যদেরও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে ‘গণপরিষদ’ গঠনপূর্বক ওই গণপরিষদকে বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ বিষয়ে অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ অভিমত ব্যক্ত করেন, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ’৭০ সালে আর পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের কেন্দ্রীয় সরকারের সংবিধান প্রণয়নে কোনো ভূমিকা না থাকারই কথা। সুতরাং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে যে গণপরিষদ গঠন করা হয়েছিল তা একটি স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য জনগণ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিল কি না, এ প্রশ্নটিকে অনিষ্পন্ন রেখে এতদসংক্রান্ত কাজটি সমাধা করা হয়। এতে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে বিতর্কের দ্বারটি রুদ্ধ হবে না- এমনটিই প্রতীয়মান হয়েছিল।

গণপরিষদের সদস্যরা বাংলাদেশের জন্য যে সংবিধান রচনা ও লিপিবদ্ধ করেন, তা গণপরিষদ কর্তৃক ৪ নভেম্বর ১৯৭২ গৃহীত হয়। অতঃপর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে সংবিধানটি কার্যকর করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধান থেকে প্রতীয়মান হয়, এটিতে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার উল্লেখ ছিল। সংবিধান কার্যকর করার পর গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের যে প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ওই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মতো ‘ভূমিধস বিজয়’ লাভ করে। দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী যে সরকার গঠিত হলো, সেটি সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ছিল।

যেকোনো দেশের সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গণতান্ত্রিক শাসনের ধারণাই ব্যক্ত করে থাকে। গণতান্ত্রিক শাসন যে মৌল নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত তা হলো, জনমতের প্রতিফলনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্জনকারী দলের মাধ্যমে সরকার পরিচালনা। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কখনো মাত্র একজন ব্যক্তির হাতে সরকারের সর্বময় ক্ষমতা থাকে না। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি আলোকপাত করলে দেখা যায়, সরকারের নির্বাহী ক্ষমতার সম্পূর্ণটাই প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত। আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধানরূপে অপর সব পদধারীর ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করেছেন। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি একজন সাংবিধানিক পদধারী হিসেবে শপথের অধীনস্থ। রাষ্ট্রপতিকে শপথ গ্রহণ করাকালে অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি বলতে হয়, তিনি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন এবং নিরাপত্তা বিধান করবেন। রাষ্ট্রপতির পঠিত শপথবাক্যটির অর্থ হলো, সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতিকে যতটুকু ক্ষমতা দেয়া আছে, এর বাইরে রাষ্ট্রপতির কোনো ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ নেই।

প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি উভয়ই সাংবিধানিক পদধারী। সংবিধান অবলোকন করলে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ছাড়া রাষ্ট্রপতি তার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করবেন- এ বিষয়টি তথায় স্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে। এ বিষয়ে উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে একক ক্ষমতা দেয়া হলেও সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী বা অন্য কোনো সময়ে যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের আস্থাভাজন, তাকে ব্যতীত অপর কাউকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ রাষ্ট্রপতির পক্ষে অনুপস্থিত। একইভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে যদিও সংবিধানে আলাদাভাবে কোনো যোগ্যতার বিষয় উল্লিখিত হয়নি, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে অনুসৃত প্রথা অনুযায়ী দেখা গেছে, সচরাচর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। সুতরাং প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতি যদি তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যথা করতে চান, সে ক্ষেত্রে জনমনে তার গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। এর আগে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে যতবারই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের মাধ্যমে অতিক্রান্তের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে, প্রতিবারই যে তা প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষাই কার্যকর হয়েছে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই সম্যক অবহিত।

সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে বলা হয় ‘রাষ্ট্রের অভিভাবক’। তিনি জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। রাষ্ট্রপতি সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে নির্বাচিত হন বিধায় সরকারপ্রধানের মনোনীত ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে থাকেন। একজন সংসদ সদস্যকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দেয়া হলে এবং নিয়োগ-পরবর্তী পর্যায়ে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে রাষ্ট্রপতিরূপে কার্যভার গ্রহণের দিন সংসদে তার আসন শূন্য হয়ে যায়। তা ছাড়া, রাষ্ট্রপতি তার কার্যভার বহনকালে সংসদ সদস্যরূপে নির্বাচিত হওয়ার জন্য যোগ্য নন। একজন দলীয় ব্যক্তি বা সমর্থক রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার পর জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী তার দলীয় পরিচয় না থাকলেও ’৯১-পরবর্তী আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি- উভয় সরকারের আমলে দেখা গেছে, দলীয় প্রধানের আনুকূল্যে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত ব্যক্তি জনপ্রত্যাশার প্রতিফলনে যখনই নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছেন তখনই দলীয় প্রধানের বিরাগভাজন হওয়ার কারণে তার পদ হারানোর উপক্রম ঘটেছে অথবা দল কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে অবমাননাকরভাবে জীবযাপনের উপক্রম ঘটেছে।

আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত এবং তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ লাভ করলেও তাদের নিয়োগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। একজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সন্তুষ্টিসাপেক্ষে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত থাকেন এবং প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সময় যেকোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করতে পারেন। কোনো মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ রক্ষায় অপারগ হলে সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে তার নিয়োগের অবসান ঘটানোর পরামর্শ দিতে পারেন।

সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিলে অথবা তিনি সংসদ সদস্য না থাকলে অথবা সংসদে তার প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন না থাকলে, তার পদ শূন্য হয়ে যাবে। কিন্তু তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বীয় পদে বহাল থাকেন। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকলে তার মন্ত্রিসভার প্রত্যেক সদস্য পদত্যাগ করেছেন মর্মে গণ্য হয়, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মতোই তাদের নিজ নিজ উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা নিজ নিজ পদে বহাল থাকেন।

সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকার বিষয়ে আমাদের সংবিধানে অভিনব একটি বিধান রয়েছে। বিধানটিতে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি দল থেকে পদত্যাগ করলে অথবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোটদান করলে, সংসদে তার আসন শূন্য হবে। উল্লেখ্য, একজন সংসদ সদস্য সাধারণ জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হন। জনগণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। একজন নাগরিক কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন, এটি একান্তই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তাই দেখা যায়, জনগণের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগের ভিত্তিতে আমাদের সংসদে যে ব্যক্তি দলীয় প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত, তিনি দল থেকে পদত্যাগ করা এবং সংসদে দলের বিপক্ষে ভোটদানের ব্যাপারে স্বাধীন নন। এরূপ বিধান গণতন্ত্রের চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত অপর কোনো দেশের সংবিধানে এরূপ অগণতান্ত্রিক বিধানের অস্তিত্ব নেই।

আমাদের দেশ সংবিধান প্রণয়ন-পরবর্তী সময়ে সংসদীয় পদ্ধতি ও রাষ্ট্রপতি শাসিত উভয় সরকারব্যবস্থা দিয়ে শাসিত হয়েছে। দেশ যখন রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থার অধীনে ছিল তখন দেখা গেছে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর অনুরূপ ছিল। বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী উভয় ধরনের সরকারব্যবস্থা বহাল থাকাকালে বর্তমানের মতো সরকার ও দলীয়প্রধান একই ব্যক্তি ছিলেন। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, সরকার ও দলীয়প্রধান একই ব্যক্তি হলে দলের সব সিদ্ধান্ত যেমন একই ব্যক্তির ইচ্ছায় বাস্তবায়ন হয়, আবার সরকারের সব সিদ্ধান্তও একই ব্যক্তির ইচ্ছায় বাস্তবায়ন হয়ে থাকে।

আমরা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে থাকি। কিন্তু সরকার ও দলীয় প্রধান হিসেবে এক ব্যক্তির কাছে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে গেল গণতন্ত্র বিকাশের সব পথ যে রুদ্ধ হয়, সে প্রশ্নে কারো মধ্যে কোনো ধরনের সংশয় থাকার কথা নয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৯০ অবধি, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও বিচারপতি আবদুস সাত্তারের স্বল্পকালীন সময় ছাড়া বেশির ভাগ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। তারা তিনজনই একাধারে সরকার ও দলীয় প্রধান ছিলেন। এ তিনজনের শাসনামলে তাদের অনুপস্থিতিতে কী দলের নেতৃত্বে কে আসবেন বা রাষ্ট্রক্ষমতায় কে তাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন, এ প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়নি। ১৯৯০-পরবর্তী বেশির ভাগ সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এ দু’টি দলই সরকার পরিচালনা করে আসছে। এ দু’টি দলের দলীয় ও সরকারপ্রধান দীর্ঘ দিন ধরে একই ব্যক্তি। এ দু’টি দলের বর্তমান যারা দলীয় প্রধান, তাদের অনুপস্থিতিতে দলীয় নেতৃত্ব যে স্বীয় পরিবারের বাইরে অন্য কারো কাছে যাবে না; এ বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত। পৃথিবীর অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে, একই ব্যক্তিকে সরকার ও দলীয় প্রধান হিসেবে দেখা যায় না। অতীতে দু-একটি গণতান্ত্রিক দেশে পরিবারতন্ত্র দেখা গেলেও এ গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় বিধায় এখন খুব কমই অনুসৃত হয়। পরিবারতন্ত্রকে উৎসাহিত করা হলে একটি দলে কখনো বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে ওঠে না, যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুমোদন করে না।

যেকোনো সরকার ও দলীয় প্রধানের উচিত তার অনুপস্থিতিতে যোগ্যতম ব্যক্তি যেন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনে দল অথবা সরকারের নেতৃত্ব লাভ করতে পারেন- এটা নিশ্চিত করা। দলের মধ্যে এ ধরনের চর্চা বহাল রাখা হলে দলে ত্যাগী লোকের আবির্ভাব ঘটে, যারা সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে দল অথবা সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে পারেন।

বাংলাদেশের সংবিধানে এযাবৎ ১৬টি সংশোধনী আনা হয়েছে। এসব সংশোধনীর মধ্যে দু-একটি ছাড়া অপর সব সংশোধনীর ক্ষেত্রে দেশের ও জনগণের স্বার্থের চেয়ে দলীয় সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তিই অধিক ঠাঁই পেয়েছে। আমাদের সংবিধানে এক ব্যক্তির হাতে সরকারের সব ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়ায় এটি কোনোভাবেই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাই সংবিধানকে গণতন্ত্রমুখী করতে হলে অবশ্যই এর আমূল সংস্কার প্রয়োজন, যা শুধু দেশের গণতন্ত্রের ভিতকেই সুদৃঢ় করবে না, দেশকে দ্রুত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথেও এগিয়ে নিয়ে যাবে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement