২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে’

-

সম্প্রতি কোনো কোনো পত্রিকায় একটি অদ্ভুত খবর ছবিসহ বেরিয়েছে। এটা আকারে ছোট হলেও তাৎপর্যে বড়। ঘটনাটা হলো, আমাদের এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে একটি বটগাছ দীর্ঘ সোয়া শ’ বছর ধরে ‘জেল খাটছে’। ১২১ বছরেও বুড়ো বটের মুক্তি মেলেনি। পেশোয়ার এলাকার এই অটবিটা হওয়ার কথা মহীরুহ; অথচ হয়ে আছে এক মাতালের ক্রোধের শিকার। এ জন্য গাছটার গা ভর্তি শেকল, যা বন্ধন ও দাসত্বের প্রতীক। জানা গেছে, ১৮৯৮ সালে স্থানীয় লান্ডিকোটাল ক্যান্টনমেন্টের এক ইংরেজ অফিসার মদে চুর হয়ে সে পথে যাচ্ছিল। তখন নেশার ঘোরে তার কাছে মনে হয়েছিল, বটবৃক্ষটি তার দিকে তেড়ে আসছে (সম্ভবত এই কর্মকর্তাকে মদপানের শাস্তি দেয়ার জন্য)। সাথে সাথে সিপাইদের প্রতি জেমস স্কোয়াইড নামের সাদা চামড়ার লোকটির অর্ডার, ‘বেআদব গাছটাকে গ্রেফতার করো’। আদেশ তৎক্ষণাৎ প্রতিপালিত হলো।

নির্দোষ উদ্ভিদ কঠোর সাজা পেলেও দোষী মিলিটারি অফিসারের প্রাপ্য শাস্তি সে ভোগ করেছে বলে জানা যায় না। স্মর্তব্য, তখন আমাদের এই উপমহাদেশজুড়ে ছিল শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসন। তাদের মুখের কথাই অনেক ক্ষেত্রে ছিল ‘আইন’।

নয়া দিগন্ত ছাড়া, জাতীয় পর্যায়ের আর কোনো দৈনিক এ নিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছে বলে দেখা যায়নি। কিন্তু একমাত্র ঢাকা শহরেই প্রতিদিন অন্তত অর্ধশত পত্রিকা বের হচ্ছে নটনটী, নায়িকা-গায়িকা, নেতা, নর্তকী প্রমুখের সত্যমিথ্যা বেদরকারি সংবাদ আর ঢাউস ছবি নিয়ে। ৬ নভেম্বর নয়া দিগন্তের সম্পাদকীয়তে আলোচিত ঘটনাটি তুলে ধরে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এই ঘটনা কেবল একটি দেশের সরকারের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা এবং অমানবিক শাসনব্যবস্থাই তুলে ধরে না, মাদক সেবনের পরিণতি যে কত ব্যাপক ও ভয়াবহ, সে বিষয়ও প্রমাণ করছে সবার সামনে। মদসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকের প্রতি আসক্তি মানুষকে অমানুষ করে তোলে। সে তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ইসলামে মাদকাসক্তিকে নিষিদ্ধ করার প্রধান কারণ এটি। আমাদের দেশে অতীত থেকে বহুবার অভিযান চালানো হয়েছে ও হচ্ছে মাদকের বিরুদ্ধে। কিন্তু দেশী-বিদেশী মদসহ নানা প্রকার মাদক দ্রব্যের ব্যবহার এবং এর আমদানি, পরিবহন, সরবরাহ, মজুদ, তথা কারবার মোটেও কমেনি। এদিকে কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি মোকাবেলায় হিমশিম খাওয়ার পাশাপাশি, বিশেষত কিশোর তরুণ যুবকরা ক্রমবর্ধমান হারে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।’

ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, বস্তির মেথর বা ধাঙ্গর থেকে শুরু করে অট্টালিকার ধনাঢ্য বিলাসী পর্যন্ত বহুলোক নিয়মিত মদ্যপায়ী। তারা এর পেছনে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে থাকে। নেশার খোরাক জোগাতে গিয়ে অনেকেই লিপ্ত হয় জুয়া খেলায়। অনেকে বাপের টাকা আর মায়ের গয়না চুরি করে। অনেকে নেশা করতে গিয়ে সংসারের অনটন ও অশান্তি বাড়িয়ে তোলে। আর জুয়াড়িদের একটা বড় অংশ বারবার হেরে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। তা ছাড়া মদপান বা মাদকের আসক্তির সাথে জুয়া, মিথ্যাচার, নির্যাতন, নারী নিপীড়ন এবং চুরি-ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধ সম্পৃক্ত। এসব মিলিয়ে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সর্বনাশ নিশ্চিত হয় না, তার পরিবার ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায় এবং সমাজটা দৃশ্যত যতই সমৃদ্ধ হোক, মূলত পাপাচার ও অন্যায়ই হয়ে দাঁড়ায় এর পরিণাম।

প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় একদিন বাসায় ফেরার পথে দেখি, থানার সামনে হইচই আর ভিড়। আমরা দু’তিনজন ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম ঘটনা জানার জন্য। সেখানে দেখলাম, মফস্বল শহরটির বহুল পরিচিত এক ধাঙ্গর তার মতো লম্বা একটা বাঁশ নিয়ে একাই থানায় হামলা চালিয়েছে। তার বিরাট গোঁফ জোড়ার নিচে, মুখ গহ্বর থেকে যে কথাটা হুঙ্কারের মতো শোনা যাচ্ছিল, তা হলো- ‘ইয়ে থানা হামারা সম্পত্তি হ্যায়’। হিন্দিভাষী ও মদখোর এই ধাঙ্গরকে শহরের অনেকেই চিনতেন। তার পরনে থাকত ধুতি; পায়ে জুতা। হাঁটত লম্বা লম্বা পা ফেলে। সেদিন মদ খেয়ে মাতলামি করতে করতে লোকটা থানাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেছিল। একজন দারোগা ব্যাপারটা ঠাহর করে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। আমরা কিছুক্ষণ পরে সেখান থেকে চলে আসি।

আরো বড় হয়ে দেখেছি, গরিব ও অশিক্ষিত ধাঙ্গরের ‘বাংলা মদ’ পানেই সীমিত নয় এই বদাভ্যাস। সচ্ছল ও শিক্ষিত হিসেবে পরিচিত লোকজনের একাংশও মদে আসক্ত। তখন হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা, সিসা প্রভৃতির প্রচলন দেখা যেত না। বরং অনেকে গাঁজা, আফিম, ভাং, তাড়ি প্রভৃতি দিয়ে মাদক সেবনের কাজ সারিয়ে নিত।

শৈশবে দেখেছি মেথরের মাতলামি। পরে শুনলাম, আমাদের সমাজে গণ্যমান্য কারো কারো পানাভ্যাস আছে। রঙিন পানীয়ে আসক্ত এমন লোকজনকে কেউ কেউ ঠাট্টা করে ‘মান্যগণ্য জঘন্য’ বলতেন। এ ধরনের লোকেরা সাধারণত ভদ্রবেশী বিত্তবান ও বেশ প্রভাবশালী। তাদের অনেককে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, উনি ‘তরল সোনা’র প্রতি আসক্তি বোধ করেন। অনেক দিন আগে এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শুনলাম, কাছেই একটা বাড়িতে পয়সাঅলা কয়েক ব্যক্তি সন্ধ্যা বেলায় মাতলামি করেন। দু’একবার নিজেও তাদের হৈ হল্লা ও নাচানাচি দেখে অবাক হয়েছি।

তাদের কারো কারো বাসভবন কাছেই এবং সেখানে তাদের বউ, ছেলেমেয়েরা থাকে। অন্যদেরও পরিবারের এ কথা জানা যে, কর্তা ব্যক্তিটির ‘পেঁয়াজ খাওয়ার অভ্যাস’ আছে। পেঁয়াজের কেজি দেড় শ’ টাকা হলেও তাদের হাতে এত কাঁচা টাকা যে, কিনতে কোনো সমস্যা হয় না। আমাদের দেশে সম্মানজনক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার অনেকেও সঙ্গ দোষে বা অন্য কোনো কারণে মদ বা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। সৎ সাধারণ ও নিরীহ মানুষ তাদের এসব কারবার দেখে অবাক হওয়া কিংবা আফসোস করা ছাড়া কি-ইবা করতে পারেন?

বাজারে যাওয়ার পথে এক জায়গায় দেখতাম একটা ব্যতিক্রমী বিপণি। ছোটো ছোটো খোপের মতো কাউন্টার। সেখানে কী যেন বিক্রি হয়। আর খরিদ্দারও নির্দিষ্ট কয়েকজন। মাঝ বয়সী এক বাবা আর তার তরুণ ছেলে মিলে ব্যবসায়টা চালাতেন। জানলাম, এটা ‘অনুমোদিত গাঁজার দোকান’। যাদের পারমিট আছে, কেবল তারাই এ দোকান থেকে গাঁজা কিনতে পারে সীমিত পরিমাণে। গঞ্জিকাসেবনের এই আইনসম্মত ব্যবস্থা এক দিকে ঔপনিবেশিক যুগের ধারাবাহিকতা; অন্য দিকে, প্রচলিত আইনের দুর্বলতা ও স্ববিরোধিতার একটি নজির।

কেউ উল্টাপাল্টা কথা বললে তাকে ব্যঙ্গ করা হতো ‘গাঁজাখোর’ বলে। কিন্তু এ যুগে কেউ মদপান করে যত অন্যায় বা অস্বাভাবিক আচরণ করুক না কেন, তাকে ‘মদখোর’ বলার সাহস কারো দেখা যায় না। একসময় নওগাঁ জেলা (সাবেক মহকুমা) গাঁজা চাষের জন্য পরিচিত ছিল। স্কুলের ভুগোল বইতেও থাকত এর উল্লেখ। তা বলে মনে করা উচিত হবে না যে, সেখানে বেশির ভাগ মানুষ গঞ্জিকাসেবী। প্রশাসনের অনুমোদনে ও পৃষ্ঠপোষকতায় এসব স্থানে গাঁজার চাষ করা হতো। তা থেকে সরকারের আয়ও হতো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। অপর দিকে, মানুষের মুখে মুখে ফিরত গাঁজাখোরদের নিয়ে বানানো ছড়া। যেমন- ‘এক ছিলিমে যেমন তেমন,/ দু’ছিলিমে প্রজা।/ তিন ছিলিমে উজির নাজির,/ চার ছিলিমে রাজা।/ ও আমার বাংলাদেশের গাঁজা।’ আবার ‘গাঁজার নৌকা পাহাড় দিয়া যায়’ বলা হতো উদ্ভট, অবাস্তব, অযৌক্তিক ও অসঙ্গত আচরণ প্রসঙ্গে।

গত শতকের শেষ দশকে সাভারে বিজ্ঞানবিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামে যেতে হয়েছিল পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে। ডিসেম্বরের ভোরে প্রচণ্ড শীতের মাঝে অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হতে হলো সবাইকে। সম্ভবত সকাল ১০টায় সভা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু দীর্ঘ সময় পরেও প্রধান অতিথি গিয়ে পৌঁছতে না পারায় তাকে ছাড়াই সভার কাজ শুরু হয়েছিল। জানা গেল, সরকারের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পানদোষ ছিল এবং এ কারণে অনেক সময় রাতে তিনি ঘুমাতেন অনেক দেরি করে। ফলে পরদিন সকালের প্রোগ্রামে সময়মতো হাজির হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না।

শুধু আমলা না নেতাদের কথাই বা বলব কেন, সমাজে যারা বুদ্ধিজীবী এবং মিডিয়া, বিনোদন, শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গনের মস্তিষ্কতুল্য, তাদের মধ্যে অনেকেই পানীয় সেবনের অভ্যাস করে এর ফাঁদ থেকে বের হতে পারেননি। তাদের মেধা, প্রতিভা, যোগ্যতা ও অবদান কম নয়। কিন্তু এই মন্দ অভ্যাস না থাকলে দেশ ও জাতিকে তারা অনেক বেশি দিতে পারতেন। খুব প্রতিভাবান ও সাহসী ব্যক্তিদের কেউ কেউ এ কারণে অকালে হারিয়ে গেছেন। পরিবারকে অসহায় অবস্থায় ফেলে তারা চিরবিদায় নিয়েছেন। কথায় বলে, ‘মানুষ প্রথমে মদ বা মাদক খায়। কিন্তু পরে সেই মন্দ জিনিসটিই তাকে গ্রাস করে।’ আমাদের দেশে বিভিন্ন অঙ্গনের বহু কৃতী ব্যক্তিত্ব এভাবে হারিয়ে গেছেন চিরতরে। তারা প্রথমে স্বীয় কর্মক্ষেত্র থেকে এবং একপর্যায়ে পৃথিবী থেকেই স্থায়ীভাবে প্রস্থান করেছেন। স্বজনের কান্না, ভক্তদের আহাজারি কিংবা শুভাকাক্সক্ষীদের সহানুভূতিÑ কিছুই তাদের আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি।

পাদটীকা : এক মাতালের কাহিনী শুনেছিলাম অনেক আগে। রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরার সময় সে ড্রেনে পড়ে যায়। তখন রাগে ক্ষোভে বলতে থাকে, ‘শালার ড্রেন, সারা দিন তুই থাকিস রাস্তার এক পাশে। রাতে যখন আমার বাড়ি যাওয়ার সময় হয়, তখন কেন রাস্তার মাঝখানে চলে আসিস?’ এই মাতাল একবার গভীর রাতে টলতে টলতে হাঁটছিল। সে সময়ে হঠাৎ একটা লাইটপোস্টের সাথে প্রচণ্ড ধাক্কা খায়। সাথে সাথে সে লোহার থামের গোড়ায় দু’হাত দিয়ে কদমবুচি করা শুরু করে দেয়। তখন তার কাছে সে লাইটপোস্টকে মনে হয়েছিল শ্রদ্ধেয় বাপজান। তাই নেশার ঘোরে বলতে থাকে, ‘আব্বাজান, আজকের মতো মাফ করে দেন। তওবা করে বলছি, জীবনে আর কোনো দিন মদ ছোঁব না।’

দু’মাতালের একজন আরেকজনকে বলছে, ‘দেখেছিস, পানিতে আগুন লাগায় সব মাছ গাছে উঠে গেছে’। শোনে দ্বিতীয় মাতাল বলল, ‘তুই আস্ত পাগল হয়ে গেছিস নাকি? মাছ তো আর গরু না যে, গাছে চড়বে!’

 


আরো সংবাদ



premium cement