১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ক্যাসিনো অভিযানের প্রাপ্তি

-

রাজনীতিকেরা আমাদের সব সময়ই আশার বাণী শোনান। আশাবাদী হয়ে আমরা প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখি নতুন এক সোনালি প্রভাতের। কিন্তু বারবারই আমাদের আশাহত হতে হয়।

দেশে যখনই ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে তখনই আমরা রাজনীতিকদের মুখে নতুন নতুন আশার বাণী শুনেছি। এমনকি মহান স্বাধীনতা সংগ্রামেও আমাদের অনেক স্বপ্ন দেখানো হলেও আমরা শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতাই পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে। অবাধ গণতন্ত্র, মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন আজো আমাদের কাছে অধরা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ’৭৫-এর পটপরিবর্তন, ’৮২ সালে এরশাদের ক্ষমতা দখল, ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান ও ২০০৬ সালের ১/১১-এর মাধ্যমে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তনের কথা বলা হলেও আমাদের ভাগ্যে তেমন কিছুই জোটেনি; বরং ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে শ্রেণিবিশেষের।

আমাদের পর্বতপ্রমাণ স্বপ্ন দেখিয়েই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। দুর্নীতিমুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ, ঘরে ঘরে চাকরি, উদার গণতন্ত্র ও সুশাসন উপহার দেয়াই ছিল এই সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার। টানা দুই মেয়াদ শেষ করে তৃতীয় মেয়াদেরও প্রায় এক বছর শেষ হয়ে এলো; কিন্তু কৃত অঙ্গীকারের তেমন বাস্তবায়ন লক্ষ করা গেল না। কিছু ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লক্ষ করা গেলেও দুর্নীতি এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। দুর্নীতি যে রাষ্ট্রের সব সেক্টরে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে তা রূপপুরের বালিশ, ফরিদপুরের পর্দা ও চট্টগ্রামের টিন কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন সাগরচুরির ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর আগে শেয়ার মার্কেট, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে আমরা সারা বিশ্বেই দুর্নীতিগ্রস্ত জাতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার কথা বলা হলেও বেকারত্ব আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে গণহারে চাকরিচ্যুতির ঘটনাও ঘটেছে।

ইতোমধ্যেই বৈদেশিক কর্মসংস্থানের পরিসর সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা পড়েছে, যা দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও যে খুবই ভঙ্গুর তা মহাজোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সাম্প্রতিক স্বীকারোক্তিতে স্পষ্ট। তিনি সম্প্রতি দাবি করেছেন, গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি। সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা তো দিতে পারেইনি, বরং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সারা দেশে খুনের মহোৎসবের অভিযোগ উপেক্ষা করার মতো নয়। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড তার স্পষ্ট প্রমাণ। সম্প্রতি ভোলায় ধর্মপ্রাণ মানুষের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে যে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে তা শান্তিপ্রিয় ও বিবেকবান মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। ফলে সুশাসনের বিষয়টি প্রশ্নাতীত হয়নি।

টানা ১১ বছরের শাসনে সরকারের কিছু অর্জন থাকলেও লাগামহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাষ্ট্রের সব বিভাগ দলীয়করণ, বিরোধী দলের ওপর দলন-পীড়ন, গুম, অপহরণ, গুপ্তহত্যা, কথিত এনকাউন্টারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও প্রতিবেশীর সাথে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির অভিযোগ রয়েছে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে। শাসনকাজের কোনো ক্ষেত্রেই সরকার খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি। তবে সাম্প্রতিক ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযান জনমনে চমক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। মনে করা হয়েছিল, সরকার বোধহয় তাদের চেতনা ইতোমধ্যেই ফিরে পেয়েছে।

রাজধানীর ক্লাবপাড়ায় অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য এবং টেন্ডারবাজিসহ নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর জনমনে নতুন করে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর অনমনীয় মনোভাব সর্বস্তরে প্রশংসিত হয়েছিল। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ থেকে আগাছা নির্মূলের এ অভিযানে ক্ষমতাসীন দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল উৎসাহ-উদ্দীপনা। কিন্তু সেই আশাবাদে ইতোমধ্যে ভাটার টান পড়েছে। কারণ, শুরুটা দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নামে হলেও এ অভিযানটি শেষ পর্যন্ত ক্লাবপাড়ায় অবৈধ ক্যাসিনো ও চুনোপুঁটি ধরার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আর ধীরে ধীরে তাও স্তিমিত হতে শুরু করেছে। এখন তা সাবেক যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও কমিশনার রাজীবের গ্রেফতার এবং রিমান্ডের বৃত্তেই আটকা পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে পর্বত যে মূষিকও প্রসব করতে পারেনি তা মোটামুটি স্পষ্ট।

ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে চাঁদাবাজির অভিযোগে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেয়ার পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে থাকায় এর বিরুদ্ধে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরা হয়।

মূলত দুর্নীতিবিরোধী নাম দিয়েই ক্যাসিনো অভিযান শুরু হয়। অবৈধভাবে ক্যাসিনো বাণিজ্য পরিচালনা এবং টেন্ডারবাজির অভিযোগে যুবলীগ এবং কৃষক লীগের কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। কার্যত অভিযানটি পরে ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে ক্লাবগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আর এখন অভিযান আদৌ চলছে কি না, সেই প্রশ্নই উঠতে শুরু করেছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী তাও স্পষ্ট নয়। ফলে রাজনৈতিকভাবে একটা সাময়িক কৌশল হিসেবে এই অভিযান চালানো হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন তো এখন মানুষের মুখে মুখে।

অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান মূলত চাপা পড়েছে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হতকাণ্ডের পরপরই। বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের নেতারা আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে। এরপর আলোচনার লাইমলাইটে উঠে আসে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড। বুয়েট শিক্ষার্থীকে হত্যার ঘটনা এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। এ ঘটনার পর আলোচনা থেকে হারিয়ে গেছে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। ফলে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও বিশ্লেষকদের অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

সরকারের দাবি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের কারণে এতে কিছুটা ধীরগতি এলেও অভিযান থেমে যায়নি। এমনকি সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব নিয়েই এগোচ্ছে। ক্লাবগুলোয় ক্যাসিনো-বাণিজ্যের মতো অনৈতিক কাজ হতো, সেগুলো ইতোমধ্যে বন্ধ করা হয়েছে। এখন গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আরো কেউ জড়িত আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান প্রসঙ্গে পুলিশ এবং র‌্যাবের কর্মকর্তারাও একই ধরনের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন, দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েই পুলিশ এবং র‌্যাব অভিযানে নামে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ থেমে নেই, এ অভিযানের সমাপ্তিও টানা হয়নি।

মূলত দুর্নীতি আমাদের দেশে কাঠামোগত। বাংলাদেশে এ ধরনের অভিযান জনগণকে তুষ্ট করার জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়; কিন্তু এসব অভিযানে মূলত চুনোপুঁটি ধরার বিষয়ে মনোযোগ দেয়া হয় বেশি। আর রাঘব বোয়ালরা বরাবরই অধরা থেকে যায়। ব্যাংক ঋণ আর নির্মাণের সাথে জড়িত বড় দুর্নীতিগুলোতে হাত দেয়া হয় না। দুর্নীতির বরপুত্র সরকারি দলের রাঘব বোয়ালদের কেশাগ্রও স্পর্শ করা হয় না। আসলে সরকারের নির্লিপ্ততা ও উদাসীনতার কারণেই তা এখন প্রায় অপ্রতিরোধ্য।

সাম্প্রতিক অভিযানে ক্যাসিনো নিয়ে অনেক অজানা তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে যেমন সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তেমনি নানাবিধ প্রশ্নেরও অবতারণা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সরকার ও প্রশাসনের নাকের ডগায় এত দিন ধরে অবৈধভাবে ক্যাসিনো বাণিজ্য চলেছে কিভাবে? অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্যসহ দুর্নীতিবিরোধী চলমান অভিযানে এখন র‌্যাবকে একক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ, অন্যদের ওপর নাকি এ বিষয়ে আস্থা রাখা হয়নি। কিন্তু মজার বিষয় হলো পুলিশ, র‌্যাব ও সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা এর দায় নিতে রাজি নয়। কিন্তু সরকারের অর্থমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা প্রশাসনের নজরের বাইরে অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য চলেছে কিভাবে?

সীমিত পরিসরে কোনো অভিযান চালিয়ে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না। আসলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে হলে রাজনীতিকে অনিয়ম-অগণতান্ত্রিকতা-দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে- রাজনীতি ঠিক না হলে সমাজ ঠিক হবে না, দুর্নীতিও দূর হবে না। তাই সাম্প্রতিক অভিযান কোনো সঙ্কীর্ণ বৃত্তে সীমাবদ্ধ না রেখে আরো বিস্তৃত করতে হবে। শুধু পুলিশি অভিযান নয়, বরং রাজনীতিতেও চাই সংস্কার ও শুদ্ধি অভিযান।

smmjoy@gmail.com

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement