২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

প্রসঙ্গ: নারী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা

-

বেশ কিছু সিনিয়র নারী শিক্ষাবিদের সাথে আমার আলোচনা হয়েছে, যাদের সবাই বিভিন্ন বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। তাদের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বাকিরা সহযোগী অধ্যাপক। তারা আমাকে জানালেন, নারীদের সার্বিক অবস্থা সন্তোষজনক নয়। বিশেষ করে মুসলিম নারীদের অবস্থা। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের শিক্ষার ওপর গুরুত্ব কম দেয়া হয়। ছেলেরা শিক্ষা কমবেশি পায়, উচ্চশিক্ষা নিতে পারে; কিন্তু মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় অল্প বয়সে এবং বিয়ের পর তারা আর পড়তে পারে না।

৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ মেয়ের ক্ষেত্রে বিয়ের পরে তাদের আর পড়ার সুযোগ থাকে না। ফলে বাস্তব অবস্থা দাঁড়িয়েছে, মুসলিম নারীসমাজে তাদের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, সেটি তারা করতে পারছেন না। মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি, মুসলিম নারীও আল্লাহর খলিফা ও একই রকম খলিফা। পুরুষের মতোই খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গেলে যা লাগে, সেটি হচ্ছে তার শিক্ষা। খলিফার দায়িত্ব কখনোই পালন করা সম্ভব হবে না, যদি তিনি পর্যাপ্ত শিক্ষা না পান।

আমাদের সমাজে, মুসলিম সমাজে, এমনকি সারা দুনিয়ার বেশির ভাগ জায়গায় বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে (কোথাও বেশি, কোথাও কম) নারীরা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না আজো। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে তারা উচ্চশিক্ষা নিতে পারছেন না। এ প্রসঙ্গে উল্লিখিত মহিলারা আমার বক্তব্য জানতে চেয়েছেন। তাদের বলেছিলাম- গত ৫০ বছরে যে উন্নতি হয়েছে, সেটি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। সে উন্নতি হলো- এখন তাত্ত্বিকভাবে এটা মেনে নেয়া হয়েছে যে, নারীর অধিকার আর পুরুষের অধিকার প্রায় এক। ‘প্রায় এক’ বললাম এ কারণে যে, নারীরা যেকোনো চাকরিতে যেতে পারেন। এখন খুব বড় আলেমও বলবেন না যে, মেয়েরা চাকরি করতে পারেন না এবং তারা এ কথাও বলবেন না যে, তারা কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারেন না। আজকে স্বীকৃত হয়ে গেছে, নারীরা রাজনৈতিক নেতৃত্বে যেতে পারেন, তারা সংসদ সদস্য হতে পারেন, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও হতে পারেন; তারা দলের নেত্রী হতে পারেন।

যেমন- মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নবাগত আজিজাহ হচ্ছেন একই বড় দলের নেত্রী এবং একই সাথে উপপ্রধানমন্ত্রী। শিক্ষার অধিকারের ব্যাপারেও নীতিগতভাবে আলেমরা একমত। বিশেষ করে যারা ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করেন, ইসলামী নেতৃত্বের যে অংশ গুরুত্ব বহন করে, তারা নারী শিক্ষার বিরোধী নন। এ ব্যাপারে ইসলামী চিন্তাবিদদের কেউ বলেননি যে, নারী শিক্ষার দরকার নেই। নারী নেত্রীদের বললাম, বাস্তবতা যদি এমন হয়েও থাকে যে, নারীর সামাজিক ভূমিকা সে পর্যায়ে পৌঁছেনি, যে পর্যায়ে পৌঁছা যেত এবং এই সমস্যা আছে যে, নারীরা শিক্ষা পাচ্ছেন না বা বিয়ে হওয়ার কারণে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তারপরও, নীতিগতভাবে নারীদের যে আইনি অবস্থান এবং শরিয়তের দৃষ্টিতে তাদের যে আইনগত মর্যাদা ও অধিকার, সার্বজনীনভাবে এ বিষয়ে একটি স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সুতরাং অনুরোধ জানাই, এখন শুধু জেন্ডার ইস্যুর ওপর কাজ করার দরকার নেই। আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আপনারা নারী, আপনারা পুরুষও হতে পারতেন। নারী হিসেবে এখন শুধু জেন্ডার ইস্যুর ওপর আপনাদের কাজ করা যথেষ্ট মনে করি না। আপনাদের সব ইস্যুতেই কাজ করতে হবে। জেন্ডার ইস্যু, এগুলোর একটি ইস্যু মাত্র। আপনাদের কাজ করতে হবে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে, কাজ করতে হবে গণতন্ত্রকে সংহত করার জন্যও।

যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই, সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্র সংহত করার জন্য কাজ করতে হবে। এ ছাড়া, যত সামাজিক সমস্যা আছে, যেমন রাস্তাঘাটে লোকেরা পড়ে আছে- এসব ইস্যুসহ আপনাদের সব ইস্যুতে নজর দিতে হবে, শুধু জেন্ডার ইস্যুতে নয়।

বিশেষ করে, যে দু’টি ইস্যু তারা তুলেছিলেন সে আলোকে তাদের বলেছি, এটা ঠিক যে, বেশির ভাগ এলাকায় মুসলিম মেয়েরা শিক্ষা পাচ্ছেন না বা কম পাচ্ছেন, মধ্যবিত্তরা হয়তো বা পাচ্ছেন; কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্তরা হয়তো বা পাচ্ছেন না। তদুপরি, অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরা শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছেন না। সাধারণভাবে যদি এমন হতো যে, বিয়ের পরও শিক্ষা অব্যাহত থাকবে, তাহলে আর এ সমস্যা সৃষ্টি হতো না। ফলে আমি তাদের সাথে একমত এবং তারাও আমার সাথে একমত যে, এ দু’টি কাজ করতেই হবে : প্রথমত, ১৮ বা ১৬ বছর বয়সের আগে বিয়ে দেয়া বন্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। শরিয়াহ এটা ফরজ করে দেয়নি, তবে শরিয়াহতে এর অনুমতি আছে। শরিয়াহ’র দৃষ্টিতে অল্প বয়সে বিয়ে করা ওয়াজিব নয়। যদি কোনো ক্ষেত্রে অল্প বয়সে বিয়ে হয়ও, তাহলে তার লেখাপড়ার অধিকার আছে (যদি আর্থিক অবস্থা ভালো থাকে)। তার অভিভাবকদের সেটি তাদের ছেলের মতোই অব্যাহত থাকতে দিতে হবে। অর্থাৎ বিয়ে হলেও যাতে মেয়েদের একটা বড় অংশ উচ্চশিক্ষা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এটি একটি কঠিন বিষয় এবং এর ফর্মুলা বের করা হতে পারে কঠিন; কিন্তু হতে পারে তা সময়ের ব্যাপার।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষা পুরোপুরি সবার। এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘তালাবুল ইলমে ফারিদাতুন আলা কুল্লি মুসলিমিন। অর্থাৎ, শিক্ষা অর্জন করা সব মুসলিমের জন্য ফরজ। এ ছাড়া, আল্লাহ যখন বললেন ‘ইকরা’ (ৎবধফ), তখন তিনি বললেন না, ‘শুধু মুসলিম বা পুরুষের জন্য শিক্ষা।’ সুতরাং শিক্ষার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা ও আল্লাহর রাসূল সা: সবার জন্য সমানভাবেই গুরুত্ব দিয়েছেন এ জন্য যে, শিক্ষা ছাড়া কেউ কোনোভাবেই আল্লাহর খলিফা হতে পারবেন না এবং দুনিয়ায় খেলাফত কায়েম করতে সক্ষম হবেন না। খেলাফত মানে আল্লাহ যা চান তা প্রতিষ্ঠা করা, আল্লাহ যে রকম মানুষ চান, সে রকম মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করা, আল্লাহ যে রকম সমাজ চান তেমন সমাজ তৈরি করা, আল্লাহ যে রকম অর্থনীতি চান সে ধরনের অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা, আল্লাহ যে রকম রাজনৈতিক ব্যবস্থা চান (যেখানে মানুষের অধিকার থাকবে) তা প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষা ছাড়া এগুলো সম্ভব নয়।

সার্বিকভাবে আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে গোটা মুসলিম জাতির দায়িত্ব আছে, আলেম সমাজের দায়িত্ব আছে, সরকারের দায়িত্ব আছে। ইসলামী চিন্তাবিদদের দায়িত্ব আরো বেশি এবং পুরুষদেরও আরো বেশি দায়িত্ব। নারীরা কমবেশি বঞ্চিত; এটা মেনেই আমাদের এগোতে হবে।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement