১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সামাজিক নর্মস শিখুন, স্মার্ট হোন

-

আমাদের শ্রদ্ধেয় সম্পাদক সাহেব অফিসের কাজের ফাঁকে ইন্টারনেটে ঘোরাফেরা করেন। মজার বা দরকারি কোনো তথ্য পেলে সবার সাথে ‘শেয়ার’ করেন। কখনো এসে জিজ্ঞেস করেন- বলুন তো, কোন দেশে সব বাড়ির নিচে বাংকার করা আছে এবং যুদ্ধ বা বোমা হামলা হলে দেশের সব মানুষ সেসব বাংকারে আশ্রয় নিতে পারবে? তার এমন ধারার সব প্রশ্নের কোনোটার জবাব দিতে পারি, কোনোটার পারি না। তিনি অনেক সময় কোনো ইংরেজি আর্টিক্যালের প্রিন্ট নিয়ে এসে আমাদের জনে জনে দেখান। জানতে চান, এই ম্যাটারটা কোথায়, কিভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে? কখনো বলি, ‘এটা ফিচারের অমুক পাতায় ছাপতে পারেন অথবা তরজমা করে নিউজের পাতায় ছাপানো যায়।’ তিনি ম্যাটারটা জায়গামতো পাঠিয়ে দেন।

গত সপ্তাহে একটা প্রিন্ট কপি এনে পড়তে বললেন। জানতে চাইলেন, এটা কিভাবে কাজে লাগানো যায়? পড়ে বললাম, ‘বিষয়টা খুব ভালো। এ বিষয়ে একটি উপসম্পাদকীয় লিখতে পারেন। মানুষের কাজে লাগবে।’ তিনি হুকুম দিলেন, তাহলে আপনিই লিখুন। যেহেতু চিন্তাটা আপনার মাথায় এসেছে আপনিই ভালো লিখতে পারবেন। এরপর আর কথা চলে না। গুরুবাক্য শিরোধার্য করে প্রিন্ট কপিটা নিজের কাছে রেখে দিলাম।

সেই প্রিন্টে লেখা ছিল, What are some unwritten social rules everyone should know? কিছু অলিখিত সামাজিক বিধি, যা সবার জানা দরকার। সামাজিক বিধিবিধান বা নিয়ম সমাজবিজ্ঞানের একটি বিষয়। এ সম্পর্কে আমার লেখাপড়া নেই। তবে সমাজের মানুষ হিসেবে অনেক নিয়মবিধি আমরা দৈনন্দিন জীবনে মেনে চলি এবং অনুসরণ করি। এর কিছু আছে যেগুলো আবহমানকাল ধরে চলে আসা, কিছু ধর্মীয় বা বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত, কিছু আবার পুরনো প্রথাগত নিয়মকানুন কিংবা সমাজে বা রাষ্ট্রের আরোপিত আইন ইত্যাদি।

এ বিষয়ে গুরুগম্ভীর তাত্ত্বিক আলোচনার অবতারণা করতে চাচ্ছি না। লিখিত যে নিয়মবিধি আমাদের মেনে চলতে হয়, সেগুলোও আনতে চাই না। আমি সাধারণভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনুসৃত শিষ্টাচার বা সৌজন্যমূলক আচরণ ও বিধিবিধানের মধ্যে আলোচনা সীমিত রাখতে চাই।

শিষ্টাচার মার্জিত রুচিসম্পন্ন হৃদয়ের একটি স্বতঃস্ফূর্ত গুণ। মানুষের কথাবার্তায়, চালচলনে, আচার-আচরণে, আহার-বিহারে তথা সার্বিক আচরণে সৌজন্যবোধ ও শালীনতাকে ‘শিষ্টাচার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, শিষ্টাচার হচ্ছে কতগুলো মানবীয় গুণের সমাহার। যেমন- জ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধি, আদর্শবাদিতা ইত্যাদি হচ্ছে শিষ্টাচারের অপরিহার্য অঙ্গ। মানবজীবনের যতগুলো গুণ আছে তার সমন্বয়ে গঠিত হয় শিষ্টাচার। আর শিষ্টাচার জীবনকে সুন্দর ও নিষ্কণ্টকরূপে গড়ে তোলে। তাই তো শিষ্টাচারকে ‘মানবজীবনের ভূষণ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। শিষ্টাচার হলো বিনয় বা নম্রতা, ব্যক্তির আচরণে যার প্রকাশ ঘটে।

শিষ্টাচার দিয়ে মানুষের পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি হয় এবং মানবিক সম্পর্ক সুন্দর ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। শিষ্টাচার ব্যতীত কখনো মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা যায় না। জীবনে সাফল্য অর্জন করতে হলে শিষ্টাচারের গুণ থাকা অপরিহার্য। তাই সমাজের স্বার্থে প্রত্যেকেই শিষ্টাচারী হওয়া অবশ্য কর্তব্য। শিষ্টাচার সমাজ জীবনকে সুন্দর, সার্থক ও উন্নত করে। সংস্কৃতিতে একটি শ্লোক আছে- ‘বিনয়েন বশীকৃতং ভবেৎ’ অর্থাৎ বিনয় দিয়ে ভুবন বশীভূত করা যায়। সামাজিক জীবনে শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের গুরুত্ব সীমাহীন। শিষ্টাচার মানব চরিত্রের মহৎ গুণাবলির মধ্যে অন্যতম। শিষ্টাচারেই নিহিত রয়েছে মানব জীবনের সাফল্যের চাবিকাঠি। 'The greatest ornament of an illustrious life is modesty and humanity'- নেপোলিয়নের এ কথাটি তর্কাতীতভাবে সত্য।

তাই প্রত্যেক মানুষ মনেপ্রাণে শিষ্টাচারী হওয়া অবশ্য কর্তব্য। ইংরেজিতে আরেকটি কথা আমরা অনেকে প্রায়ই শুনে থাকি। কথাটা হলো, 'Courtesy costs nothing but buys everything'। কেউ হয়তো জেনে বিস্মিত হবেন, এ কথাটি মূলত ইংরেজি কোনো বাগধারা নয়। ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী ইবনে আবু তালিব রা: এই বাণী দিয়েছিলেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, টাকা-পয়সা বা অন্য কোনো মূল্য না দিয়েও কেবল শিষ্টাচারের গুণে মানুষের পক্ষে অনেক অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। শিষ্টাচার আপনার ভাবমূর্তি বাড়িয়ে দেবে, মানুষের ভালোবাসা পেতে সহায়ক হবে, আপনার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে এবং আপনাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলবে। তা ছাড়া, সমাজে নেতৃত্বের অবস্থান তৈরি হয়। ফলে মহৎ কিছু কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়।

প্রাচীন পারস্যের জগদ্বিখ্যাত কবি, দার্শনিক, পণ্ডিত শেখ সাদী এক কবিতায় বলেছেন,
‘বিনয় উন্নতির পথে প্রধান সোপান
বিনয়ে মানব হয় মহামহীয়ান।’

শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ সমাজজীবনকে উন্নত করে, পরিবেশকে সুষমামণ্ডিত ও সুন্দর করে, মানুষে মানুষে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি বাড়ায়। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ঐশ্বর্যের অহঙ্কার ইত্যাদি সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আর শিষ্টাচার ও সৌজন্য বোধের বিকাশ ঘটাতে পারলে পৃথিবীতে শান্তির নীড় রচনা করা সম্ভব। তাই প্রতিটি মানুষ শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। কারণ, শিষ্টাচারের গুণের মধ্যেই ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের কল্যাণ নিহিত।

ছেলেবেলায় আমাদের অনেক মহান বাণী শিখতে হয়েছে। আদর্শলিপি আমাদের গোটা জাতির একটি অভিন্ন মনন গড়ে তুলতে সহায়ক ছিল। সেখানেই ছিল এই কথাটি, ‘কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না।’ মানুষকে অকারণে দুঃখ দেয়া থেকে বিরত থাকার এই মহতী শিক্ষা এখনকার ছেলেমেয়েরা পায় না। তাদের বয়ঃজ্যেষ্ঠদের মুখে বা পারিবারিকভাবে এগুলো শিখতে হয়। কিন্তু সব পরিবারের শিক্ষা, রুচি, পছন্দ এবং সংস্কৃতি এক নয়। তাই আমাদের সমাজেও ভিন্ন ভিন্ন আচরণের মানুষ দেখা যাচ্ছে, সমাজে এককেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনার অবসান ঘটে গেছে। কিন্তু শুভ ও কল্যাণের প্রশ্নে এই এককেন্দ্রিকতার প্রয়োজন ছিল, এখনো আছে। একসময় যেসব শিক্ষণীয় ও উপদেশমূলক ছড়া বা কবিতা লেখা হতো এবং পাঠ্যপুস্তকে সঙ্কলন করা হতো সেগুলোকে কাব্যতর ‘পদ্য’ আখ্যা দিয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এখন আর কেউ উপদেশমূলক ছড়া বা কবিতা লেখেন না। পাঠ্যপুস্তকেও সেগুলো নেই। এর ফলাফল আজকের সমাজের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, চুরি, ঘুষ, দুর্নীতি, নৃশংসতা ও নির্মমতা- এমন কোনো অপরাধ নেই যা মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়েনি।

আলোচনা একটু বোধহয় ভারী হয়ে গেল। তার চেয়ে চলুন, আমরা সাধারণ কিছু নর্মস বা মোরেস নিয়ে কথা বলি। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে এখন অনেকেই ফেসবুকে শিক্ষণীয় বিষয় পোস্ট করে থাকেন। তেমনি একজনের পোস্টের কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করছি। তিনি লিখেছেন, ‘কখনো কাউকে কামলা, কাজের লোক বা বুয়া বলে ডেকো না, মনে রেখো তারাও কারো না কারো ভাই, বোন, মা অথবা বাবা।’ ‘কাউকে সাহায্য করে পিছন ফিরে দেখতে যেও না, লোকটি লজ্জা পেতে পারে।’ ‘সব সময় পাওয়ার চেয়ে বরং দেয়ার চেষ্টা করো বেশি। মনে রেখো, দাতার হাতই সব সময় উপরে থাকে।’ ‘এমন কিছু করো না যার জন্য তোমার এবং তোমার পরিবারের দিকে লোকে আঙুল তুলতে পারে।’ ‘তোমার কী আছে সেটা তোমার গায়ে লেখা নেই, কিন্তু তোমার আচরণেই বেরিয়ে যাবে তোমার বংশ-পরিচয় কেমন।’ ‘সব সময় নম্র ও ভদ্রভাবে চলো এবং কথা বলো। কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে আপস করো না।’

এসব নীতিকথা আমরা সাধারণভাবে মেনে চলি। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির মধ্যে এগুলো এখনো টিকে আছে। সম্পাদক সাহেব যে প্রিন্ট আউট আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাতে পাশ্চাত্য সমাজের উপযোগী কিছু নর্মসের কথা ছিল। তারও কয়েকটি আমরা অনুসরণ করি। সেগুলোর উল্লেখ করব না। শুধু পাশ্চাত্যের উপযোগী এবং পাশ্চাত্যের মানুষ মেনে চলেন- এমন কিছু পয়েন্ট তুলে ধরছি। এগুলো আমাদের সমাজেও চালু হলে ভালো ছাড়া খারাপ হবে না।

যেমন- ‘অন্যের বাচ্চাকে কখনো চুমু খেতে যাবেন না।’ ‘কাউকে ফোন করলে দুবার রিং হওয়ার পরও যদি তিনি না ধরেন তাহলে লাইন কেটে দিন। নিজের সম্মান বজায় রাখুন।’ ‘নতুন কারো সাথে দেখা হলে খুব বেশি কথা বলবেন না। প্রথম দেখাতেই পুরনো বন্ধুর মতো আচরণ ভালো দেখায় না।’ ‘কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে কিছু শুনছেন, এমন সময় কেউ রুমে ঢুকলে এক কান ফ্রি করে নিন, কারণ যিনি এসেছেন তিনি কিছু বলতেও পারেন।’ ‘হাঁচি এসে গেলে বা হাই উঠলে হাত দিয়ে মুখ চেপে রাখুন।’ ‘হোটেলের ওয়েটারকে সেই সম্মান দেখান যেমনটা একজন সিইওকে দেখান।’ ‘কারো সাথে কথা বলার সময় একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না, কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলুন।’ ‘সব সময় বিলম্ব করবেন না। নিয়মিত বিলম্বে কোথাও উপস্থিত হওয়া খুবই বিরক্তিকর।’

‘টয়লেট সারার পর অবশ্যই হাত ধুয়ে নিন এবং ফ্লাশ চাপুন।’ ‘কেউ যদি আপনাকে সরাসরি কোনো কিছুতে জড়িত না করে, তাহলে নিজের চরকায় তেল দিন, নাক গলাতে যাবেন না।’ ‘সব সময় লাইনের পেছনে দাঁড়ান, পরে এসে আগে সেবা নেয়ার চেষ্টা করবেন না।’
‘মুখে খাবার নিয়ে কারো সাথে কথা বলবেন না, মুখের খাবার গিলে নিয়ে তারপর কথা বলুন।’ ‘যে বন্ধুটির এখনো কর্মসংস্থান হয়নি, তার সামনে ফুটানি দেখাবেন না।’

‘মুখে দুর্গন্ধ নিয়ে কাউকে চুমু দিতে যাবেন না।’ ‘কারো সাথে দেখা করার কথা থাকলে অবশ্যই কমপক্ষে ১০ মিনিট আগে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছান। দেরি হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সেটা জানান এবং সম্ভব হলে আগেই জানান।’ ‘অনেক লোকসমাগমে চিৎকার করে কথা বলবেন না। অন্যদের কথা বলার সুযোগ দিন এবং স্বাভাবিক স্বরে কথা বলুন।’

অফিসে বা যানবাহনে সবার সামনে দাঁত খোঁচানো, নাক খোঁটা, নাক ঝাড়া, থুথু বা কফ ফেলা, টেলিফোনে চেঁচিয়ে কথা বলা, ভাড়া নিয়ে কন্ডাক্টরের সাথে ঝগড়া, রিকশাচালকের সাথে দুর্ব্যবহার- এগুলো আমাদের অনেকের খুব বাজে অভ্যাস। এসব বদভ্যাস ত্যাগ করুন, নাগরিক ভব্যতা শিখুন, স্মার্ট হোন।


আরো সংবাদ



premium cement