২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘চিলড্রেন মে বি ওয়াইজার দেন দেয়ার এল্ডার্স’

-

আজকের লেখার শিরোনামটি বলা যায় ধার করা। কারণ, একই শিরোনামে লেখা একটি ইংরেজি গল্প পড়েছিলাম আজ থেকে ৫০ বছর আগে, উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়ার সময়ের ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে। গল্পটির লেখকের নাম আজ স্মরণে নেই। তবে গল্পটির বিষয়বস্তু আজো স্পষ্ট মনে আছে। গল্পটি ছিল দু’টি ছোট্ট বালিকা মালাশা ও আকুলকাকে নিয়ে। এরা দু’জন পাশাপাশি বাড়িতে থাকে। একদিন বৃষ্টির দিনে খেলতে গিয়ে একজন আরেকজনের গায়ে কাদাপানি ছোড়ে। এতে তাদের মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া বাধে। এ সময় তাদের মায়েরাও ঘটনাস্থলে এসে হাজির। এ নিয়ে দুই মায়ের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। মালাশার মায়ের অভিযোগ, আকুলকা অন্যায় করেছে। আকুলকার মায়ের অভিযোগ, মালাশাই এ জন্য দায়ী। দু’জনার পাল্টাপাল্টি অভিযোগে বিষয়টির আর মীমাংসা হচ্ছে না।

গলাবাজি-ঝগড়া চলছেই। ইতোমধ্যে বহু মানুষ এসে সেখানে জড়ো হয়েছে। সবাই দুই মায়ের ঝগড়া দেখায় ব্যস্ত। আর মায়েরাও যেন থামতে চাইছেন না। এমন সময় সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন প্রবীণ এক বিজ্ঞজন। তিনি সেখানে গিয়ে জানতে চাইলেন ঘটনাটা কী? একজন বললেন, এই যে দূরে মাঠে দু’টি ছোট্ট বালিকা দেখছেন। ওরা কিছুক্ষণ আগে খেলতে গিয়ে একে অপরের শরীরে কাদাপানি ছিটায়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া বাধে। সেই ঝগড়াই সংক্রমিত হয় তাদের মায়ের মধ্যে, তা এখনো চলমান। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। ঘটনা এখানেই। ওই প্রবীণ লোকটি মালাশা ও আকুলকার মায়েদের কাছে ডেকে তাদের কথা শোনেন। তিনি এ দুই মাকে বললেন, যাদের নিয়ে আপনারা ঝগড়া করছেন, সে দু’জন তো তাদের সেই ঝগড়াঝাটি ভুলে দেখুন আবার মাঠে খুশিমনে দু’জনে মিলে খেলায় মেতেছে। তাদের ঝগড়া তো অনেক আগেই শেষ। অথচ আপনরা ঝগড়া চালিয়ে যাচ্ছেন কেন?

এরা যদি নিজেদের ঝগড়াবিবাদ এত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারে, তাহলে আপনারা কেন তা পারছেন না। তাহলে আমি তো দেখছি, এ শিশুরাই হচ্ছে আমরা বড়দের চেয়ে জ্ঞানী। তাই এরা দ্রুত ঝগড়াঝাটি ভুলে আবার মিলমিশে খেলায় মেতে উঠতে পেরেছে। এ শিক্ষাটিই আমরা পাই ‘চিলড্রেন মে বি ওয়াইজার দেন দেয়ার এল্ডার্স’ নামের এ গল্পটি থেকে। শিশুরা যে আমাদের চেয়ে জ্ঞানী ও এরা যে আমাদের অনেক কিছুই শেখাতে পারে, সে উপলব্ধিই নতুন করে আজ মনে পড়ল শিশুদের সাম্প্রতিক জলবায়ু ও পরিবেশ বাঁচানোর অনন্য আন্দোলনের উদাহরণ থেকে। একই সাথে মনে পড়ল ৫০ বছর আগে ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে পড়া উল্লিখিত এ গল্পটি।

আমরা দীর্ঘ দিন ধরেই দেখে আসছি, বড়রা অর্থাৎ বিশ্ব মোড়লেরা জলাবায়ুর পরিবর্তন রোধ ও পরিবেশের বিনাশ রোধের বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে নোংরা রাজনীতি করে যাচ্ছে। আর এর ফলে বিশ্ব পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। গোটা বিশ্ব আজ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মানবজাতির অস্তিত্ব বিলীনের পথে।

এই ব্যর্থতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে সম্প্রতি রাজপথে নেমে এসেছে বিভিন্ন দেশের শিশু-কিশোররা। গত ২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিশ্বজুড়ে অনেক শহরে পাঁচ হাজার শিশু-কিশোর সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশের শুরুটা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া দিয়ে। আয়োজকেরা জানায়, এ দিনে অস্ট্রেলিয়ায় তিন লাখেরও বেশি শিশু-কিশোর জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নীতিনির্র্ধারকদের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবিতে রাজপথে নেমে আসে। যেখানে আমরা বড়রা প্রতিনিয়ত পরিবেশের ওপর নানা ধরনের নানামাত্রিক যথেচ্ছ উপদ্রব চালিয়ে যাচ্ছি, জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে নেয়া নানা কর্মসূচিতে বাধা সৃষ্টি করে চলেছি, মেনে চলছি না নানা আন্তর্জাতিক জলবায়ু প্রটোকল ও সনদ, সৃষ্টি করে চলেছি ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানবজাতিকে আজ দাঁড় করিয়েছি অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি, সেখানে বিশ্বের শিশু-কিশোররা আজ রাজপথে নেমে এসেছে বড়দের প্রতি প্রতিবাদ ও ক্ষোভের ভাষা উচ্চারণ করতে; চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের ভুল আর ব্যর্থতা ধরিয়ে দিতে। সুইডেনের কিশোরী গ্রেটা থানবার্গের ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ নামের আন্দোলন জোরদার করে তুলতেই বিশ্বের শিশু-কিশোররা গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে গত ২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাস্তায় নেমে এসেছিল।

বিক্ষোভকারীদের উপস্থিতি বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। সুখের কথা, ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ে ওইদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুলের কয়েক হাজার শিক্ষার্থীও একই দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। বাংলাদেশের এসব শিশু-কিশোরও বিশ্বনেতাদের কাছে জলবায়ু পরিবর্তনরোধী জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানায়। সেভ দ্য চিলড্রেন ও গ্রিন সেভার্স অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ আয়োজনে এ শিশু-কিশোর সমাবেশে রোভার স্কাউট, গার্লস গাইড ও স্কুল কেবিনেটের সদস্যরা অংশ নেয়। এদের সবার চাওয়া ‘ক্লাইমেট জাস্টিস’। শিশু-কিশোরদের এই পরিবেশ সচেতনতা সত্যিই অবাক করার মতো। ওইদিন বিশ্বজুড়ে শিশু-কিশোররা একটি মৌলিক দাবিই তুলে ধরে : ‘বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারকরা যেন আর কথা না বাড়ায়, জলবায়ু কর্মসূচি নিয়ে নোংরা রাজনীতি না করে, এখনই যেন জলবায়ু পরিবর্তনবিরোধী কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে মাঠে নামে।’

২০ সেপ্টেম্বরের বিশ্বব্যাপী এই অভাবনীয় শিশু-কিশোর সমাবেশে যোগ দিয়েছিল থাইল্যান্ডের গ্রেটা হিসেবে ইতোমধ্যেই পরিচিতি পাওয়া ১২ বছরের কিশোরী লিলি তাকিদতানাসার্ন। তার অভিমত, ‘আমরাই ভবিষ্যৎ। আরো ভালো কিছু পাওয়ার অধিকার আমাদের আছে।’ কী যথার্থ উচ্চারণ! পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে তার মতো উচ্চারণ কেন আমাদের বড়দের মুখ থেকে উচ্চারিত হয় না। কেন আমরা পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে নোংরা রাজনীতিতে মেতে থাকি, ভেবে সত্যিই লজ্জা বোধ হয়। আরো লজ্জা হয়, যখন তার মতো আরেক জন কিশোরী গ্রেটা থানবার্গের মুখ থেকে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উচ্চারিত হয় : ‘জলবায়ু নিয়ে বয়স্করা শুধু কথাই বলে, কিন্তু কাজের কিছুই করে না। কাজের কিছু না করে শুধু কথা বলে কোনো অজুহাত আর আমরা শুনতে চাই না।’

জলবায়ু নিয়ে সবচেয়ে নোংরা রাজনীতিতে বরাবর লেগে থাকা দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ আমেরিকা মহাদেশের শিশু-কিশোররাও এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসে বিশ্বের শিশু-কিশোরদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করে। সময়ের পার্থক্য থাকার কারণে এই ভূখণ্ডের শিশু-কিশোররা এ বিক্ষোভে পথে নামে সবশেষে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ১৮০০ স্কুলের ১১ লাখ শিক্ষার্থী ওইদিন রাজপথে নেমে আসে। তাদেরকেও মোবারকবাদ জানাতেই হয়।

শিশু-কিশোরদের এই জলবায়ুর পরিবর্তনরোধী আন্দোলনে ১৪ বছরের যে কিশোরী আজ বিশ্বজুড়ে অবাক করা এক নাম, তার নাম গ্রেটা থানবার্গ। ইতোমধ্যেই এই কিশোরীকে ‘রাইট লিভলিহুড অ্যাওয়ার্ড’ দেয়া হয়েছে। এটি ‘বিকল্প নোবেল পুরস্কার’ নামেও পরিচিত। এ বছর থানবার্গসহ মোট চারজন এই পুরস্কার পেয়েছেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাইট লিভলিহুড ফাউন্ডেশন থেকে এই চারজন পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। থানবার্গকে কেন এই পুরস্কার দেয়া হলো, সে ব্যাপারে ফাউন্ডেশনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে- তিনি বিজ্ঞানের বাস্তবতার ভিত্তিতে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার রাজনৈতিক দাবিকে আরো জোরালো ও বিস্তৃত করেছেন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে’ উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন ১৬ বছরের এই কিশোরী। তার বক্তব্যে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ব্যর্থতার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি ক্ষুব্ধ নিন্দা জানান।

এই কিশোরীর বক্তব্যটির ভিডিওচিত্র দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তার বক্তব্যটি যতই শুনছিলাম, ততই মনে হচ্ছিল- সত্যিই ‘চিলড্রেন মে বি ওয়াইজার দেন দেয়ার এল্ডার্স’। তার চোখেমুখে বিশ্বনেতাদের প্রতি ঘৃণার যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল, তা দেখে এই কিশোরীর সাহসের প্রশংসা করতেই হয়। বক্তব্য রাখার সময় এই কিশোরীকে অতি কষ্টে তার চোখের পানি ও ক্রোধ সংবরণ করতে দেখা গেছে। গ্রেটা থানবার্গ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ১৪০ জন ব্যক্তির সামনে ১৫ মিনিট ধরে অভাবনীয় সাহস নিয়ে তার অবিস্মরণীয় বক্তব্যটি রাখেন।

গ্রেটা তার বক্তব্যে শ্রোতাদের লক্ষ করে বলে, ‘ভুল, সবই ভুল। আমার এখানে থাকার কথা নয়। আমার থাকা উচিত ছিল মহাসাগরের ওপর পাশের স্কুলে। এরপরও কী বলবেন, আপনারা তরুণদের জন্য আশা জাগানিয়া কিছু নিয়ে এসেছেন? কী স্পর্ধা আপনাদের! (হাউ ডেয়ার ইউ!)। আপনারা নিষ্ফল কথা দিয়ে আমার স্বপ্নকে ও আমার শৈশবকে চুরি করেছেন। এরপরও আমি একজন সৌভাগ্যবানদের একজন। মানুষ ভোগান্তিতে আছে। মানুষ মরছে। পুরো পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থা (ইকো-সিস্টেম) আজ ধ্বংস হয়ে চলেছে। আমরা আজ অস্তিত্ব সঙ্কটের সূচনার মুখে। আর আপনারা কথা বলছেন অর্থ নিয়ে এবং অন্তহীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে। হাউ ডেয়ার ইউ! ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সায়েন্স ছিল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ, সহজবোধ্য। আপনাদের কী ধৃষ্টতা এ দিকে নজর না দেয়ার। আর আপনারা এখানে আসেন এ কথা বলতে যে, আপনারা যথেষ্ট করছেন। অথচ যে রাজনীতি ও সমাধান প্রয়োজন তা কোথাও এখনো দৃশ্যমান নয়।’ থানবার্গ অত্যন্ত সাহসের সাথে তার বক্তব্যে উল্লেখ করে- ‘যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কার্বন দূষণ সৃষ্টিকারী দেশ। এটি বিশ্বের এক নম্বর তেল উৎপাদক দেশ। এটিই একমাত্র দেশ, যেটি আভাস দিয়েছে প্যারিস ক্লাইমেট অ্যাগ্রিমেন্ট থেকে সরে দাঁড়ানোর, কারণ এটি নাকি একটি বাজে চুক্তি।’

গ্রেটা তার ভাষণের পর আরো ১৫ জন শিশু-কিশোরকে সাথে নিতে আলাদাভাবে জাতিসঙ্ঘে একটি অভিযোগপত্র পেশ করে বিশ্বের পাঁচটি শার্ষস্থানীয় ধনী দেশের বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ, এসব দেশ চলমান জলবায়ু সমস্যা সমাধানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। অভিযুক্ত এ পাঁচটি দেশ হচ্ছে : জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও তুরস্ক। তারা বলে, এসব দেশ বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপকভাবে অনুস্বাক্ষরিত ৩০ বছরের পুরনো মানবাধিকার চুক্তি ‘কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চিলড্রেন’ মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের ‘কমিটি অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড’-এর কাছে পেশ করা এ ধরনের পিটিশন এটাই প্রথম।

বিশেষ করে এরা কমিটির ১৮ জন বিশেষজ্ঞের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে এই আবেদনের বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে তারা যেন সম্মতি প্রকাশ করেন এবং শেষ পর্যন্ত এটুকু দেখাতে যে, জলবায়ুর পরিবর্তন শিশুদের জন্যও একটি মানবাধিকার সঙ্কট। এরা আরো অনুরোধ জানায় উল্লিখিত দেশগুলোর জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় করণীয় সুপারিশ করতে। গ্রেটার উল্লিখিত ভাষণের দিনে ‘আর্থ জাস্টিস’ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া প্রতিটি দেশ অনুস্বাক্ষর করেছে ‘ইউএন কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চিলড্রেন’। এসব দেশের মধ্যে ৪৫টি দেশ একটি অতিরিক্ত প্রটোকলে সম্মত হয়েছে যে, এসব দেশের শিশুরা চুক্তি লঙ্ঘনের ব্যাপারে পিটিশন দাখিলের সুযোগ পাবে। এ ৪৫টি দেশের গ্রুপের মধ্যে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ফ্রান্স, জার্মানি ও তুরস্কও রয়েছে। এসব দেশ এমন কিছু দূষণ নির্গত করছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। এই একটি দেশও পৃথিবীর উষ্ণায়ন মাত্রা দেড় অথবা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার পথে নেই।

এবারের জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু সম্মেলনে শিশু-কিশোররা গোটা বিশ্বে যে নাড়াটি দিলো, তা সত্যিই অভাবনীয়। এর মাধ্যমে এরা প্রমাণ করল ‘চিলড্রেন মে বি ওয়াইজার দেন দেয়ার এল্ডার্স’। বড়রা যা পারেনি, ছোটরা তা করে দেখিয়েছে। এ কথাটি জোরালোভাবে প্রমাণের আরেকটি উদাহরণ আমরা নিকট অতীতে প্রত্যক্ষ করেছি আমাদের দেশের একটি ভিন্নধর্মী আন্দোলনে। গত বছরের একটি অভাবনীয় ও বিস্ময়কর আন্দোলনের কথা হয়তো আমাদের অনেকের মনে আছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সেই আন্দোলনটির সূচনা ঘটেছিল ঢাকায়। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে একই বছরের ৮ আগস্ট পর্যন্ত চলা এই আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন পায়। এ সময় রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থা কার্যত চলে যায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হাতে।

তখন শিক্ষার্থীরা কর্র্তৃপক্ষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সড়কে কী অভাবনীয় মাত্রায় দুর্নীতি চলে; যেখানে তাদের রয়েছে সীমাহীন ব্যর্থতা। এই আন্দোলনের সময় কয়েক দিন স্কুল-কলেজের ছাত্রদের পরিচালনায় রাজধানীর সড়কে যান চলাচলে ফিরে এসেছিল অভাবনীয় মাত্রার শৃঙ্খলা। ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতিতে চলা দুই বাসের চাপায় পড়ে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয়। আহত হয় আরো ১০ শিক্ষার্থী। মূলত এ দুই শিক্ষার্থীর সহপাঠীরা যে বিক্ষোভ-আন্দোলনের সূচনা করে, তাই শেষ পর্যন্ত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিক নেতা হিসেবে খ্যাত তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ দাবিসহ ৯ দফা দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে।

এই দাবি ৯টি ছিল : ১. দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জন্য দায়ী চালককে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে এবং এই শাস্তির বিধান সংবিধানে সংযোজন করতে হবে; ২. দুর্ঘটনার পর করা মন্ত্রী শাজাহান খানের বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের কাছে নিঃশর্ত মাফ চাইতে হবে; ৩. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুট ওভারব্রিজ বা বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে; ৪. প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার দিতে হবে; ৫. সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীর দায়ভার সরকারকে নিতে হবে; ৬. শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে, থামিয়ে তাদের তুলতে হবে; ৭. শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে; ৮. ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকেরা গাড়ি চালাতে পারবে না এবং ৯. বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া যাবে না।

বিশেষজ্ঞরা এসব দাবিকে যৌক্তিক বলে অভিহিত করেন, এমনকি তারা এগুলোকে প্রকৃতপক্ষে নাগরিক অধিকার বলেই মনে করেন। আন্দোলন শেষে আবার যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যখন পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়, পুরনো সেই দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলাও ধীরে ধীরে ফিরে যায়। তবে এই আন্দোলনে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি শিশুদের কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এ ঘটনায়ও প্রতিফলন রয়েছে ‘চিলড্রেন মে বি ওয়াইজার দেন দেয়ার এল্ডার্স’। এ ছাড়া, শিশুরা নানা ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে এ কথাটিই বারবার প্রমাণ করে চলেছে। কিন্তু সেদিকে নজর দেয়ার সময় আমাদের বড়দের কী আছে?


আরো সংবাদ



premium cement