১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সাংবিধানিক পদধারীর দ্বৈত নাগরিকত্ব

-

সাংবিধানিক পদধারী বলতে সাধারণ অর্থে সংবিধানে যেসব পদের বিষয় উল্লেখ রয়েছে সেসব পদকে বুঝায়। তবে বিশেষ অর্থে যেসব পদের নিয়োগ ও যোগ্যতা বিষয়ে সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, সেসব পদকে বুঝায়। সাংবিধানিক পদধারীদের মধ্যে যারা অন্তর্ভুক্ত তারা হলেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ সদস্য, প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপরাপর নির্বাচন কমিশনার, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্ম কমিশনের সভাপতি ও অপরাপর সদস্য।

উপরোল্লিখিত পদধারীরা ছাড়াও অ্যাটর্নি জেনারেল একজন সাংবিধানিক পদধারী, কিন্তু তাদের মতো অ্যাটর্নি জেনারেল শপথের অধীন নন। অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নিয়োগ পান এবং নিয়োগ লাভ-পরবর্তী তিনি রাষ্ট্রপতি বরাবর যোগদানপত্র দাখিল সাপেক্ষে পদে আসীন হন। অ্যাটর্নি জেনারেল ছাড়া অপরাপর সাংবিধানিক পদধারীরা শপথ পাঠ ছাড়া পদে আসীন হন না এবং শপথ পাঠ না করে তাদের কারো পক্ষে পদ সংশ্লেষে কোনো ধরনের দায়িত্ব পালনের অবকাশ নেই।
অ্যাটর্নি জেনারেল ছাড়া সব সাংবিধানিক পদধারীর শপথ নেয়ার সময় অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি ব্যক্ত করতে হয় তারা বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করবেন। আমাদের সংবিধানে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব অযোগ্যতার বিষয় উল্লেখ রয়েছে, তার অন্যতম হলো- কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ অথবা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পোষণ।

এ অযোগ্যতার বিষয়টি সংবিধান প্রণয়নকালীন অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রবর্তনকালীন এ অযোগ্যতাটির সাথে শর্তারোপ করে বলা হয়- উপরোল্লিখিত দফায় যা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে এবং পরবর্তীকালে ওই ব্যক্তিÑ (ক) দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ত্যাগ করলে অথবা (খ) অন্য ক্ষেত্রে পুনরায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে এ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে তিনি বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন বলে গণ্য হবেন না।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্যকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হতে হয়। অপরাপর সাংবিধানিক পদধারীদের ক্ষেত্রে এরূপ যোগ্যতার উল্লেখ না থাকলেও আমাদের নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১-তে (The Citizenship Act, 1951) দ্বৈত নাগরিকত্ব বারিত করা হয়েছে, যদিও বাংলাদেশ নাগরিকত্ব (অস্থায়ী বিধান) আদেশ, ১৯৭২ [The Bangladesh Citizenship (Temporary Provisions) Order, 1972]-এর বিধান অনুযায়ী ইউরোপ অথবা উত্তর আমেরিকা অথবা সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্ধারিত অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের নাগরিককে সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিতে পারে।

নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১-এর ১৪ ধারায় দ্বৈত নাগরিকত্ব অথবা জাতীয়তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১-এর ১৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, এই ধারার বিধানাবলি সাপেক্ষে যদি কোনো ব্যক্তি এ আইনের বিধানাবলির অধীন বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন এবং একই সময়ে অন্য কোনো দেশের নাগরিক বা অধিবাসী হয়ে থাকেন; তিনি যদি না ওই দেশের আইন অনুযায়ী তার নাগরিক অথবা অধিবাসী মর্যাদা পরিত্যাগ করে ঘোষণা প্রদান না করে থাকেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া হতে বিরত হবেন।
উপধারা নং (১)-এ বর্ণিত কোনো কিছুই যার বয়স ২১ বছর অতিক্রম করেনি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
উপধারা নং (১)-এ বর্ণিত কোনো কিছুই যেকোনো ব্যক্তি যিনি যুক্তরাষ্ট্রের (Acceding State) অধিবাসী, যতদূর পর্যন্ত তার ওই রাষ্ট্রের অধিবাসী হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১-এর ১৪ নং ধারায় বর্ণিত দ্বৈত নাগরিকত্ব বারিত সংক্রান্ত বিধানটি বাংলাদেশ নাগরিকত্ব (অস্থায়ী বিধান) আদেশ, ১৯৭২ ২(বি) (২)-এর বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। ওই আইনে ১৯৭৮ ইং সামরিক শাসন বহাল থাকাবস্থায় অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধনী এনে ২(বি) ধারা সন্নিবেশিত করে দফা (২)-এ বলা হয়, ওই আইনের ২ ধারায় এবং বর্তমানে বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, ইউরোপ অথবা উত্তর আমেরিকা অথবা সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উল্লিখিত অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের নাগরিককে সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিতে পারে।

যেহেতু দ্বৈত নাগরিকত্ব বহাল থাকাবস্থায় স্বদেশে অবস্থান না করলে ভোটাধিকার প্রয়োগ অ-আইনানুগ, সেহেতু বিশেষ উদ্দেশ্যে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সৃষ্ট দ্বৈত নাগরিকত্বধারী ব্যক্তিকে সংসদ সদস্যের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন সাংবিধানিক পদ এবং যেকোনো ধরনের সামরিক ও বেসামরিক পদে যোগ্য করা যুক্তিযুক্ত কি না তা বিবেচনার দাবি রাখে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের কারণে বিষয়টি আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।

উচ্চ আদালত অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের অপর সব বিচারকের শপথবাক্যের অন্যতম মূল অংশ বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ। এখন প্রশ্ন- শপথবাক্যে উপরোল্লিখিত অংশ পাঠ-পরবর্তী বিচারপতি বা বিচারক আসনে আসীন হয়ে অন্য কোনো দেশের প্রতি আনুগত্য পোষণকারী বিচারপতি বা বিচারক একই সাথে কি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য অটুট রাখতে পারেন? একজন বিচারপতি বা বিচারককে অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ-পরবর্তী সে দেশের পাসপোর্ট নিতে হলে তাকে অবশ্যই সে দেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করতে হয়। এরূপ ক্ষেত্রে স্বভাবতই যে জটিলতার উদ্ভব হয়, তা হলো অন্য দেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণাকারী একজন বিচারপতি বা বিচারক কি বস্তুনিষ্ঠতার সাথে তার বিচারিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন? তা ছাড়া, এরূপ বিচারপতি বা বিচারকের সম্মুখে যদি তিনি যে দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন, সে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো মামলা বিচারের জন্য উপস্থাপন করা হয়, সেক্ষেত্রে কি তিনি নিরপেক্ষভাবে তার বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারবেন?

বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টে বর্তমানে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশী অনেক রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা বিচারাধীন আছে। কিন্তু বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যে দেশে সংসদ সদস্য হতে হলে দ্বৈত নাগরিকত্ব যেমন বারিত অনুরূপ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার প্রভৃতির ক্ষেত্রেও একইভাবে বারিত। কিন্তু রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ন্যায়বিচারের প্রতীক দেশের জনমানুষের শেষ ভরসাস্থল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বা বিচারক হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্ব কোনো বাধা নয়।

বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধান বিচারপতি বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব যোগ্যতার উল্লেখ রয়েছে, তা হলো ব্যক্তিটিকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং এর অতিরিক্ত সুপ্রিম কোর্টে ১০ বছর ওকালতির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অথবা কোনো বিচার বিভাগীয় পদে ১০ বছর কর্মের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। উপরোল্লিখিত যোগ্যতার পাশাপাশি সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনে নির্ধারিত অন্যান্য যোগ্যতার উল্লেখ থাকলেও সংবিধান প্রণয়ন-পরবর্তী ৪৬ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এরূপ যোগ্যতা নির্ধারণ করে অদ্যাবধি কোনো আইন প্রণীত হয়নি। প্রায় দুই দশক ধরে প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের অপরাপর বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবিশেষ গুরুত্ব পেয়ে আসছে, তা হলো সংশ্লিষ্ট বিচারপতি বা বিচারকের রাজনৈতিক মতাদর্শ। আমাদের উচ্চ আদালতে দ্বৈত নাগরিকত্বধারী বিচারপতি বা বিচারকের সংখ্যা নগণ্য হলেও এরূপ বিচারপতি বা বিচারকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, আদালতের অবকাশকালীন সময়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণকালীন সে দেশের নাগরিক হিসেবে যত ধরনের সুবিধা আছে তা ভোগ করে থাকেন। এভাবে এক দেশের সাংবিধানিক পদধারীর দ্বৈত নাগরিকত্বের আবরণে নিজ দেশ ও নাগরিকত্বধারী দেশের সুবিধা নেয়া কতটুকু নীতিনৈতিকতা ও বিবেকবোধ দিয়ে সমর্থিত? আর উভয় দেশ থেকে এরূপ সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রে অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্যের বিষয়টি পরিমাপেরই বা মাপকাঠি কী?

বাংলাদেশের প্রতিটি সাংবিধানিক পদধারী শপথ গ্রহণকরাকালীন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণের ঘোষণা দেন। এরূপ ঘোষণার পর তার অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে তা নিজ দেশের জন্য কতটুকু অটুট থাকে আর নাগরিকত্ব গ্রহণকারী দেশের জন্য কতটুকু অটুট থাকে তা বিবেচনায় নেয়া হলে হিসাব মেলানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ বাস্তবতায় আমরা কেন জনমানুষের শেষ ভরসাস্থল খ্যাত আমাদের উচ্চ আদালতের সাংবিধানিক পদে আসীন বিচারপতি বা বিচারকদের দ্বৈত নাগরিকত্বের দোলাচলে অযথা বিতর্কের মধ্যে নিপতিত করছি।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement