২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

রোহিঙ্গা ডায়লেমায় কী করবে বাংলাদেশ?

-

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকালে এসে উপনীত হয়েছে। এই সঙ্কটে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের লালন পালনে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে চাপ সৃষ্টিতে যারা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে তারা রয়েছে এক দিকে, আর অন্য দিকে রয়েছে এই সঙ্কটের সমাধানে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে এমন বিশ্ব শক্তি চীন। অথচ বাংলাদেশের উন্নয়ন সহায়তায়, ক্রান্তিকালে স্বাধীনতা বিপন্ন করার মতো আগ্রাসনেও কার্যকরভাবে ঢাকার পাশে থাকতে পারে এই শক্তিটিই।

দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষভাবে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তারের খেলায় এই দুই পক্ষের স্নায়ুযুদ্ধের বিষয়টি এখন কারো অজানা নয়। এই স্নায়ুযুদ্ধের অন্যতম ক্ষেত্র বা লক্ষ্যস্থলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল হয়ে পড়ে কি না, সে আশঙ্কা ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকদের অনেকেরই মধ্যে রয়েছে। কোনো এলাকার প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত অবস্থান যখন আন্তর্জাতিক শক্তির প্রাধান্য বিস্তারের জন্য প্রলোভিত করে তখন সে স্থানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক এই গুরুত্ব সুপ্ত অবস্থা থেকে অনেকখানি প্রকাশ্যে চলে আসে আরাকান অঞ্চল দিয়ে চীনের অর্থনৈতিক করিডোর ও জ্বালানি পাইপলাইন স্থাপনের মহাপরিকল্পনা গ্রহণে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ভিত্তি করে চীন ২০২০ সালের পর থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে- এ বিষয়টি অজানা নয়। এ কারণে প্রাধান্য বিস্তারের খেলায় চীনকে আটকে রাখতে প্রতিপক্ষ শক্তি দাবার এক ছক তৈরি করে। এর অংশ হিসেবে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে চীনের জ্বালানি পরিবহন একসময় হুমকির মুখে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেইজিংয়ের বরাবরই ছিল। এর বিকল্প রুট তৈরির মহা উদ্যোগের একটি হলো গোয়াদর বন্দরের সাথে চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর হয়ে জিংজিয়ান সংযোগ। আর অন্যটি হলো আরাকান উপকূলের কিউকফিউ থেকে আরাকান রাজ্যের ওপর দিয়ে ইউনান হয়ে চীনের অন্য স্থানে যাওয়ার রুট। চীনের মহা অগ্রাধিকারের ‘রুট অ্যান্ড বেল্ট’ প্রকল্পের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এগুলো।

লক্ষ করার বিষয় হলো, চীনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই মহাপ্রকল্পের অবস্থান অঞ্চলে নানাভাবে অস্থিরতায় ইন্ধন দেয়া হচ্ছে। পাকিস্তানে বেলুচ অঞ্চল আর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য এর মধ্যে অন্যতম। এই অস্থিরতা সৃষ্টির মহাপরিকল্পনার কো-ল্যাটারাল ড্যামেজে পরিণত হচ্ছে দুই অঞ্চলের বাসিন্দারা। বেলুচিস্তান বা খাইবার পাখতুন খোয়ার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষভাবে ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন হয়তো সেভাবে নেই। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি সঙ্কটের মধ্যে একটি অন্তর্বর্তী যুগসূত্র থেকে যায়। যেভাবে প্রতিবেশী ভারতের কাশ্মির ও আসাম নীতির মধ্যে একটি গভীর যুগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে।

রোহিঙ্গা ইস্যুকে একটি বিচ্ছিন্ন বিষয় হিসেবে ভাবনার প্রবণতা রয়েছে বাংলাদেশে অনেকের মধ্যে। অথচ এই সঙ্কটের সাথে এই অঞ্চল শুধু নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির একটি সংশ্রব রয়েছে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন দিয়ে অনাগরিক করে যে স্টাইলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে বারবার ঠেলে দেয়ার মাধ্যমে পুরা আরাকান রাজ্যকেই এক ধরনের রোহিঙ্গামুক্ত করা হয়েছে, আসামের এনআরসি নিয়ে আসাম গণপরিষদ ও সহযোগী শক্তিগুলোর সাথে চুক্তি এবং এরপর চূড়ান্ত তালিকা করে ১৯ লাখ লোককে ভারতের অনাগরিক ঘোষণার সাথে মোটা দাগে তার মিল রয়েছে। মিয়ানমার আর বাংলাদেশের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য থাকায় দেশটি হুমকি বা ভয় দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাতে পারেনি। এজন্য রোহিঙ্গাদের ওপর বারবার গণহত্যা ও ধর্ষণ অগ্নিসংযোগের বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করে মিয়ানমারকে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিতে হয়েছে।

অন্য দিকে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় শক্তির সেই ভারসাম্য নেই। ফলে নয়া দিল্লির বিজেপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, আসামের ১৭ লাখ বাংলাভাষী অনাগরিক ঘোষিত ব্যক্তিদের ধমক দিয়ে বা সামরিক শক্তির ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়া যাবে। শুধু তাই নয়, একই সাথে নিরাপত্তার নাম করে বাংলাদেশের ভেতরেই আসামের এসব অধিবাসীর জন্য নিরাপদ অঞ্চল গঠনের দাবিও উত্থাপন করা যাবে। ভারতীয় মিডিয়ার খবর অনুসারে, দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শাসক দলের প্রধান অমিত শাহ আসামের সভাগুলোতে ১৯ লাখ লোককে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, দিল্লিতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সময়ও একই বার্তা দিয়েছেন অমিত শাহ। আসামের অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যেও তার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।

বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে করণীয় ঠিক করার সময় আসাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, এমনকি রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়টিকেও সামনে রাখতে হবে। একটি রাষ্ট্রে সরকার আসে এবং বিদায় নেয়। কিন্তু সার্বভৌমত্ব বা অখণ্ডতা আসা-যাওয়ার বিষয় নয়। এ বিষয়টিকে সামনে রেখে ’৭০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের নিরাপত্তা মতবাদ তৈরি করা হয়েছিল। এমনকি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সাথে যে ৭ দফা গোপন চুক্তি স্বাক্ষরের কথা বলা হয়, তা থেকে বঙ্গবন্ধুর সরকার কার্যকরভাবে সরে এসেছিলেন। আর এই বিষয়টি বাংলাদেশের নিরাপত্তা মতবাদের প্রধান ভিত্তি ছিল। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বঙ্গবন্ধু পৃথক রক্ষীবাহিনী তৈরি করলেও সশস্ত্র বাহিনীর কাঠামোর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন এবং পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক কর্মকর্তাদের সশস্ত্র বাহিনীতে একীভূত করেছেন। বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসনের বিন্যাসের জন্য ভারতীয় আমলাদের তিনি নিয়ে আসেননি।

বাংলাদেশ পুনর্গঠনের সব কাজে বা প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনায় তিনি প্রতিবেশী দেশের পরামর্শ প্রার্থনা করেননি। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকায় আমন্ত্রণ করে এনেছেন এবং ওআইসির সম্মেলনে যোগ দিতে ইসলামাবাদ গেছেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ একজন আমলা ব্যক্তিগত আলাপকালে বলেছেন, বাংলাদেশ যাতে স্থায়ীভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারে সেজন্য প্রতিবেশী দেশের সাথে বোঝাপড়া ও সুসম্পর্ক রক্ষা করেই অন্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি কঠোরভাবে না চাইলে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করত কি না সন্দেহ রয়েছে। এমনকি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেননি এমন দেশগুলোর সাথেও তিনি কৌশলগত সহাবস্থানের সম্পর্ক নির্মাণ করেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র কৌশলের শিক্ষাটি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের সরকার এবং ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর নিরাপত্তা ডকট্রিন বা মতবাদ থেকে নেয়া প্রয়োজন বলে এখন বিশেষভাবে মনে হচ্ছে। এই ডকট্রিনের একটি দিক হলো, বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে চিরস্থায়ী করতে হলে এখানে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর এমন স্বার্থ তৈরি করতে হবে, যাতে সেসব দেশের স্বার্থের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের যোগসূত্র থাকে। বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগই সেই স্বার্থ সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ এবং চীনের কাছে ২৬ বিলিয়ন ডলারের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প সহায়তা গ্রহণ, এমনকি বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা সরবরাহের সাথে চীন-রাশিয়া বা পাশ্চাত্যের দেশগুলোর স্বার্থসংশ্লিষ্টতা তৈরি- এই নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ধরনের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা তৈরি হলে কোনো শক্তি বাংলাদেশের ওপর দখল-থাবা বিস্তার অথবা স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে চাইলে তারা নিজের স্বার্থেই পাশে এসে দাঁড়াবে।

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা মতবাদের এই বিষয়টিকে সামনে রাখতে হবে। বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধ না করে রোহিঙ্গা সঙ্কটের দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর সমাধান চাইছে। দেশটি মিয়ানমারের ওপর অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রাধান্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঢাকার অনেক বেশি অগ্রাধিকারের কিছু বিষয় রয়েছে।
প্রতিটি জাতির পরিস্থিতি, নীতি এবং কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির আলাদা কিছু বিষয় থাকে। বাংলাদেশ নিজেরই দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় দেশ হওয়ার একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। শীর্ষ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ হিসেবে অর্থনৈতিক উত্থানের ক্ষেত্রে এটি ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো থেকে এগিয়ে গেছে। সরকারি হিসাব অনুসারে, গত দশকে জিডিপির ১৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সরকার সেই গতিটি বজায় রাখতে এবং এটি শতাব্দীর মধ্যভাগে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায়।

বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা বিশ্বাস করেন, মিয়ানমারের সাথে একটি যুদ্ধ অর্থনীতিকে কমপক্ষে পাঁচ বছরের জন্য পিছিয়ে দেবে। আর প্রশ্ন হতে পারে, কিসের জন্য বাংলাদেশ এটি করতে যাবে? তারা এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যার ভিত্তি হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। সেই ধারণা অনুসারে বলা যেতে পারে, রোহিঙ্গাদের আয়োজক হওয়ার যে মূল্য তা এই সময়ে প্রতিবেশী দেশটির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে যাওয়ার চেয়ে অনেক কম মূল্যদায়ক। ১২ লাখ মিয়ানমার নাগরিককে সীমিত ভূমিসম্পদ সত্ত্বেও আশ্রয় দেয়া এবং কক্সবাজার বেল্টে স্থানীয় সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক জীবনযাপন ত্যাগের জন্য বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের, বন্ধু দেশগুলোর এবং বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পেরেছে। এ সময় মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে দেয়া উচিত। এতে শেষ পর্যন্ত বলটি মিয়ানমারের আদালতেই থাকবে। আর দেশটি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাইবে নাকি বিদেশী হস্তক্ষেপের ঝুঁকির মধ্যে থাকবে- সে সিদ্ধান্ত তাদের নিতে হবে। বাংলাদেশ মিয়ানমারকে সরকারি বাহিনী এবং আরাকান আর্মিসহ রাখাইন সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাত থেকে রক্ষার জন্য উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল গঠনের পরামর্শ দিয়েছে।

মিয়ানমারে চীনাদের দীর্ঘমেয়াদি আগ্রহ রয়েছে যার মধ্যে নিরাপত্তা, জ্বালানি এবং রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। বাংলাদেশে তার স্বার্থ হুমকির মুখোমুখি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে যেকোনো সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করার জন্য বেইজিং ঢাকাকে অনুরোধ করেছে। বিনিময়ে চীন নিজস্ব পদ্ধতি অনুসারে সঙ্কট সমাধানের জন্য কাজ করছে। জাপানের মতো অন্যান্য কিছু দেশও বাংলাদেশকে আরো কিছু সময় ধৈর্য ধরে রাখতে বলেছে। বলা হয়, অন্য বিকল্পগুলো যদি নিঃশ্বেস হয়ে যায় তবেই বাংলাদেশ সত্যিকারের যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। জাপানের মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরসহ ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। আর এই অ্যানার্জি হাব নিয়ে তাদের গভীর উদ্বেগও রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে চীনের অনুসৃত পদ্ধতিটি সফল হয় কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে হবে এবং আপাতত তাদের কারণে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের কোনো চাপ নেই। কক্সবাজারের ত্যাগ বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ত্যাগ, যা দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে বেশ বড় কিন্তু যুদ্ধের নানামুখী ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার তুলনায় এটি তুচ্ছ।

আসামের এনআরসি এবং তা গোটা ভারতে ছড়িয়ে দিয়ে অনাগরিক ব্যক্তিদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার হুমকি আর রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর ঘটনা গভীরভাবে দেখলে বাংলাদেশের ওপর ভবিষ্যৎ হুমকি এই দু’দিক থেকেই আসার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে হয়। শক্তি বিবেচনায় এই দুই শক্তির মধ্যে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের অবস্থান একই স্তরে। কিন্তু ভারতের সাথে শক্তির ভারসাম্যে ব্যবধান অনেক বেশি। কূটনৈতিক অংশীদার দেশগুলোর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান তথা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকারসহ প্রত্যাবাসনের মধ্যে বাংলাদেশের স্বার্থ অধিক রক্ষিত হতে পারে। বাংলাদেশ ইচ্ছা করলে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের সাথে সামরিক সঙ্ঘাতে যেতে পারে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনা অবলোকন করলে দেখা যাবে- মিয়ানমার-বাংলাদেশ সঙ্ঘাতে দিল্লি মিয়ানমারকেই সমর্থন করেছে। আর চীনের স্বার্থ ও অতীত সম্পর্ক মিয়ানমারের তুলনায় বাংলাদেশের সাথে কম। দু’দেশের সাথে এ ধরনের সঙ্ঘাতে কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগী দেশগুলো আর ওআইসিভুক্ত বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের পাশে থাকতে পারে। এ সমর্থন বাংলাদেশের সামরিকভাবে বিজয়ী হওয়ার জন্য কতটা পর্যাপ্ত তা বিচার বিশ্লেষণের বিষয়।

বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের অনুকূল সময় রয়েছে। দেশের অর্থনীতি এখন ক্রমবিকাশমান। এ মুহূর্তে কোনো অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা বা অন্যান্য জাতির সাথে বাহ্যিক বিরোধ নেই। সামরিক বাহিনীর বিকাশের জন্য সময় এবং আর্থিক ব্যাকআপ রয়েছে। কোনো প্রভাবের কাছে বন্দী না হলে ২০৪০ এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী উল্লেখ করার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। পারমাণবিক সশস্ত্র দেশ ছাড়া এ সময় নাগাদ খুব কম দেশই হয়তোবা বাংলাদেশের সমান সম্পদ অর্জন করবে। এই সময়ে মিয়ানমারের ব্যর্থ শাসনব্যবস্থার কোনো উসকানিতে পা দেয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশকে দীর্ঘ সময়ের খেলার ধৈর্য রাখতে হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধের ফলে ভারত উপকৃত হবে। এটি চীন ও জাপানের মতো বাংলাদেশের বন্ধুদের জন্যও বিপর্যয়কর হবে। ভারতের বিপক্ষে ভারসাম্যহীনতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে এখনো চীনকে পাশে পাওয়া দরকার। এ কারণে বাংলাদেশের গেম পরিকল্পনা সর্বদা স্মার্ট হওয়া উচিত। দেশটি মিয়ানমারের মতো ব্যর্থ অথবা পাকিস্তানের মতো মরিয়া রাষ্ট্র হয়ে ওঠার অবস্থানে নেই।

যেকোনো রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা কৌশল ও পররাষ্ট্র সম্পর্ক নির্ধারণে আবেগ অনুভূতিকে একমাত্র নিয়ামকে পরিণত করা হলে বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে দেখা দিতে পারে। রোহিঙ্গা ইস্যুটির সমাধান আর রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণের এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণের বিষয়টিকে নীতিনির্ধারকদের বিশেষভাবে সামনে রাখতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সব নাগরিককে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে নিশ্চিত করতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা। ভারত-মিয়ানমার সম্পর্কের বিশেষ বন্ধন ঠেকাতে চীনের সাথে বৃহত্তর নিরাপত্তা সহযোগিতার উন্নয়ন করতে হবে। সেই সাথে ভারত ও মিয়ানমারের হুমকি মোকাবেলায় একটি স্থিতিশীল সামরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে হবে। মাদক চোরাচালানের মতো অপরাধ প্রতিরোধে মিয়ানমারসংলগ্ন অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। ইন্দোনেশিয়া অথবা সুদানের মতো ভুল করলে এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড হারানোর মতো মাশুল দেয়ার দৃষ্টান্তগুলোকে নীতিকৌশল প্রণয়নের সময় অবশ্যই সামনে রাখতে হবে।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
সীমান্তে বাংলাদেশীদের মৃত্যু কমেছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাস্তি কমিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনে উদ্বেগ টিআইবির যখন দলকে আর সহযোগিতা করতে পারবো না তখন অবসরে যাবো : মেসি ইভ্যালির রাসেল-শামীমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেম্যান আর নেই বিএনপি নেতাকর্মীদের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ খণ্ডালেন ওবায়দুল কাদের আটকের পর নাশকতা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলো ইউপি চেয়ারম্যানকে বদর যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন পণবন্দী জাহাজ ও ক্রুদের মুক্ত করার প্রচেষ্টায় অগ্রগতি হয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঝালকাঠিতে নিখোঁজের ২ দিন পর নদীতে মিলল ভ্যানচালকের লাশ বাল্টিমোর সেতু ভেঙে নদীতে পড়া ট্রাক থেকে ২ জনের লাশ উদ্ধার

সকল