ব্যাংকের তহবিল ব্যয় কমাতে পারে যে ব্যবস্থা
- প্রফেসর ড. এম এ মান্নান
- ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২০:৩৬, আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২০:৫৫
আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর ‘কস্ট অব ফান্ড’ বা তহবিল ব্যয় কমিয়ে আনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন একটি ফর্মুলা তৈরি করতে যাচ্ছে বলে পত্রিকার খবরে প্রকাশ হয়েছে। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেন, তার অতিরিক্ত যে অর্থ তারা ব্যাংককে পরিশোধ করেন সেটিই হলো তহবিল ব্যয়। একেক ব্যাংক একেকভাবে এ ব্যয় হিসাব করে বলে এর স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগটি নিয়েছে হিসাবে অভিন্নতা নিয়ে আসার জন্য। ব্যাংকগুলো যেন তহবিল ব্যয় সিঙ্গেল ডিজিট তথা ৯ শতাংশের মধ্যে রাখতে পারে, তার জন্য এটা করা হচ্ছে।
‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ মানে সরকার। তবে বিদ্যমান ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তহবিল ব্যয় ৯ শতাংশের মধ্যে রাখতে সরকারের নির্দেশ বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। হয়তো দেশের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, তহবিল ব্যয় ৯ শতাংশের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে সেটি বাস্তবায়নের চেষ্টাও করা হতে পারে। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেয়া যায় না। চাহিদা ও সরবরাহ সব কিছু নির্ধারণ করবে। অন্য দিকে, রাষ্ট্র পরিচালকেরা চান অর্থনীতিকে সুষ্ঠুভাবে চালাতে। তাই তহবিল ব্যয় কমানোর চিন্তা তাদের মনে উদয় হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
১৯৪০-এর দশকে অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইনসও এটা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছেন, অর্থনীতিকে যদি সুষ্ঠুভাবে চালাতে হয় তাহলে ‘কস্ট অব ফান্ড’ জিরোতে নিয়ে আসতে হবে। কোনো সম্পদকে অব্যবহৃত রাখা যাবে না। বিষয়টি এমন : ‘কস্ট অব ফান্ড’ যদি ৯ শতাংশ হয় তাহলে যে সম্পদ থেকে ৮ শতাংশ মুনাফা বা লাভ পাওয়া যাবে সেখানে কেউ বিনিয়োগ করবে না। ৯ শতাংশ সুদে টাকা নিয়ে তাকে ১২, ১৩ বা ১৪ শতাংশ লাভ করতে হবে। অর্থাৎ ৯ শতাংশের নিচে লাভ হয়- এমন সম্পদগুলো অব্যবহৃত থেকে যাবে। এটা অর্থনীতির সূত্র। আর সে কারণেই কেইনস অর্থনীতিকে সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য ‘কস্ট অব ফান্ড’ শূন্য হারে নামিয়ে আনার কথা বলেছিলেন।
কিন্তু উপায়টি কী? এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমি তো মনে করি ৯ শতাংশ কেন, তারও নিচে নামিয়ে আনা যেতে পারে। খুব সহজে- যদি শুধু সার্ভিস চার্জ নিয়ে আমরা ঋণ দিতে পারি। এর জন্য ব্যাংকিং সিস্টেমকে ব্যবসায় যেতে হবে। মানে, ব্যাংককে ব্যবসার অংশীদার হতে হবে।
কেইনসের উপলব্ধির অনেক আগে, প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আল কুরআন সুনির্দিষ্টভাবে বলে দিয়েছে ‘ব্যবসা হালাল, সুদ হারাম’। কেইনস ইসলামী অর্থনীতির কথা বলেননি, কিন্তু সুদের হার শূন্য করার কথা বলেছেন। ‘অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি’তে (participatory economy) এটা সম্ভব।
আজকে আমরা যখন মানবকল্যাণ, মানবাধিকার- এসব কথা বলি তখন ইসলামের অর্থনৈতিক বিধানগুলোর মানবিক দিক কাউকে আকৃষ্ট না করে পারে না। যতটুকু পড়ালেখা করেছি তাতে বুঝেছি, ইসলামে যেসব স্বেচ্ছাসেবক খাতের কথা বলা হয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর ‘কস্ট অব ফান্ড’ কমিয়ে আনার একটি টেকসই (viable) মডেল দেয়া যেতে পারে। ওআইসির সাবেক মহাসচিব ড. হামিদ আল গাবিদ ২০১২ সালে বাংলাদেশে সফরে আসার পর তার সঙ্গী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে এনজিওগুলোর কাছে ঋণগ্রস্ত প্রায় চার কোটি মহিলা, যারা দেশের জনসংখ্যার প্রায় এক-চুতর্থাংশ, তাদের ঋণ মাফ করে দেয়ার প্রস্তাব করতে বলেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন, এটা কিভাবে সম্ভব? বলেছি, স্বেচ্ছাসেবামূলক (াড়ষঁহঃধৎু) খাতকে পুনরুজ্জীবিত করে এটা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলমান। তাদের কাছে জাকাত, সাদাকাহ্, ওয়াক্ফ, ইত্যাদি পরিভাষাগুলো খুবই পরিচিত। জাকাত দিয়ে ঋণগ্রস্তকে ঋণমুক্ত করা যায়। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে যে কেউ এই সুবিধা পেতে পারেন। এটা ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য।
ইসলামে নিষিদ্ধ যে সুদ, তা যখন আজকে আমাদের গ্রামগুলোকে ছেয়ে ফেলেছে তখন এই স্বেচ্ছাসেবা খাতগুলো জোরদার করে আমরা সুদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারি। আমরা যে অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতির কথা বলছি সেখানে গ্রামের মানুষ যদি এমনকি রোটেটিং সেভিংস স্কিমও করে তাহলে তাদেরকে সুদনির্ভর এনজিওগুলোর কাছে যেতে হয় না। রোটেটিং সেভিংস স্কিম থেকে ভারতে ব্যাংক পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এই অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতির অংশ হিসেবে অনেক দিন ধরে ওয়াক্ফ, বিশেষ করে ক্যাশ ওয়াক্ফের কথা বলে আসছি। ওয়াক্ফের সম্পদ চিরস্থায়ী (perpetual)। আল্লাহর নামে যে সম্পদ ওয়াক্ফ করা হয়েছে সেটি বিনষ্ট করা যায় না। ইসলামের সব শরিয়াহ বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে একমত যে, ওয়াক্ফ হবে চিরস্থায়ী। একসময় মুসলিম বিশ্বে ওয়াক্ফ করার মতো স্থাবর সম্পত্তির সঙ্কট দেখা দিলে তখন প্রথমে তুরস্কের অটোমানরা ক্যাশ ওয়াক্ফের ধারণা নিয়ে আসেন। তারা ক্যাশ ওয়াক্ফের ধারণা দিলেও ইসলামী ব্যবহারশাস্ত্রে (jurisprudence) এর সঠিক প্রয়োগ করতে পারেননি। ফলে ধারণাটি আর অগ্রসর হয়নি।
আমি ১৯৮২ থেকে ক্যাশ ওয়াক্ফের কথা বলে আসছি। এর প্রায় ২০ বছর পর এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। আর সেটি করতে গিয়ে ক্যাশ ওয়াক্ফ সার্টিফিকেট প্রবর্তন করেছি। ১৯৯৭ সালে ক্যাশ ওয়াক্ফ সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। মূলত এর পর থেকেই বিশ্বব্যাপী এটা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশে ছয়টি ইসলামী ব্যাংক ক্যাশ ওয়াক্ফ প্রবর্তন রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের ইসলামী ব্যাংক এটা প্রবর্তন করেছে। ক্যাশ ওয়াক্ফকে সহজেই গণ-আন্দোলনে রূপ দেয়া যেতে পারে। কারণ এতে কোটিপতি থেকে শুরু করে একজন সাধারণ গৃহকর্মী পর্যন্ত অংশ নিতে পারেন।
সঠিক মেকানিজম তৈরি না করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জোর করে একটি রেট বা হার চাপিয়ে দিলে কোনো ব্যাংক টিকে থাকতে পারবে না। আর ব্যাংকগুলো ‘মারা গেলে’ রাষ্ট্রও টিকতে পারে না। ব্যাংকের পক্ষে সরকারের এই সিদ্ধান্ত মানা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। ব্যাংক যদি একটি স্থায়ী আমানত পায়, তাহলে শুধু সার্ভিস চার্জ নিয়ে ঋণ দিতে অসুবিধা কোথায়? কোন ব্যাংকে সেই স্থায়ী আমানত দিতে পারে ‘ক্যাশ ওয়াক্ফ’। স্বেচ্ছাসেবক খাতগুলো প্রমোট করলে একটি ব্যাংক শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে না, সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও কাজ করবে। এভাবে করপোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটিও পালন করা হবে।
সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে চেয়ারম্যান থাকাকালে ওয়াক্ফ প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ক্যাশ ওয়াক্ফ সার্টিফিকেট, ফ্যামিলি ওয়াক্ফ সার্টিফিকেট, মস্ক প্রপার্টি ডেভলপমেন্ট বন্ড, মস্ক কমিউনিটি শেয়ারিং, কর্জে হাসানা- এসব স্বেচ্ছাসেবক খাতের উদ্যোগ নিয়েছি। এসব খাত থেকে বিপুল অর্থের জোগান ঘটতে পারে। এগুলো পারপিচুয়াল ফান্ড। ব্যাংক এ ফান্ড বিনিয়োগ করবে। কোনো ব্যাংক যদি এ ধরনের এক শ’ কোটি টাকার তহবিল গঠন করতে পারে, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তার ‘কস্ট অব ফান্ড’ কমে যাবে। আমাদের দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর কাছে ক্যাশ ওয়াক্ফ বা অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক খাতের চিরস্থায়ী আমানত থাকার কারণেই তাদের পক্ষে সাধারণ ব্যাংকগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি লভ্যাংশ দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
তবে এই অংশগ্রহণমূলক ব্যাংকিংয়ের জন্য নতুন আইন তৈরি করতে হবে। ইসলামের মূল্যবোধগুলো গ্রহণ করার জন্য সব কিছুর যে ‘ইসলামী নামকরণ’ করতে হবে, তার কোনো মানে নেই। সুদের ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনীহা রয়েছে। তিনি চাইলে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে, দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার তার যে স্বপ্ন তিনি দেখছেন তার স্বার্থে, এ আইন তিনি করতে পারেন। তিনি ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছেন। এমন একটি উদ্যোগ নিয়ে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার সুযোগ তার সামনে তৈরি হয়েছে। এ ধরনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা গ্রহণের ক্ষমতাও তার রয়েছে বলে আমি মনে করি। এটা করা গেলে ‘কস্ট অব ফান্ড’-এর সুদ ৯ শতাংশ নির্ধারণ কেন, পুরোপুরি সুদমুক্ত অর্থনীতিও তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা