২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ব্রেক্সিট নিয়ে সঙ্কটে ব্রিটেন, বিভক্ত জাতি

ব্রেক্সিট নিয়ে সঙ্কটে ব্রিটেন, বিভক্ত জাতি - ছবি : সংগ্রহ

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসা, অর্থাৎ ব্রেক্সিট প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়েছে পুরো ব্রিটিশ জাতি। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সাথে চুক্তি ছাড়াই যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ ঘটানোর যে বেপরোয়া পথ বেছে নিয়েছেন, তা ঠেকাতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন বিরোধীরা। এমনকি ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলেরও প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন রাজনীতিক বিরোধী দলের এ উদ্যোগে সমর্থন দিয়েছেন।

চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট কার্যকর করার প্রয়াস যাতে জনসন বিরোধীরা ব্যর্থ করে দিতে না পারেন, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত পার্লামেন্ট স্থগিত রাখার অভাবনীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যে সময় দেশটি ব্রেক্সিট ইস্যুতে চরম সঙ্কটের মুখে রয়েছে, সেই মুহূর্তে পার্লামেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ বেশির ভাগ ব্রিটেনবাসী। তারা জনসনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভে অংশ নিয়ে ম্যানচেস্টার, লিডস, ইয়র্ক ও বেলফাস্টের রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার মানুষ। বিক্ষোভের কারণে সেন্ট্রাল লন্ডনে অনেক জায়গায় জীবন যাত্রা স্থবির হয়ে যায়। ইউরোপে এ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। বিক্ষোভকারীরা, ‘বরিস জনসন, ধিক্কার জানাই’ বলে স্লোগান দেন। এডিনবার্গ, ক্যামব্রিজ, এক্সেটার, নটিংহ্যাম, লিভারপুল, বার্মিংহামসহ যুক্তরাজ্যের ৩০টি শহরে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। পুরো ইউরোপের পত্রপত্রিকা পার্লামেন্ট স্থগিত করার বিষয়টিকে ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক জালিয়াতি এবং ওই দিনটিকে ‘ব্রিটিশ গণতন্ত্রের জন্য কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেছে।

পার্লামেন্ট স্থগিত করার ঘোষণা দেয়ার পর এমপি ও বিরোধীদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন বরিস জনসন। ১০ সেপ্টেম্বরের আগে অর্থাৎ ৩ তারিখ থেকে ৯ তারিখের মধ্যে বিরোধী দলগুলো যদি প্রধানমন্ত্রীর এ স্থগিতাদেশ রোধ করতে সক্ষম হয় তাহলে ভিন্ন কথা। তা না হলে ২৩ কর্মদিবস বন্ধ থাকবে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। তার মানে হলো, ৩১ অক্টোবরের আগে ব্রেক্সিটের বিষয়ে কোনো চুক্তিতে পৌঁছার এবং তা বিবেচনার জন্য মাত্র ১৭ দিন সময় পাবে সরকার ও পার্লামেন্ট। ৩১ অক্টোবর ব্রেক্সিট সম্পন্ন হবে; সেটা চুক্তি করেই হোক বা চুক্তি ছাড়া।

ব্রিটেনের বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, পার্লামেন্টকে পাশ কাটিয়ে ইইউর সাথে চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদ ঘটাতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটি একটি ‘সাংবিধানিক অভ্যুত্থান’। তবে গ্রীষ্মের ছুটি শেষে গতকাল মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হয়েছে। এরপর ১০ সেপ্টেম্বর সরকার পার্লামেন্ট স্থগিত করার আগেই চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদ ঠেকাতে আইন প্রণয়নের কৌশল নিয়েছে বিরোধী দলগুলো। এ জন্য প্রয়োজনে রাতভর অধিবেশন কিংবা আগামী শনি ও রোববার (সাপ্তাহিক ছুটির দিন) অধিবেশন চালু রাখার বিষয়টি বিবেচনা করছেন তারা।

বিরোধী দল ও লেবার পার্টি নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, মঙ্গলবারই পার্লামেন্ট স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। প্রয়োজনে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে বলে জানান তিনি।
ক্ষমতাসীন দলের আইনপ্রণেতা ও সদ্য সাবেক বিচারবিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড গোক বিরোধীদের উদ্যোগে সমর্থন দিয়ে বলেছেন, যা করার পার্লামেন্ট স্থগিত হওয়ার আগেই করতে হবে। আর প্রবীণ রাজনীতিক কেন ক্লেয়ার্ক জানান, তিনি করবিনের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কাজ করতে রাজি। সদ্য সাবেক চ্যান্সেলর ফিলিপ হ্যামন্ড এবং অলিভার লেটউইনসহ কনজারভেটিভ দলের আরো বেশ কয়েকজন আইনপ্রণেতা চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদ ঠেকাতে সরকারের বিরোধীদের প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছেন। এ ছাড়া বরিসের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন হাউস অব লর্ডসের হুইপ জর্জ ইয়ং এবং স্কটল্যান্ডের কনজারভেটিভ দলের প্রধান রুথ ডেভিডসন।

জনসনের প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ খুব দীর্ঘ হবে না- এমনটাই সবাই ধরে রেখেছেন। পার্লামেন্ট স্থগিত করার সূত্র ধরে যদি অনাস্থা প্রস্তাব ওঠে তাহলে জনসনের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপিদের সমর্থন পাওয়ার মতো জনপ্রিয়তা জনসনের কখনোই ছিল না। তিনি নির্বাচিতও হয়েছেন খুব সামান্য ভোটের ব্যবধানে।

এদিকে ব্রেক্সিটবিরোধী প্রচারক জিনা মিলার পার্লামেন্ট স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে জুডিশিয়াল রিভিউর আবেদন করেছেন। সে আবেদন আমলে নিয়েছেন আদালত। শিগগির এ বিষয়ে শুনানি হবে। কনজারভেটিভ দলীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজর এ আইনি লড়াইয়ে মিলারের সাথে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।
এত বিরোধিতা সত্ত্বেও আগামী ৩১ অক্টোবর বিচ্ছেদ কার্যকর করায় অটল প্রধানমন্ত্রী জনসন। তিনি বলেন, ইইউর সাথে চুক্তি সম্পাদনে চেষ্টার ত্রুটি রাখা হবে না। তবে চুক্তি না হলেও নির্ধারিত দিনেই বিচ্ছেদ ঘটবে।

আমরা জানি, ২০১৬ সালের ২৩ জুন ব্রেক্সিট প্রশ্নে গণভোট হয়েছিল যুক্তরাজ্যে। সেখানে ৫২ শতাংশ ভোট পড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে, আর এতে থাকার পক্ষে ছিল ৪৮ শতাংশ ভোট। তার মানে হলো পক্ষে-বিপক্ষে বিপুল জনসমর্থন শুরু থেকেই ছিল। গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় আসার পর কিভাবে বেরিয়ে আসার কাজটি সম্পন্ন হবে সে বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। তখনই উভয়ের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদন করা হয়। ‘প্রত্যাহার চুক্তি’ নামে পরিচিত ওই চুক্তি অনুযায়ী ইইউ থেকে বের হতে হলে ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্যকে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার দিতে হবে ইইউকে।

যুক্তরাজ্যের যেসব নাগরিক ইইউভুক্ত দেশগুলোতে রয়েছেন তাদের এবং যুক্তরাজ্যে ইইউভুক্ত দেশগুলোর যেসব নাগরিক রয়েছেন তাদের কী হবে, উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রের মাঝামাঝি ইইউ এবং যুক্তরাজ্যের সীমানা কিভাবে নির্ধারণ করা হবে, প্রভৃতি বিষয় নির্ধারণের জন্য চুক্তিতে যুক্তরাজ্য এবং ইইউকে একটি নির্দিষ্ট ‘অন্তর্বর্তীকালীন সময়’ দেয়া হয়েছে যেন তারা একটি বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছাতে এবং নিজেদের ব্যবসায়-বাণিজ্য বুঝে নিতে পারেন।

এ ছাড়া দুই পক্ষের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হতে পারে- সে বিষয়ে একটি রাজনৈতিক ঘোষণা আছে এই চুক্তিতে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে যুক্তরাজ্য এবং ইইউ এই চুক্তিতে উপনীত হয়। তবে তা কার্যকর করা যায়নি। কার্যকর করতে হলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনুমোদন লাগবে। ব্রিটিশ এমপিরা চুক্তির বিষয়ে একমত হতে পারেননি। পরপর তিনবার তারা এই চুক্তির বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন।

জনমতের যা অবস্থা, তাতে জনসন পার্লামেন্টে চুক্তিটি পাস করাতে পারবেন না, সেটা ভালো করেই জানেন। সেজন্যই তিনি প্রয়োজনে চুক্তি ছাড়াই বেরিয়ে আসতে চান। কেবল মুখ রক্ষার জন্য বলছেন যে, ইইউর সাথে সমঝোতায় পৌঁছাতে চেষ্টার ত্রুটি করা হবে না।

কিন্তু, সঙ্কট জনসনের পিছু ছাড়বে না। চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিটের অর্থ হলো, এতবড় একটি পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে দেশটির বিভিন্ন খাত ও জনগণকে কিছুটা সামলে নেয়ার সুযোগও না থাকা। তখন দেশটিকে রাতারাতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রাবাজার ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানিতে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত যুক্তরাজ্য, সেটি আর তারা পাবেন না। ইইউ সদস্য দেশগুলো থেকে এতদিন আমদানি হতো, এমন পণ্যের ওপর কর বসবে এবং সেজন্য যুক্তরাজ্যে তার দাম বেড়ে যাবে। ফলে ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্য জীবনযাত্রা কঠিনতর হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ভিসামুক্ত যাতায়াতের সুবিধা এবং চিকিৎসার সুবিধাও হারাবেন যুক্তরাজ্যের নাগরিকেরা।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের যেসব সংস্থার সাথে যুক্তরাজ্য সম্পর্কিত; যেমন, ইউরোপিয়ান আদালত বা ইউরোপিয়ান পুলিশ, এ রকম অনেক সংস্থা থেকে যুক্তরাজ্যকে বের হয়ে আসতে হবে। বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট হলে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশটিতে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে বলেও তারা মনে করেন। জনজীবনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে ইইউর সদস্য হিসেবে এই সংস্থার বাজেটে যুক্তরাজ্য বছরে যে ৯০০ কোটি পাউন্ড চাঁদা দেয়, সেটা আর দিতে হবে না।

আমাদের বিবেচনায়, পুরো ইউরোপ থেকে নিজেদের বিনা কারণে একঘরে করে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে যেন যুক্তরাজ্য। এতে করে বিশ্বের আর্থ-রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্রিটেনের ভাবমর্যাদা বা অবস্থানের অবনতি অবশ্যম্ভাবী। একসময়ের বিশ্ব নেতা হিসেবে ইংরেজদের মনের গহিনে যে আত্মগর্ব ও অহংবোধ চাপা পড়ে আছে সম্ভবত সেটিই ব্রেক্সিটের রূপ ধরে বেরিয়ে এসেছে।

যা হোক, বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এখন যদি কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই হঠাৎ বিদায় নেয়ার সম্ভাবনা এড়াতে হয় তাহলে দেশটির বিচ্ছেদের ব্যাপারে পরিকল্পনা নিয়ে পার্লামেন্টে নতুন আইন পাস করতে হবে; ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে সময় নিতে সমর্থ হতে হবে অথবা ব্রেক্সিট বাতিল করতে হবে।
ওদিকে, ইউরোপীয় কমিশনের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অরসুলা ফন ডার লায়েন নভেম্বরের ১ তারিখ দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, ব্রেক্সিটের জন্য সময় দেয়ার ব্যাপারে তিনি সমর্থন দেবেন। তবে ‘প্রত্যাহার চুক্তি’ নিয়ে নতুন কোনো আলাপ হবে না। ইইউর বিদায়ী প্রেসিডেন্ট (এখনো দায়িত্বে আছেন) জ্যঁ ক্লদ জাঙ্কার বলেন, ব্রেক্সিট সমঝোতায় ইইউ সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু দেয়ার সুযোগ নেই। ব্রেক্সিট নিয়ে ইইউর সমঝোতাকারী মাইকেল বার্নিয়ার বরিস জনসনের ব্রেক্সিট নীতিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছেন।

আমাদের ধারণা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম ব্রিটিশ জাতি তাদের সবচেয়ে গুরুতর জাতীয় সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে। সুতরাং জনসন ক্ষমতায় টিকলেন কিনা, সেটি কোনো গুরুত্ব বহন করে না, বরং কিভাবে এ সঙ্কট তারা কাটিয়ে ওঠে এটাই দেখার বিষয়।


আরো সংবাদ



premium cement