১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তদন্ত নয়, ভানুমতির খেল

-

খুনের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ থেকে শুরু করে সব অঘটনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা সভ্য সমাজে একটি জরুরি কাজ বটে। রাষ্ট্র-সমাজ-সংসার টিকিয়ে রাখতে এর বিকল্প নেই। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনই হলো রাষ্ট্রের প্রত্যাশিত অবস্থান। তাই সমাজে শৃঙ্খলা অটুট রাখতে রাষ্ট্রের রয়েছে পুলিশবাহিনী। তারা যেকোনো ঘটন-অঘটন মানে ফৌজদারি অপরাধের তত্ত্ব-তালাশে নামে। অন্য অর্থে, তদন্ত করে থাকে। পুলিশই এর প্রথম ও প্রধান দায়িত্বশীল। তারাই তদন্ত শেষে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে থাকে। অর্থাৎ কারা কিভাবে অপরাধে জড়িত, সেই বয়ান। এরপর বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। তাই ফৌজদারি অপরাধে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পুলিশের তদন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বলা চলে, অপরিহার্য এটি। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কোনো মামলার বিচারকাজ চলতে পারে না।

পুলিশের কর্মদক্ষতা-অদক্ষতার প্রভাব বিচারপ্রক্রিয়ায় পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু তদন্তকাজ দায়সারা গোছের, মতলবি কিংবা ভুল হলে তার মাশুল গুনতে হয় নিরপরাধ মানুষকে। খেসারত দিতে হয় চড়া মূল্যে। এর ক্ষতিপূরণ আর কিছুতেই সম্ভব হয় না। এমনও দেখা যায়, ঘটনার সাথে যার দূরতম সম্পর্কও নেই তিনিও আসামি হয়ে যান। তেমনি একটি খুনের মামলার অভিযোগপত্র ভোগাচ্ছে চারজন ‘নিরপরাধ’ নারী-পুরুষকে।

ঘটনাটি আবু সাঈদ নামে এক কিশোরের কথিত খুন হওয়ার অভিযোগ নিয়ে। দীর্ঘ দিন পর জানা গেল, বাস্তবে আদৌ নাকি ওই ধরনের খুনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। লঞ্চ থেকে আবু সাঈদকে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যার যে দাবি করা হয়, তা ঠিক নয়। কারণ, ওই দিন ওই লঞ্চই নাকি ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়নি। অথচ পুলিশের তদন্তে আসামিদের কারো কারো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা খুনের কথা স্বীকার করেছেন। সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার দাবি, তদন্তকাজে প্রযুক্তির ব্যবহারও করেছেন তিনি। অবশ্য সেটি ‘লাঠি প্রযুক্তি’ কি না তা জানা যায়নি। তবে ওই স্বীকারোক্তি আদায়ে ‘বাঁকা’ পথ অবলম্বন করা হয়েছে বলে সন্দেহবাদীদের সংশয় দানা বেঁধেছে। এর প্রমাণস্বরূপ হাজির করা হচ্ছে মামলার আসামি আফজালের কথা। তার ভাষ্যমতে, ‘আমাদের চারজনকে বরিশাল থেকে ধরে এনে ঢাকার মিন্টো রোডে ডিবির কার্যালয়ে রাখা হয়। পুলিশের নির্যাতনের মুখে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছি। আদালতে পুলিশের শেখানো কথা বলেছি।’ এসব শুনে অনেকে ভাবতে পারেন, কেন তদন্ত কর্মকর্তা এমন করলেন? তাদের জ্ঞাতার্থে বলতে হয়, পেশায় ‘পারফরম্যান্স’ বলে একটি কথা আছে। ‘করিৎকর্মা’ না হলে চাকরিজীবনে সাফল্য অধরাই থেকে যায়। সেই চিন্তা থেকে এমন কাণ্ড ঘটানো হতে পারে।

ডিবি উপপরিদর্শক ও তদন্ত কর্মকর্তা রুহুল আমিন ২০১৫ সালের ১৫ জুন আদালতে চারজনের নামে ৩০২ ধারায় অভিযোগপত্র দেন। এতে বলা হয়, আসামিদের গ্রেফতার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মুঠোফোনের কললিস্ট সংগ্রহ করে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আসামিদের তিনি শনাক্ত করেন। অভিযোগপত্র দাখিলের পর বিচারকাজ শুরু হয়। এমনকি সেটি শেষপর্যায়ে এসে পৌঁছে। তবে ঘটনাচক্রে ওই খুনের মামলার রহস্য উন্মোচন হলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসে। জানা যায়, খুনের ঘটনাটি ভুয়া; ডাহা মিথ্যা। লঞ্চ থেকে আবু সাঈদকে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে যে দাবি করা হয়েছিল, তা ঠিক নয়। কারণ, সে দিন ওই লঞ্চ ঢাকা থেকে ছেড়েই যায়নি। মামলায় উল্লিখিত খুনের শিকার হওয়া ছেলেটি শুধু বেঁচে আছে তা-ই নয়; পরিবারের সাথে বহালতবিয়তে মাতৃ¯েœহে দিন গুজরান করছে। একটি দিক লক্ষণীয়, মামলা দিয়ে প্রতারণার অভিযোগে অবশেষে আবু সাঈদসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বাস্তবে যা আদৌ ঘটেনি, তদন্ত শেষে সেই ভুতুড়ে ঘটনার অভিযোগপত্র কিভাবে দিলেন তদন্তকারী কর্মকর্তা? এটি আষাঢ়ে গল্পের সাথে তুলনীয়। আষাঢ়ের বাদল দিনে অলস সময়ে ভাবনার ডালপালা গজিয়েছে আর কী! তখন কত কিছু যে কল্পনায় ভর করে। এই তদন্ত কাজ যেন তেলেসমাতি কারবার। এক কথায় ‘ভানুমতির খেল’।

ভানুমতির খেলের উল্লেখ করায় অনেকে আবার প্রবাদটির উৎস সন্ধানে নেমে পড়তে পাড়েন। ভানুমতির খেল বা ভানুমতি কা খেল, ভোজবাজি, জাদুবিদ্যা, ইন্দ্রজাল, ভানুমতির ভেলকি, কুহকবিদ্যা প্রভৃতি প্রায় সমার্থক বিষয়। বাংলার পথে-প্রান্তরে জাদুবিদ্যা প্রদর্শনকারীরা জাদু দেখানোর সময় ‘ভানুমতির খেল’ কথাটি ব্যবহার করে থাকেন। আবার অতি ধুরন্ধর বা কর্মকুশল ওস্তাদ সুনিপুণভাবে কোনো কাজ (যা অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব বলে বিবেচিত) করলে তার কৌশলকে ভানুমতির খেল নামে আখ্যায়িত করা হয়। এ অবস্থায় অনেক ধড়িবাজও সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে কূটকৌশলে প্রতারণা করার সুযোগ খোঁজে। অর্থাৎ অসম্ভব কাজ কৌশলে করার জন্য এ দেশে ভানুমতির খেল- এ প্রবাদের উদ্ভব। কিন্তু জাদুবিদ্যা বা ভেলকির সাথে ভানুমতির নাম কেন জড়িত হলো?

যত দূর জানা যায, ভানুমতি হলেন ভোজরাজকন্যা। স্বামী মহারাজ বিক্রমাদিত্য। ভানুমতির বাবা ভোজরাজ ছিলেন মালব দেশের রাজা, তিনি ইন্দ্রজালবিদ্যার প্রবর্তক। এই অঘটন-ঘটন-পটু বিদ্যার নাম পরিচিতি পেয়েছে তার নামে ভোজবিদ্যা বলে। মানে, ভোজবাজি। ভানুমতি ছিলেন পিতার প্রবর্তিত ভোজবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। কিংবদন্তি আছে- ভানুমতি একদিন জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে মাঠের মধ্যে খরস্রোতা নদী খনন করে সাময়িকভাবে স্বামী বিক্রমাদিত্যের গতি রোধ করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কিশোর আবু সাঈদের কথিত খুনের ঘটনায় তদন্তে নেমে ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক রুহুল আমিন কেন ভানুমতির খেলের মতো অভিযোগপত্র দিলেন? এটি কি কেবলই ভুল, নাকি অন্য কিছু?

কথিত এ হত্যাকাণ্ড ও তার বিচার হচ্ছে, অথচ এটি সাজানো মিথ্যা মামলা। এর থেকে আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, এ বিচারপ্রক্রিয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাক্ষী পর্যন্ত বহু লোক জড়িত, যারা ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব এবং অপরাধমূলক কার্যক্রমের তদন্তের জন্য কমিশন অব ইনকোয়ারি অ্যাক্টের অধীনে অবিলম্বে তদন্ত কমিশন গঠন করা উচিত। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

পাদটীকা : ‘হত্যার বিচার শেষপর্যায়ে/তবে ছেলেটি বেঁচে আছে’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘এক কিশোরকে হত্যার অভিযোগে চার আসামির বিরুদ্ধে মামলার বিচার চলছে চার বছর ধরে। ঢাকার আদালতে বিচারকাজ এখন শেষপর্যায়ে। এ অবস্থায় জানা গেল, ছেলেটি খুন হয়নি। অপহরণ ও খুনের মিথ্যা মামলা দিয়ে আসামিদের ফাঁসানো হয়েছিল। এ অভিযোগে ৩১ আগস্ট ওই কিশোরসহ চারজনকে গ্রেফতার করে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। ইতোমধ্যে ওই কিশোরের বয়স বেড়েছে, পুলিশের নথি অনুযায়ী ১৮। ২০১৪ সালে কিশোর আবু সাঈদের কথিত খুনের ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল রাজধানীর হাজারীবাগ থানা এলাকায়। মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, আবু সাঈদের বাবা আজম ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হাজারীবাগ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অপহরণ মামলা করেন। আজমের দাবি, তার ছেলে সে দিন হাজারীবাগের বড় মসজিদ মাতৃপীঠ স্কুলের উদ্দেশে রওনা হয়। কিন্তু আর বাসায় ফেরেনি। (প্রথম আলো, ১ সেপ্টেম্বর,২০১৯)।

camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিএনপি : কাদের রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্তযুদ্ধ দিবস পালিত

সকল