২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সংবিধানের দিকনির্দেশনা ও অনুশীলন

-

কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের চরম অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তি সন্নিবেশিত থাকে সে দেশের সংবিধানে। দেশটির জনগণ কী পেয়ে সাফল্যের চূড়ায় উঠবে এবং কোন পথে উঠবে সে দিকনির্দেশনা সন্নিবেশিত থাকে তার সর্বোচ্চ এই আইনগ্রন্থে। তেমনি বাংলাদেশের মানুষের এমন আকাক্সক্ষার রূপটি পরিস্ফুটিত হয়েছে আমাদের শাসনতন্ত্রে বা সংবিধানে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিরা এই জনপদের মানুষের স্বপ্নসাধ উপলব্ধি করে সেই আলোকে সংবিধানের লক্ষ্য উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ের চাহিদা পূরণের জন্য আরো কিছু নীতি-আদর্শ সংবিধানে চয়ন করা হয়েছে। এসব মিলিয়ে সংবিধান আজ দেশের সর্বোচ্চ বিধান ও জন অভিপ্রায়ের পরম প্রকাশ এবং এক অমূল্য সম্পদ। আমাদের সংবিধানই বলে দিয়েছে যে, এর বিধিবিধান এবং নির্দেশনাগুলো অবশ্য পালনীয়।

সংবিধানের আলোকে যারা রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদনের দায়িত্বে নিযুক্ত, তাদের পক্ষে এই নীতির বরখেলাপ করা অপরাধ। এসব বিষয় বাস্তবে কতটুকু অনুশীলন করা হয়েছে তা পরখ করা যেতে পারে। সেইসাথে এটা সাব্যস্ত হবে যে, আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত দায়িত্বশীলেরা কতটা নীতিনিষ্ঠ বজায় রেখে চলেন এবং তাদের চলার পথ কতটা আইনানুগ। কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে তারা অনুরাগ বিরাগের প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন কি না। এসব প্রশ্ন নিয়ে আজ কথা বলতে হতো না যদি না এসব নিয়ে কোনো প্রশ্ন না উঠত।

আগের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এখন দেখা যেতে পারে, আমাদের সংবিধান কোন কোন বিষয়ের, কী ধরনের নির্দেশনা পালনের জন্য রাষ্ট্রের নির্বাহীদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের মুখবন্ধ বা প্রস্তাবনায় এমন বক্তব্য সন্নিবেশিত রয়েছে যে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ আরো লিখিত রয়েছে, ‘... আমরা যাতে স্বাধীনসত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাক্সক্ষার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেই জন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণœ রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য।’

সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদের (ক) উপ-অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে, সকল নাগরিকদের ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা’ করা হবে। আর সংবিধানের ১৬ নম্বর ধারায় রয়েছে ‘নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে ... রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে রয়েছে গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকার জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কথা। ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদের (২) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ সংবিধানের ৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘...শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’

সংবিধানের ৩৯(২)(ক) এবং (খ) এ বর্ণিত রয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ শাসনতন্ত্রের ৫৫(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন।’ ৫৯(১) অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ সংবিধানের ৭৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ-প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন।’ ৭৭(২) অনুচ্ছেদ ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছে। বলা হয়েছে, ‘সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পাল কোনো মন্ত্রণালয়, সরকারি বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের যেকোনো কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা দায়িত্ব প্রদান করিবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করিবেন।’ জাতীয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দিয়ে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘...বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে।’ ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত আছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।’ জাতির বিশেষ কারণে এবং সময়ের প্রয়োজন পূরণের জন্য সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদকে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। আরো উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের সংবিধানের মোট অনুচ্ছেদের সংখ্যা ১৫৩টি।

ধারাবাহিকভাবে সংবিধানের যে মৌলিক দিকনির্দেশনাগুলো রয়েছে যা ওপরে উদ্ধৃত করা হয়েছে, এখন একপলকে দেখে নেয়া যেতে পারে বাস্তবে তার অনুশীলন কতটুকু হচ্ছে। এর মাধ্যমে এটাও পরখ করা যায়, যাতে এই বিষয়গুলো বিভিন্ন সময় যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা তখন কতটা অনুসরণ করেছেন এবং এই নির্দেশনাগুলোর প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি কী ফলাফল ছিল। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সাধারণভাবে যদি কোনো সতর্ক পাঠক লক্ষ করেন তবে তার কাছেও নির্দেশনার হালঅবস্থা পরিষ্কার হবে। সংবিধান একটি দেশের পবিত্র আইন গ্রন্থ বটে, তাই সেটার চর্চা ও অনুসরণ যত বেশি হবে সে দেশে মানুষের অধিকার ও উন্নয়ন ততটা নিশ্চিত হবে। কেননা সংবিধান প্রতিটি দেশের লক্ষ্যে পৌঁছার একটি নির্দেশনামা এবং মানুষের অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তির পরম প্রকাশ। বাংলাদেশসহ সব দেশেই সংবিধানের পরিপন্থী ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো সাধারণ আইন প্রণীত হয় না এবং হয়ে গেলে তার যতটুকু সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ঠিক ততটুকু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রদ হয়ে যাবে। বংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট আমাদের সংবিধানের সংরক্ষক এবং ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে স্বীকৃত। রাষ্ট্রের নির্বাচিত নির্বাহীরা সংবিধান হেফাজতের শপথ গ্রহণ করে থাকেন।

একটি জাতি কতটা সুশৃঙ্খল এবং কতটা আইনানুসারী হয়ে চলে, তার মাপকাঠি হচ্ছে সংবিধান এবং অন্যান্য আইনকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা; আর সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থার এসব বিধানাবলি প্রতিষ্ঠা করা। সংবিধানে আইনের শাসনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হলেও আজো দেশের সব মহল থেকেই এ জন্য আক্ষেপ ও আকুতি প্রকাশ করা হয়ে থাকে যে, আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা চাই। বলা হয়ে থাকে, আইন অন্ধ, তা সরলপথে চলে। অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হয়ে চলে না। তা কোনো সময় সবল শক্তিমত্তার কাছে নতি স্বীকার করবে না।’ এমন দৃঢ় পথে চলাই আইনের লক্ষ্য। কিন্তু আমরা আমাদের সমাজে বাস্তবে দেখছি আইন দুর্বলকে রক্ষা করতে পারছে না। অথচ সবলের অন্যায় অবিচারকে পাশ কাটিয়ে যায়। আইনের এমন ব্যর্থতা ও ঘাটতির জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তার দায় নিতে হবে; কেননা দেশে নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কার্যকর করার দায়িত্ব তাদেরই।

সংবিধানে যে সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার তাগিদ রয়েছে, তা পূরণ করতে এখনো আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন সক্ষম হয়নি। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, দেশে ক্রমাগতভাবে কিছু মানুষ অর্থবিত্তে ফুলে ফেঁপে উঠছে। সংখ্যা কম হলেও তারাই সমাজে নেতৃত্ব কর্তৃত্ব করে যাচ্ছেন। পক্ষান্তরে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দিন দিন আয় রোজগারের দিক থেকে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে; আর তাই এই দুর্বল মানুষের নানাভাবে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে। তাদের পক্ষে জীবনযাত্রা নির্বাহের ন্যূনতম সুযোগগুলো ভোগ করাও সম্ভব হচ্ছে না, তাদের দুঃখ কষ্টের সীমা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্রকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শুধু কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নয়, স্থানীয় প্রশাসনেও সমাসীন করার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। গণতন্ত্রকে দেশের চালিকাশক্তি হিসেবে দেখতে চায় সংবিধান; অথচ এখন দেশে চরমভাবে চলছে অগণতান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম। গণতন্ত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ভিন্ন মতের বিরুদ্ধে কথা বলার যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনি ভিন্ন মত পোষণে অবাধ সুযোগ থাকতে হবে। সহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শিক্ষা, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের সহিষ্ণু হওয়ার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, দেশে এখন এই পরিবেশ নেই। গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান অনুশীলন হচ্ছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্পণ করা। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র অবরুদ্ধ হয়ে আছে। নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ এবং প্রশ্নহীন নির্বাচন করার বিষয়টি ইতোমধ্যে মরীচিকায় পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বাক তথা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এর বিকাশ ঘটে সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু প্রকাশ্যে কোনো বিধিনিষেধ না থাকলেও অলক্ষ্যে নানা কৌশল ও পন্থায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হয়েছে এবং বাধার মধ্যে রয়েছে। গণতন্ত্রের আরেকটি বিষয় হচ্ছে, স্বাধীন নীতি ও মতের আলোকে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার স্বাধীনতা। অথচ বাস্তবে যারা ক্ষমতাসীনদের কার্যকর বিরোধিতা করেন, তাদের সভা সমাবেশ ও রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর ব্যাপারে বিধিনিষেধ রয়েছে, যা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। বর্তমানে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির ওপর চলছে হামলা মামলা এবং তাদের নেতারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত নির্দেশনাগুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ জন্য রয়েছে একটি পৃথক অধ্যায়ও। মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো সাংবিধানিক গুরুত্ব পেলেও তা কেবল কিতাবেই রয়েছে। অথচ এই জনপদে মানবাধিকার যেভাবে লঙ্ঘিত হয়ে আসছে, তাতে বিশ্বের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলো হরহামেশা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছে। বিশ্বের যেসব দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নাজুক সেগুলোর তালিকায় এ দেশের নাম শীর্ষে রয়েছে। আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলো; যেমনÑ অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার সংস্থান করার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু বেঁচে থাকার এসব মৌলিক চাহিদা পূরণের তাগিদ প্রশাসন অনুভব করে না। সংবিধান জাতীয় নীতি হিসেবে প্রশাসনকে সতর্ক করেছে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যাপারে। তা আজো নিছক নীতি হিসেবে বিদ্যমান।

লাখ লাখ শিশু-কিশোর কোনো শিক্ষা ছাড়াই বেড়ে উঠছে। প্রশাসন থেকে অনিয়ম দুর্নীতি দূর করার লক্ষ্যে সংবিধানে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠানের মূল্যবান ধারণা সংযোজিত রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে সংবিধান প্রবর্তনের পর থেকে আজ অবধি তা কার্যকর করা হয়নি। অপরদিকে, দুর্নীতি অনিয়ম এ দেশে এতটা ব্যাপক, যার ‘খ্যাতি’ দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বলয়ে বিস্তৃত হয়ে আছে। দুর্ভাগ্য হলেও এটা সত্য যে, দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিকতা পেতে চলেছে। দুর্নীতি প্রসারের অন্যতম কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্রে এখন জবাবদিহিতা নেই। সংবিধান দায়িত্ব দিয়েছে জাতীয় সংসদকে জবাবদিহি নেয়ার। কিন্তু সংসদের গঠন প্রক্রিয়ায় মারাত্মক ত্রুটি থাকায় প্রতিষ্ঠানটি এখন নখ দন্তহীন অথর্ব অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সংবিধান মন্ত্রিসভা তথা নির্বাহীদের যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু অথর্ব অকার্যকর বর্তমান সংসদ জবাবদিহি নিতে চরমভাবে ব্যর্থ। আগেই বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের গঠন প্রক্রিয়ায় মারাত্মক ত্রুটি থাকার কারণে তা একটা অকার্যকর ও অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ‘গঠন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি’ মানে, একটি প্রশ্নযুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে এখনকার একাদশ সংসদ গঠিত হয়েছে। এই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের জন্য দায়ী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন। সংবিধান প্রতিষ্ঠানটি রুজু ও স্বাধীনভাবে তার দায়িত্ব পালনের জন্য তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। স্বাধীন এবং সরল ও সোজা পথে দায়িত্ব পালন না করে প্রতিষ্ঠানটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রতি গভীর অনুরাগের বশবর্তী হয়ে তাদের ‘দায়িত্ব পালন করেছে’। এর ফলে গঠিত হচ্ছে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের বশংবদ একটি সংসদ।

নির্বাচন কমিশনের এমন রাগঅনুরাগের ফলে বহু ক্ষেত্রে নির্বাচনে ‘ব্রুট মেজরিটি’ লাভের কারণে ক্ষমতাসীনেরা বিভিন্ন সময় কর্তৃত্ববাদী হয়ে যান। তারা নীতি আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে এতবেশি অন্ধ হয়ে যান যে, সংবিধানকে নিজেদের অভিপ্রায় পূরণের জন্য ‘সংশোধন’ করে নেন। অথচ সংবিধান সংশোধন হবে কেবল সময়ের চাহিদা পূরণের জন্য এবং জনগণের বৃহত্তর প্রয়োজনের আলোকে। আর এটাই অত্যন্ত যৌক্তিক। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধানকে ১৭ দফা সংশোধন করা হয়েছে। এসব সংশোধনীর সব কিন্তু যৌক্তিক কার্যকারণে নয়; অনেকগুলো নিছক রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের তাগিদেই করা হয়েছে।

এ কথা বলে শেষ করতে চাই যে, ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের এখন নারী অধিকার সংরক্ষণ এবং ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ‘চ্যাম্পিয়ন’ বলে প্রচার করে সুখ বোধ করেন। সরকারের সাথে সরকারঘেঁষা বিভিন্ন নারী সংগঠন নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের নারীদের নিয়ে যেসব খবর এখন প্রকাশ পাচ্ছে তা খুবই মর্মান্তিক। অপ্রতিরোধ্য গতিতে শিশু নারীর ওপর যৌন নির্যাতন চলছে, তাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে গণিকালয়গুলোতে অসংখ্য নারী চরম লাঞ্ছনার জীবনযাপন করছে। এ নিয়ে না আছে প্রশাসনের কোনো মাথাব্যথা, কিংবা নারীবাদীদের কোনো উদ্যোগ আয়োজন। অথচ সংবিধানে গণিকাবৃত্তির বিলোপ করার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বিস্ময়কর হলো, এ বিষয় নিয়ে কখনো কারো মুখে কোনো কথা শোনা যায় না। দুর্ভাগ্যজনক যে, আজকে সমাজে নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাদের অত্যন্ত অশালীন পোশাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসা হচ্ছে। এই অসম্মান ও অমর্যাদা নিয়ে প্রশাসন ও সমাজপতিরা সামান্য ভাবেন বলেও মনে হয় না।

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement