২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মুক্তি কবে?

-

১৭ বছরব্যাপী চলমান আফগান যুদ্ধ অবসানে আমেরিকা ও আফগান তালেবানদের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে যে বারকয়েক বৈঠক হয়েছে, প্রতিটি বৈঠকে অলোচনায় উঠেছে ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মুক্তি প্রসঙ্গ। সমঝোতার অন্যতম শর্ত ছিল এটি। এ বছর ১৬ মার্চ তিনি মার্কিন কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন, এমন একটি খবর মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। কিন্তু এ খবর সত্য হয়নি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও তার মুক্তির দাবি নিয়ে মিডিয়ায় সোচ্চার ছিলেন। নওয়াজ শরিফও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আফিয়া সিদ্দিকীকে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। এদিকে, আদৌ তিনি মুক্তি পাবেন কি না, এই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু দিন আগে একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, তিনি কারাগারে মারা গেছেন। ইতোমধ্যে আমেরিকার হাউস্টনে নিযুক্ত পাকিস্তানি কূটনীতিক আয়েশা ফারুকী টেক্সাসের জেলখানায় গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করে এসে জানান, তিনি জীবিত আছেন।’ গত ১৪ মাসে চতুর্থবারের মতো ড. আফিয়ার সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটেছে এবং দুই ঘণ্টা ধরে তাদের কথা হয়। তার মুক্তির দাবিতে পৃথিবীর মানবতাবাদী ও বিবেকবান মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে।

ড. আফিয়া সিদ্দিকী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্নায়ুবিজ্ঞানী। অসামান্য ধীসম্পন্ন পিএইচডিধারী এ মহিলার সম্মানসূচক ডিগ্রি ও সার্টিফিকেট রয়েছে প্রায় ১৪৪টি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রন্ডেইস বিশ্ববিদ্যালয় ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ঘবঁৎড়ষড়মু বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। তিনি হাফিজে কুরআন ও আলিমা। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে পারদর্শিনী এ নারী ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত দ্বীনদার। ইসলামী আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি রয়েছে তার দৃঢ় অঙ্গীকার। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায়, আলকায়েদার সাথে যোগাযোগ থাকার কথিত অভিযোগে ২০০৩ সালে ড. আফিয়াকে তার তিন সন্তান আহমদ, সুলায়মান ও মরিয়মসহ করাচির রাজপথ থেকে অপহরণ করে। পাকিস্তানের কোনো কারাগারে না রেখে এবং পাকিস্তানি আদালতে উপস্থাপন না করে তাকে আফগানিস্তানের কুখ্যাত বাগরাম সামরিক ঘাঁটিতে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এরপর চলে তার ওপর অমানুষিক শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন। বাগরামে মার্কিন কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিরা বলেছেন, ‘নির্যাতনের সময় একজন নারী বন্দীর আর্তচিৎকার অন্য বন্দীদের সহ্য করা কষ্টকর ছিল। ওই নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে অন্য বন্দীরা অনশন পর্যন্ত করেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে আফিয়াকে আমেরিকায় স্থানান্তরিত করে নিউ ইয়র্কের এক গোপন কারাগারে রাখা হয়। এখন তিনি আছেন টেক্সাস স্টেটের এক কারাগারে। অব্যাহত নির্যাতনের ধকল সইতে না পেরে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। প্রথম থেকেই তিন সন্তানকে তার থেকে পৃথক রাখা হয়েছে। আজও তিনি জানেন না তার সন্তানরা কোথায়? তারা আদৌ বেঁচে আছেন কি না। পাকিস্তানের তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের চেয়ারম্যান ইমরান খান এক সময় দাবি করে বলেছিলেন, তার দুই সন্তান মার্কিননিয়ন্ত্রিত আফগান কারাগারে অত্যাচারে মারা গেছে। তিনি আরো বলেছেন, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের মধ্যে যারা ড. আফিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’

আফিয়া সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ সাজানো হয়। পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে, এটি পাতানো গল্প। বলা হচ্ছে, ২০০৮ সালের জুলাইয়ে আফগানিস্তানের গজনি প্রদেশে আফিফাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তিনি দুই মার্কিন গোয়েন্দাকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন। মার্কিন গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় ৩৮ বছর বয়সী আফিয়া একজন ওয়ারেন্ট অফিসারের এম-৪ অ্যাসল্ট রাইফেল কেড়ে নিয়ে এফবিআই এজেন্ট ও সৈন্যদের গুলি করার চেষ্টা করেছেন। এ সময় মার্কিন সেনারা তাকে মেঝেতে ফেলে দিলে ধস্তাধস্তি হয় এবং ৯ এমএম পিস্তলের গুলি তার পায়ে লাগে। এতে মার্কিন এজেন্ট বা গোয়েন্দার কেউ হতাহত না হলেও আফিফা গুলিবিদ্ধ হন। আমেরিকানরা আরো দাবি করেছে, আফিয়া আরবিতে বলেন, ‘মার্কিনিরা নিপাত যাক, আল্লাহ মহান।’

ড. আফিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগকারীর বক্তব্য হলো, তাকে গ্রেফতারের সময় তার সাথে থাকা হাতব্যাগ তল্লাশি করে মার্কিন স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা-সংবলিত কাগজপত্র, গজনির মানচিত্র, রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির নিয়মাবলি ও রেডিওলজিক্যাল এজেন্ট সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া গেছে। ব্রিটেনের দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ব্রন্ডেইস বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডিধারী একজন পাকিস্তানি-আমেরিকান তার হাতব্যাগে মার্কিন স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা নিয়ে ঘুরছেন- এটি কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য?’

নিউ ইয়র্কের একটি আদালত মার্কিন গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যাচেষ্টার দায়ে পাকিস্তানের বিজ্ঞানী ড. আফিয়া সিদ্দিকীকে ৮৬ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষিত ৩৮ বছর বয়সী এ বিজ্ঞানীকে ২০০৩ সালে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সাতটি মামলা করা হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে ড. আফিয়া সিদ্দিকী মার্কিন উচ্চ আদালতে আপিল করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আল্লাহর আদালতে আপিল করেছি।’ রায় ঘোষণার পর আফিয়া আদালতে বলেন, আমেরিকা নয়, ইসরাইল থেকে এসেছে এ রায়। এই আদালত বয়কট করি। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে আমি যে নির্দোষ, তা প্রমাণ করতে সক্ষম, কিন্তু বিচারকের প্রতি আমার আস্থা নেই।’ আর বিচারকও তাকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ দেননি। আফিয়া আগেই বলেছিলেন, কোনো ইহুদি বিচারক থাকলে তিনি (আফিয়া) ন্যায়বিচার পাবেন না এবং ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন বিচারক নিয়োগ করা হোক।

আদালতে প্রদত্ত তার বক্তব্যে দৃঢ়তা ও নির্ভীকতার পরিচয় পাওয়া যায় I demand all prospective jurors be DNA-tested, and excluded from the jury at my trial: if they have a Zionist or Israeli background... they are all mad at me... I have a feeling everyone here is them—subject to genetic testing. They should be excluded, if you want to be fair. I do not trust the Judge. I’m boycotting the trial, just to let all of you know. There are too many injustices.

নিউ ইয়র্কের আদালতে কেবল গজনির ওই ঘটনারই বিচার হয়েছে। তাকে অপহরণ বা বাগরামে আটকে রাখা-সংক্রান্ত অভিযোগের কোনো তদন্ত হয়নি। আফিয়া সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের কোনো অভিযোগ আনা হয়নি। অথচ মার্কিন কর্মকর্তারা এর আগে বিভিন্ন সময়ে আলকায়েদাকে অর্থায়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে হামলা পরিকল্পনার কথা বলে এসেছেন। আইনজীবী অভিযোগ করেন, আফিয়ার বিচার প্রক্রিয়ায় দ্বৈতনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। মার্কিন প্রশাসন একজন অসুস্থ মহিলাকে এত দীর্ঘ কারাদণ্ড প্রদান করায় বিশ্বের সচেতন মানুষ স্তম্ভিত। আমেরিকার মতো একটি শক্তিধর রাষ্ট্র একজন অসহায় মহিলার প্রতি এত ক্ষিপ্ত কেন? আইনজীবীরা প্রশ্ন তুলেছেন ড. আফিয়া মার্কিন নাগরিক নন; আফগানিস্তানের ঘটনার কথিত অভিযোগে একজন পাকিস্তানি নাগরিককে আমেরিকায় স্থানান্তর করে সে দেশের আদালতে তাদের মর্জিমাফিক বিচার করা ও সাজা দেয়া কতটুকু আইনসম্মত? এটা ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

ড. আফিয়া সিদ্দিকীকে মার্কিন আদালত দোষী সাব্যস্ত করায় পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। বড় বড় শহরে সাঁটানো পোস্টারে লেখা- ‘আমেরিকাকে ধিক্কার’। লাহোর হাইকোর্ট স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মুক্তির পদক্ষেপ নিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট আবেদনে জাফরি বলেন, একজন ইহুদি বিচারকই রায় দিয়েছেন। ‘পক্ষপাতদুষ্ট কোনো ব্যক্তির’ কাছ থেকে কেউ সুবিচার আশা করতে পারে না।’

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সরকার আফিয়ার মুক্তির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। লাহোর হাইকোর্টের আইনজীবী আকসির আব্বাসী অভিযোগ করেন, বিশ্বজুড়ে সব জায়গাতেই অভিযুক্তরা ‘বেনিফিট অব ডাউট’ বা সন্দেহাতীতভাবে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত নির্দোষ বিবেচিত বলে সুবিধা পেয়ে থাকেন, কিন্তু আফিয়া তা পাননি। এটা বিচারপ্রক্রিয়ার মৌলিক নীতিমালার বিরোধী। আফিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার মতো অবস্থা নেই আফিয়ার। তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। যেকোনো সময় তার জীবন প্রদীপ নিভে যেতে পারে। আইনজীবীদের একজন অ্যালেইন শার্প বলছিলেন, ১৮ মাস ধরে নিঃসঙ্গভাবে আটক থাকার পর তিনি আর আইনজীবীদের সাথে যোগাযোগ করছেন না। শেষ পর্যন্ত আমিই তাকে সাক্ষ্য দিতে দাঁড় করাতে পেরেছিলাম, কিন্তু তাকে প্রস্তুত করার জন্য দুই ঘণ্টারও কম সময় পেয়েছি।’

করাচির অত্যন্ত দ্বীনদার, সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত পরিবারে আফিয়া সিদ্দিকীর জন্ম ১৯৭২ সালের ২ মার্চ। তার বাবা মুহাম্মদ সালেহ সিদ্দিকী ব্র্রিটেনে শিক্ষাপ্রাপ্ত একজন ¯œায়ুবিজ্ঞানী। তার মা একজন সমাজকর্মী ও সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য। বড় ভাই আমেরিকার টেক্সাসে বসবাসরত স্থপতি এবং বড় বোন ফাউজিয়া হার্ভার্ড ও জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত স্নায়ুবিজ্ঞানী, যিনি বর্তমানে বাল্টিমোরের সিনাই হাসপাতালে কর্মরত। ড. আফিয়া সিদ্দিকী যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন এবং ২০০২ সাল পর্যন্ত সেখানেই বসবাস করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকালে তাকে যারা চিনতেন তাদের সবাই বলেছেন, আফিয়া অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী এবং ইসলামের প্রতি ছিল তার বিশেষ দরদ। এ কথা ঐতিহাসিক সত্য, মজলুমের অশ্রুজল ও বুকভরা আর্তনাদ পৃথিবীতে কোনো দিন ব্যর্থ হয়নি। আফিয়া সিদ্দিকীর সাহস, আত্মপ্রত্যয় ও কোরবানি পৃথিবীতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে এবং সূচনা করবে নতুন প্রভাতের।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ওমরগণি এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম


আরো সংবাদ



premium cement
জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

সকল