২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফের নজরদারিতে চুল ও খোশগল্প

-

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও সমাজে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশবাহিনী অন্যতম প্রধান ভরসা। বেসামরিক প্রশাসনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তারাই মূল চালিকা শক্তি। সমাজে অশান্তি দূর করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে তাদের ওপরই নির্ভর করতে হয়। যে দেশের পুলিশ যত দক্ষ ও পেশাদার, সেই রাষ্ট্রে শান্তি ও নিরাপত্তা তত বেশি টেকসই। সেখানে নাগরিকসমাজ থাকে নির্ভার-ফুরফুরে মেজাজে। তাই সভ্য দুনিয়ায় পুলিশের কদর অতুলনীয়। তাদের সম্মান আকাশ ছোঁয়া। গণতন্ত্রের অবস্থা যেমনই হোক না কেন, আমাদের দেশেও শক্তিশালী একটি পুলিশবাহিনী আছে। তবে এ বাহিনীতে কর্মরত অনেকের ভাবমর্যাদা কেমন, তা নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই মঙ্গল। তাতে ‘গায়েবি মামলা’র ঝামেলা এড়ানো যেতে পারে। ২০১৮ সালের ‘ভয়ঙ্কর’ সেপ্টেম্বর অনেকের হৃদয়ে দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। এখনো তা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। যন্ত্রণায় কাতর তারা।

‘ঝামেলামুক্ত’ জীবন চাইলে এ দেশে পুলিশ সম্পর্কে নীরবতাই শ্রেয়; বুদ্ধিমানের কাজ। কার্যকর দর্শন হলো- বোবার কোনো শত্রু নেই। কিন্তু কতক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে থাকা যায়? বেশিক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে থাকলে মুখগহ্বরে ব্যথা করে। তাই বাধ্য হয়েই একটু-আধটু মুখ খোলা। এটি ভুলে যাওয়া কষ্টসাধ্য যে, জাতি হিসেবে আমরা কথার রাজা। সেলফোন সাধারণীকরণ হওয়ার ফলে একথা-সেকথার ফুলঝুরিতে কাটে সারাক্ষণ। কথার জন্য আমরা বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা হাওয়া করে দিচ্ছি। ফলে মোবাইল কোম্পানিগুলোর পোয়াবারো। কথা বাড়াতে বছরজুড়ে গণমাধ্যমে দেখা যায় বাহারি সব বিজ্ঞাপন। তাতে থাকে লোভনীয় সব অফার। বিজ্ঞাপনের মূলমন্ত্র- ‘প্রচারেই প্রসার’। এর সত্যতা মিলেছে হাতেনাতে।

অতিকথনের এই দেশে পুলিশের অনেক সদস্য আগবাড়িয়ে ‘অতিকাজে’ জড়িয়ে পড়ছেন। তবে অপরাধ দমাতে নজরদারির বিকল্প নেই। তাই হয়তো বগুড়ার তরণ-তরুণীদের খোশগল্পে এবং মাগুরায় চুল কাটার স্টাইলে ফের নজরদারি করছে পুলিশ। বগুড়ায় প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেমালাপে প্রশাসনের বাধা দেয়া নতুন নয়। এটি ওখানকার জেলা প্রশাসনের হৃদয়ে দাগ কাটছে। এর ভাগীদার হতে চায় পুলিশ প্রশাসন। তবে একটি প্রবাদ চালু আছে- ‘অতি ভালো, ভালো না’। তাতে বুমেরাং হতে পারে। যেমন তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফুটবল ম্যাচে রক্ষণভাগের কোনো খেলোয়াড় গোল করার অতি লোভে রক্ষণভাগ অরক্ষিত রেখে আক্রমণভাগে বল নিয়ে দেয় ছুট। এমন অবস্থায় অনেক সময় প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠানোর বদলে হঠাৎ উল্টো গোল হজম করতে হয়।

একজনের ভুলের খেসারত চড়ামূল্যে পরিশোধ করতে হয় দলকে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে সালাত বা নামাজ-বিষয়ক পুলিশ রয়েছে। তাদের কাজ হলো, মুসলিম নাগরিকরা নামাজের সময় তেজারতি চালু রেখে সালাতে গাফিলতি করছে কি না তা তদারক করা। আবার একাধিক দেশে ‘মোরাল পুলিশ’ দেখা যায়। তারা হলে ‘নৈতিকতার শিক্ষক’। রাষ্ট্র ও সমাজে নৈতিকতা নিয়ে কাজ করে তারা। তবে সভ্য দুনিয়ায় মোটাদাগে সাধারণত অপরাধ দমন করে আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখাই পুলিশের মূল কাজ। আমাদের দেশে কিছু পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে মাঝে মধ্যে যা করেন; তাতে অনেক সময় সাধারণ মানুষ ধন্দে পড়ে যায়। চুল কাটার স্টাইল নিয়ন্ত্রণ এবং পার্কে খোশগল্পে হস্তক্ষেপ করা নিয়ে সাধারণের ধন্দ এখনো কাটেনি। তাদের সরল মনের ভাবনা, যার যে দায়িত্ব- তা সুচারুভাবে সম্পাদন করাই শ্রেয়। এতেই নিহিত আছে দেশ-দশের কল্যাণ।

কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এবং রাজধানীর রমনা পার্কে খোশগল্পে মশগুল তরুণ-তরুণীরা বাধার সম্মুখীন হয়েছে। তবে চুল কাটার স্টাইল প্রথম নজরদারির আওতায় আসে চলতি বছর মার্চে। এ মহতী উদ্যোগের পথপ্রদর্শক টাঙ্গাইলের সখীপুর ও ভূঞাপুর, ঢাকার সাভার এবং ঝালকাঠির পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নরসুন্দর নেতারা। ৭ মার্চ টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থানার ওসি একটি নোটিশ জারি করেন। তাতে বলা হয়েছিল, চুল-দাড়ি-গোঁফে ফ্যাশনের ওপর সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। নোটিশের নিচে স্বাক্ষর ছিল স্থানীয় নরসুন্দর সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং ওসির। পরে অবশ্য ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চুল কাটার নিয়ম বেঁধে দেয়াকে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হিসেবে আমলে নিয়ে ওই নোটিশ খারিজ করে দেন।

এরপর দেখা গেল, ঝালকাঠিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্থানীয় নরসুন্দর সমিতির নেতাদের সাথে বৈঠক করে তাদের স্থানীয় ছেলেদের চুল ‘মার্জিতভাবে’ কাটার ‘অনুরোধ’ করেছিলেন। তার দাবি ছিল, ছাত্রীদের কাছ থেকে তিনি জেনেছেন, যারা ইভটিজিং করে, তাদের বেশভূষা ও চুলের স্টাইল দেখলেই তারা ভয় পায়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের অনুরোধের পর নরসুন্দররা ‘অমার্জিত’ স্টাইলে ছেলেদের চুল কাটবেন না বলে পাকা কথা দিয়েছিলেন। সাভারের জনপ্রতিনিধিরাও শিক্ষার্থীদের চুল কেমন করে কাটাতে হবে, তা নিয়ে বেশ তৎপর হয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে তারা এই ‘ভালো’ কাজ করেছেন। তার মানে, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা তাদের ঘোষণা মোতাবেক, তরুণ সম্প্রদায়ের চুলসংস্কারের মধ্য দিয়ে মহৎ একটি সামাজিক আন্দোলনে নেমেছিলেন।

গোল বাধে ওই ‘আন্দোলন’ নিয়ে তা কতটুকু সমর্থনযোগ্য; এটা তর্কসাপেক্ষ হয়ে ওঠে। পক্ষ-বিপক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। কথা হলো, এ যুগে শিশুরা পর্যন্ত শিশু অধিকার আইন পড়ে বইয়ের সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে, বাবা-মা আইন মেনে আচার-ব্যবহার করছেন কি না; উপরন্তু তাদের হাতে হাতে স্মার্টফোন। ফোনে ফোনে ফেসবুক। ফলে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সাম্প্রতিক এ চুলসংস্কার কর্মসূচি নিয়ে তাদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়া স্বাভাবিক। তারা প্রশ্ন তোলে, কে কিভাবে চুল কাটবে, সেটি জনপ্রতিনিধি বা পুলিশ ঠিক করে দেয়ার কে?

গত ২১ আগস্টের খবর। এক শ্রেণীর যুবক চুল এমনভাবে কাটে যে, তাদের দুই কানের ওপরের অংশে চুল থাকেই না। কিন্তু মাথার ওপরের অংশে ঘন চুল থাকে। এই চুল বেশ দীর্ঘ। হাঁটার সময় কিংবা মোটরসাইকেল চালানোর সময় এ চুল বাতাসে দুলতে থাকে। এভাবে চুল কাটানোকে ‘বখাটে কাটিং’ বলছে মাগুরা জেলার পুলিশ। এই স্টাইলে চুল না কাটাতে সেলুন মালিক ও কর্মীদের লিখিত নির্দেশ দিয়েছে মাগুরা সদর থানা পুলিশ। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে এ বিষয়ে মাইকিং, নরসুন্দরদের নিয়ে বৈঠকসহ ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে সেলুন মালিকদের জানানো হয়, কোনো সেলুনকর্মী কারো চুল কিংবা দাড়ি যেন মডেলিং ও বখাটে স্টাইলে না কাটেন। সদর থানার ওসির দাবি, ‘এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, উঠতি বয়সী যুবকদের সংযত আচরণ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করা। মানুষের লাইফস্টাইলের সাথে তার আচরণের নানা যোগসূত্র রয়েছে। অনেকে উদ্ভট পোশাক পরে এবং উদ্ভট স্টাইলে চুল কাটে, যা দৃষ্টিকটু ও অস্বাভাবিক। সেটি তার জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ কারণে এটি প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে সবার আগে জরুরি হলো, সচেতনতা। সে কাজটিই আমরা করছি। ইতোমধ্যে এর ইতিবাচক ফলও পাচ্ছে শহরবাসী।’

অনেক ময়মুরব্বি এতে বেজায় খুশি। সে ক্ষেত্রে গুটিকয় পোলাপানের চুল কাটার স্টাইলের খায়েশ অপূর্ণ থাকলে ক্ষতি নেই। এতে ব্যক্তিস্বাধীনতা না হয় জলাঞ্জলি গেল। তবে অনেকের কণ্ঠে ভিন্ন সুর। তারা বলছেন, পুলিশ আসল কাজে মন না দিয়ে ‘ফাউ কাজে’ ব্যস্ত। এই ফাঁকে ভয়ঙ্কর অপরাধী চম্পট দিতে পারে। তাই এটি সমর্থনযোগ্য নয়।

২১ আগস্ট বুধবার। দিনদুপুরে বগুড়া শহরের দু’টি বিনোদন পার্কে অভিযান চালিয়ে স্কুল-কলেজের ৩২ জন শিক্ষার্থীকে আটক করে সদর থানায় নেয়া হয়। দীর্ঘক্ষণ আটকে রেখে পরে অভিভাবকদের জিম্মায় দেয়া হলো। শিক্ষার্থীদের এভাবে আটক করে থানায় নেয়ার ঘটনায় সমালোচনার ঝড় উঠলেও বগুড়ার পুলিশ সুপার সোস্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিয়ে অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। অভিভাবকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই অভিযান চালানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

শুধু বিনোদন পার্ক নয়; স্কুল-কলেজ ফাঁকি দেয়া আড্ডাবাজ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শহরজুড়ে পুলিশের বিশেষ অভিযান চলানোর কথাও জানান। তার ভাষায়- এটা আইনের বিষয় নয়, নৈতিকতার। পুলিশ সেই নৈতিকতার তাগিদেই শিক্ষার্থীদের পার্ক থেকে থানায় নিয়ে অভিভাবকদের জিম্মায় দিয়েছে। বগুড়া সদর থানার ওসি দাবি করেন, কারো অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নয়; স্কুল ফাঁকি দিয়ে পার্কে আড্ডা দেয়ায় পুলিশ নিজে থেকেই সেখানে অভিযান চালিয়ে ৩২টা ছেলেমেয়েকে আটক করে থানায় নিয়েছে। তবে বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেছেন, বিনোদন পার্কে অভিযান চালিয়ে শিক্ষার্থী আটক করা আইনসিদ্ধ নয়।

বগুড়ার অনেক বিশিষ্টজনের অভিযোগ, শহরে অপরাধীরা অনেক অপকর্ম করছে অবলীলায়। সেসব অপরাধ দমন করা বাদ দিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে পুলিশ বিনোদন পার্কে অভিযানের নামে শিশু-কিশোরদের মানসিক নির্যাতন করছে। এর আগে ২০১৩ সালের ১১ জুন বগুড়ার একটি বিনোদন পার্কে অভিযান চালিয়ে ১৪৪ তরুণ-তরুণীকে আটক করেছিল প্রশাসন। বিনোদনকেন্দ্রে একসাথে বসে থাকার দায়ে অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছিল ওদের। অভিযানের ভিডিওচিত্র ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে শহরের রেস্তোরাঁ ও ফাস্টফুডের দোকানে আরেকবার অভিযান চালানো হয়। তখন ৪০ জন শিক্ষার্থীকে আটক করে তাদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়।

পুলিশের এমন কাজে তরুণ-তরুণীরা তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য রক্ষায় আন্দোলনে নামবেন কি না সে সম্পর্কে কোনো সংবাদ চোখে পড়েনি। তবে এটি বোঝা মুশকিল নয় যে, চুল কাটার স্টাইল ও খোশগল্প ফের নজরদারিতে আসায় তরুণসমাজের মাথায় ‘বাজ পড়েছে’ যেন। এটি তাদের কাছে ‘বিনামেঘে বজ্রপাত’।

camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement