২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ওয়াকফ : নতুন আন্দোলন প্রয়োজন

ওয়াকফ : নতুন আন্দোলন প্রয়োজন - ছবি : নয়া দিগন্ত

আমাদের প্রয়োজন নতুন এক ওয়াকফ আন্দোলন। ওয়াকফর যে বিশেষ গুরুত্ব তা আজকের দিনে আমাদের সমাজে হারিয়ে গেছে। সে গুরুত্বকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হবে।

ওয়াকফর নীতি হলো, যেকোনো ব্যক্তিই তার সম্পত্তির একটি অংশ আল্লাহ তায়ালার ওয়াস্তে দিয়ে দিতে পারেন এবং বলে দিতে পারেন যে, সম্পদ কিভাবে ব্যবহৃত হবে, কী কাজে ব্যবহার করা হবে। ওয়াকফ সব সময় ভালো কাজেই ব্যবহার করা যায়, মন্দ কাজে ব্যবহার করা যায় না। ওয়াকফ যিনি করে দেন তিনিই ওয়াকফ কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তার নির্দেশ দিয়ে থাকেন। তার ব্যবস্থাপনা কৌশল বলে দেন। কমিটির মাধ্যমে বা কিভাবে ওয়াকফ পরিচালিত হবে, এ নির্দেশ তিনি দিতে পারেন।

ইসলামের শুরুতেই ওয়াকফ শুরু হয়েছিল। প্রথম থেকেই মুসলমানদের স্বভাব ছিল, তাদের সম্পত্তির একটা অংশ তারা মহান আল্লাহর পথে দিয়ে যেতেন। এই সম্পদ কিভাবে ব্যয় হবে তাও বলে দিতেন। যেমন- এর মাধ্যমে সেখানে সরাইখানা প্রতিষ্ঠা করা হতো যেখানে পর্যটকরা থাকতে পারতেন। যারা মুসাফির হতেন, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতেন, তারা থাকতে পারতেন। সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। সে সময় বহু হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল। সেসব ছোট-বড় মাঝারি বিভিন্ন আকারে করা হয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি সব কিছুই ওয়াকফর মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ওয়াকফর ফান্ড থেকে ছাত্রবৃত্তির ব্যবস্থা চালু ছিল। সমাজের যত এতিম ছিল, তাদের জন্য ওয়াকফর মাধ্যমে এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করা হতো। সমাজের দুস্থ শ্রেণীর শিশুদের জন্য একটি পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা এবং তাদের ভরণ-পোষণের সব রকম ব্যবস্থা এই ওয়াকফ থেকে করা হতো। অর্থাৎ বলতে গেলে, তখন ওয়াকফর একটি বিরাট সামাজিক ভূমিকা ছিল, গুরুত্বও ছিল।

ঐতিহাসিক বিচারে আমরা দেখতে পাই, মধ্য এশিয়ার ইতিহাস পড়ে জেনেছি, মধ্য এশিয়া বিশেষ করে তাতারস্থান, বাশকিরিয়া, ভলগা-উরাল অঞ্চলের মতো রাশিয়ার মুসলিম অঞ্চল অথবা মধ্য এশিয়ার যেসব অঞ্চল একসময় রাশিয়া দখল করে নিয়েছিল সেসব জায়গায় ওয়াকফর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল তাদের ভূখণ্ডের প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। এত বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি ওয়াকফর অধীনে থাকার বিষয়ে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। তখন মূল সম্পদ হিসেবে ভূসম্পত্তিকেই ধরা হতো। এটা আজ থেকে আট শ’ বা এক হাজার বছর আগের কথা। এটা শিল্পবিপ্লবের বহু আগের কথা। সে সময় ‘সম্পদ বলতে বোঝাত একদিকে জায়গা-জমি আর অন্য দিকে ব্যবসায়-বাণিজ্য। পলমল প্রেস লন্ডন থেকে প্রকাশিত বেনিংসেং লিখিত বইতে এ বিষয়ে অনেক কিছু রয়েছে। আবার ড. ওমর চাপরা তার ইসলাম অ্যান্ড দ্য ইকোনমিক চ্যালেঞ্জ বইতে বলেছেন, ওয়াকফর বিরাট গুরুত্ব রয়েছে এবং এক সময় মুসলিম বিশ্বের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সম্পদ ওয়াকফর আওতায় চলে এসেছিল।

কিন্তু পরবর্তীকালে কমিউনিস্টরা সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে সব সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করল। ফলে সেসব ওয়াকফর অধীনে যেসব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এতিমখানা, সরাইখানা বা হাসপাতাল পরিচালিত হতো, তার সবই তখন বন্ধ হয়ে গেল।
আমাদের দেশেও একসময় ওয়াকফ সিস্টেম চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে আগ থেকে চলে আসা কিছু ওয়াকফ বাদে নতুন করে ওয়াকফ কম হচ্ছে বর্তমানে। আমরা যদি সত্যি সমাজের দুস্থ ও দরিদ্রদের জন্য সুব্যবস্থা করতে চাই যারা সমাজে অসহায়, বিত্তহীন-তাহলে আমাদের নতুন করে আবার ওয়াকফ আন্দোলন শুরু করতে হবে। মোট কথা একটি নতুন ওয়াকফ আন্দোলন শুরু করা উচিত। এটা সারা বিশ্বেই শুরু করা উচিত, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে এবং বাংলাদেশে।

আমাদের দেশের কথাই বলি। এখানে যাদের শত কোটি টাকা বা প্রচুর সম্পদ আছে তারা তাদের অর্থ-সম্পদ রেখে মারা গেলে সেই অর্থ সম্পদে তাদের কী লাভ হবে? তারা তাদের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ যেমন : তিন ভাগের এক ভাগ, চার ভাগের এক ভাগ কিংবা দশ ভাগের এক ভাগ ওয়াকফ করে যেতে পারেন। বাকি অর্থ-সম্পদ তাদের পরিবারের জন্য থাকবে। এর জন্য একেকজন একেক নামে ফাউন্ডেশন, আর এসবের যদি ওয়াকফ করা ২০, ২৫ কিংবা ৩০ কোটি টাকার সম্পদ থাকে, তাহলে তা সমাজের জন্য বিরাট অর্থবহ হয়ে উঠবে। এর জন্য যার ১০০ কোটি টাকা আছে তিনি উপরের উল্লেখ করা অনুপাতে দিলে পরিমাণ দাঁড়ায় ১০, ২৫, ৩৩ কোটি টাকা। এই টাকাই প্রতি বছর ওয়াকফর জন্য ব্যবহৃত হবে। এ টাকা থেকে আবার আয় হবে। এভাবে যদি আমাদের দেশে ১০০, ২০০, ৩০০ ওয়াকফ ফাউন্ডেশন চালু হয় তাহলে তার কী বিপুল প্রভাব সমাজে পড়ে- তা আমরা চিন্তা করতে পারি। এসব ফাউন্ডেশন কী করতে পারে? কোনো কোনো ফাউন্ডেশন হাসপাতাল স্থাপন করতে পারে, কেউ এতিমখানা করল, সেই সাথে এতিমখানায় স্কুল-কলেজ চালু করতে পারে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কোনো ফাউন্ডেশন হসপিটাল তৈরি করতে পারে যেখানে কম পয়সায় মানুষ থাকতে পারবেন। লোকেরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এলে তাদের থাকার জায়গার অভাব, হোটেল খরচ দিলেও নানাভাবে, কষ্ট পান, সেখানে অত্যন্ত কম ফি’র মাধ্যমে, এমনকি বিনামূল্যে তাদের থাকার জন্য ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেহেতু এটা ওয়াকফ প্রপার্টি, তাই ফ্রিও করা যেতে পারে। না হলে খুব সামান্য ফি ধার্য করা যেতে পারে। আবার কোনো ফাউন্ডেশন শুধু এমন হতে পারে যেন, তারা বৃদ্ধনিবাস তৈরি করে বৃদ্ধদের দেখার ব্যবস্থা করবে। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। বিধবাদের দেখাশোনার ব্যবস্থা হতে পারে। এমনিভাবে বিভিন্ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সব অসহায়ের দেখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

এ জন্য আমরা মনে করি, আমাদের দেশে নতুন করে একটি ওয়াকফ আন্দোলন শুরু করা দরকার। আমার আবেদন থাকবে, যারা কোটিপতি বা শতকোটি টাকার মালিক তারা একটি করে ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করবেন। তারা সব সম্পদ তাদের সন্তান বা পরিবারের জন্য না রেখে তার একটি নির্দিষ্ট অংশ ওয়াকফ করে দিয়ে এই ফাউন্ডেশনের জন্য রাখবেন। তারাই একটি কমিটি গঠন করবেন কিংবা বলবেন কী ধরনের কমিটি হবে। এই কমিটির মাধ্যমেই ফাউন্ডেশন পরিচালিত হবে। নগদ টাকাই যে দিতে হবে, তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যেমন- কারো দশটা শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকলে তিনটা প্রতিষ্ঠান ওয়াকফ করে দিয়ে দিতে পারেন। এতে তিনটি কোম্পানি ওয়াকফে চলে গেল। এর মানে হলো- জমির আয় থেকে যেমন ব্যবস্থা তেমনি এই ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান থেকেও আয় হবে। সেই শিল্প প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকবে সংশ্লিষ্ট ফাউন্ডেশন। সেখান থেকে যে আয় আসবে তা সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় হবে।

এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বর্তমানে এ দেশে যে ওয়াকফ আছে তার পরিমাণ তেমন উল্লেখযোগ্য নয় এবং তা খুব একটা ভালোও চলছে না। আবার যাও আছে তার যে ব্যবহার হতে পারত, তা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা আছে। আবার যারা এর মোতাওয়াল্লি তাদেরও ব্যর্থতা আছে। এ সবই সত্য কথা। কিন্তু যে ওয়াকফর কথা উল্লেখ করেছি তা কিছুটা নতুন ধরনের। এটা একেকটা ফাউন্ডেশন বা ট্রাস্ট ধরনের হবে। ফাউন্ডেশন বা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় তা পরিচালিত হবে। সেখানে একটা সিস্টেমেটিক ম্যানেজমেন্ট থাকবে। সেখানে প্রচলিত ওয়াকফর পরিণতি ঘটার সম্ভাবনা নেই। এটা সম্পূর্ণ নতুন টাইপ বলে ‘জিরো’ থেকেই আমরা শুরু করতে পারি। আগে হয়তো কোনো ব্যক্তি কোনো মাদরাসাকে লিখে দিতেন, আকারও ছোট ছিল। সেটা কখনো বড় আকার ধারণ করেনি। আর সে যুগে আজকের মতো এত সম্পদশালী ব্যক্তিও ছিলেন না। এখন অনেক পরিবারই ১০০, ২০০, ৫০০ কোটি টাকার মালিক। তাদের থেকেই নতুন ওয়াকফর কথা চিন্তা করা সম্ভব। তবে আজকাল ব্যক্তি ওয়াকফ খুব কম। সেটাও চলতে থাকবে। কিন্তু তার থেকে প্রস্তাবিত ফর্মে কাজটা করাই ভালো। আশা করব জাতির চিন্তাবিদ, স্কলার ও আলেমরা এ বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করবেন। আর সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিরা সেদিকে নজর দেবেন এবং এগিয়ে আসবেন।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

 


আরো সংবাদ



premium cement